খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলায় তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশ গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি’র

হিল ভয়েস, ৩১ অক্টোবর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: গত ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলায় গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি’র পক্ষ থেকে একটি নাগরিক দল ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন ও তথ্যানুসন্ধানের উপর ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই সময় তথ্যানুসন্ধান দলে ছিলেন ড: হারুন উর রশীদ, সত্যজিত বিশ্বাস, আবদুল্লাহ কাফী রতন, মোশরেফা মিশু, নজরুল ইসলাম, সায়েদুল হক নিশান, রজত হুদা এবং মারজিয়া প্রভা।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরীর ধর্ষণকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে সাধারণ নাগরিকের উপর নিপীড়ন করা হয়। এতে তিনজন মারমা যুবককে হত্যা করা হয় এবং প্রচুর দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বর্তমানে ভুক্তভোগীর পরিবার এখনো আতংকে রয়েছেন। কারণ বিভিন্ন সাংবাদিক পরিবারের সদস্যসহ ভুক্তভোগীকে ভিডিও করা, জোর করে কথা বলানো এবং ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। যার কারণে ভুক্তভোগী পরিবার শঙ্কাবোধ করে এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেছে।

আরো বলা হয়, ধর্ষণের ঘটনার পরপরই রক্তাক্ত অবস্থায় ফসলের ক্ষেত থেকে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়, তখনই তাকে অচেতন অবস্থায় খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্ত গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ হাসপাতাল থেকে মেয়েটিকে ডিসচার্জ ফরম দেবার পরে ওখানে অবস্থিত ওসি (পুলিশ সদস্য) মেয়েটির পরিবারের কাছ থেকে ডিসচার্জ রিপোর্ট কেড়ে নেয়। এমনকি সেটার ছবিও তুলতে দেয়া হয়নি। এমনকি ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে কোন প্রেসক্রিপশন, মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট কিছুই দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ বর্তমানে মেয়েটির পরিবারের কাছে হাসপাতাল থেকে প্রদান করা মেডিকেল ডকুমেন্টস নেই এবং ডিসচার্জ ফরম ওসি কেড়ে নিয়েছে।

গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী, ভুক্তভোগীর নাম প্রকাশ একটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্ত আমরা দেখেছি যমুনা টিভি ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ করে তার ধর্ষণের আলামত টেস্টের রিপোর্ট প্রচার করেছে। কিভাবে এই রিপোর্ট মিডিয়ার কাছে গেলো? যমুনা টিভিতে প্রকাশিত সংবাদ জানিয়েছে যে মেডিকেল পরীক্ষার ১০টি সূচকে আলামত পাওয়া যায়নি। সিভিল সার্জন মারফতে জানা যায়, মেডিকেল পরীক্ষায় ৩০টি সূচক থাকে। তবে যমুনা টিভি কোন ১০টি সূচকের কথা বলেছে তা তারা নিজেরাও জানেন না।

ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে বলেছে তার যোনিপথে রক্ত থাকার কারণেই তাকে প্রথমে কবিরাজ এবং পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়াও তার শরীরের উপরিভাগে ক্ষত থাকার জন্য তাকে মলম প্রদান করা হয়েছে। সিভিল সার্জন আমাদের জানিয়েছে যে তাদের রিপোর্টে ‘Sign of no forceful sexual intercourse’ বলা হয়েছে। কিন্ত যোনিপথে রক্ত এবং শরীরের ক্ষত কেন ফোর্সফুল সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্সের চিহ্ন হবে না তার কোন সদুত্তর তিনি দেননি। এক্ষেত্রে আমাদের সাথে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডঃ হারুন উর রশীদ জানিয়েছেন, মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স হিসেবে ‘Mere touch of valve’ কেই ধর্ষণ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

রিপোর্টে আরো বলা হয়, ২৮ সেপ্টেম্বর ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে প্রথমার্ধে শান্তিপূর্ণ অবরোধ ছিলো। সেনাবাহিনী এই অবরোধ নিয়ে অবগত ছিলো এবং জুম্ম ছাত্র জনতার আন্দোলনকারীকে জানিয়েছিলো তাদের শান্তিপূর্ণ অবরোধে তারা কোন বাঁধা দিবে না। কিন্ত যখন অবরোধ শেষ হতে দেড় ঘন্টার মতো বাকি তখন হুট করে শান্তিপূর্ণ অবরোধ পালনকালেই সেনাবাহিনী অবরোধকারী ছাত্র জনতার ওপর বিনা উস্কানিতে হামলা চালালে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এভাবে হামলার সূত্রপাত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এলাকার পরিচিত সেটেলার বাহিনী লাঠি, দা নিয়ে মারামারি করতে আসে। সেইসময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথবাহিনী গুলি ছুঁড়ে। এর ফলে তিনজন মারমা যুবক নিহত হন। তাদের নামঃ থোয়াইচিং মারমা (২৫), আখ্র মারমা (২৪) এবং আথুইপ্রম্ন মারমা (২৬)। এরমধ্যে থোয়াইচিং মারমার স্ত্রী ৬ মাসের গর্ভবতী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নিহতদের গুলি ছোঁড়ার পরেও তারা জীবিত ছিলেন। কিন্ত এরপর এলাকার পরিচিত সেটেলার বাঙালীদের উপর্যুপরি মারধোর ও নিপীড়নের ফলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের মৃত্যু ঘটে। নিহত হবার পরে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হলে পরিবারের সদস্যদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে পোস্টমর্টেমের পর লাশের মুখ দেখতে দেওয়া হলেও পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়নি, বরং সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথবাহিনী নিজ উদ্যোগে মৃতদেহের সৎকার করে। এখন পর্যন্ত পরিবার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট প্রাপ্ত হয়নি।

বলা হয়, গুইমারার হতাহত ঘটনাকে কেন্দ্র করে অজ্ঞাতনামা ৩০০-৭০০ জন কে আসামী করে একটি মামলা করা হয়েছে। তাই গণগ্রেফতারের ভয়ে প্রতিনিয়ত গুইমারার সিংগুলি পাড়ার সাধারণ মানুষ জীবন যাপন করছেন।

গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতি রাতে ড্রোন উড়িয়ে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেনাবাহিনীর টহলদল সন্ধ্যা হলেই টহল দিচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা এবং ‘সাংবাদিকবেশী’ সন্দেহভাজন ব্যক্তিবর্গ রামসু বাজারকে ঘিরে রয়েছে প্রতিনিয়ত।

গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি জানায়, আমরাও ফিরতি পথে সেনাবাহিনীর টহল গ্রুপ দেখেছি। রামসু বাজারে সেনাবাহিনীর টহলদল দেখেছি।

এই সময় গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি’র পক্ষ থেকে নিমোক্ত দাবিসমূহ উল্লেখ করা হয়:

১। অবিলম্বে খাগড়াছড়ির ধর্ষণ ভুক্তভোগী মারমা কিশোরীর ডিসচার্জ ফর্ম পরিবারকে দিতে হবে, বাকি দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হবে এবং ন্যায্যতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। এ মামলা কোনভাবেই যাতে দীর্ঘসুত্রায়িত এবং প্রভাবিত না হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। একইভাবে গত জুন মাসে ভাইবোনছড়ার ত্রিপুরা কিশোরীর ডিএনএ টেস্ট করানো এবং বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে স্বচ্ছ, প্রভাবমুক্ত, দ্রুততর বিচারকার্য চালাতে হবে। বর্তমান সংশোধিত নারী নির্যাতন দমন ২০০০ আইনের আওতায় ৯০ দিনের মধ্যে এই মামলার নিস্পত্তি আমরা দাবি করছি।

২। অবিলম্বে সংশোধিত নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর আওতায় ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশের কারণে দায়ী টিভি চ্যানেলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কিভাবে মেডিকেল রিপোর্ট গণমাধ্যমের কাছে গেলো তা বাংলাদেশ পুলিশকে জনসম্মুখে তুলে ধরার দাবি জানাচ্ছি।

৩। গুইমারার হতাহতের ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

৪। গুইমারায় হতাহতের ঘটনার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে এবং লাশ সৎকার নিয়ে হয়রানি বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে।

৫। নিহত মারমা পরিবার, স্বনির্ভর বাজার, ইয়ংবোদ বৌদ্ধবিহার, রামসু বাজার, মহাজনপাড়াসহ সকল ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ি এবং বাঙ্গালীদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৬। নিহত মারমা পরিবারের গর্ভবতী নারীকে চিকিৎসার খরচ দিতে হবে।

৭। গুইমারার অধিবাসীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। গণগ্রেফতারের, মিথ্যা মামলা, হামলা, হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

More From Author

+ There are no comments

Add yours