হিল ভয়েস, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ঢাকা: আজ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রোজ মঙ্গলবার, বিকাল ৪টায় শাহবাগ, জাতীয় জাদুঘরের সম্মুখে খাগড়াছড়িতে ধর্ষকদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং পাহাড়ী আদিবাসীদের অধিকার হরণ, বিচারহীনতা বন্ধ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগ গ্রহণের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর আয়োজনে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন ও সঞ্চালনা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা।
প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, এ এল আরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ জাসদ এর স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দীপক শীল ও বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল(বিএমএসসি), ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি নুমংপ্রু মারমা প্রমুখ।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, এই সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ৫৪ বছর ধরে জাতি বিদ্বেষী ও জাতি নিধন প্রক্রিয়া চলছে। সকল সরকার এর জন্য দায়ী। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মধ্যে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মতো। গণতন্ত্রের চেতনা, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের চেতনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা সবাই এগিয়ে যাব।
এ এল আরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, খাগড়াছড়ির সাম্প্রদায়িক হামলায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে আমরা দুঃখ পেয়েছি, আমরা ক্ষুব্ধ। আদিবাসীদের উপর নির্যাতনের বিচার কখনো হয় না, তদন্ত হয় না। আমরা এই বিচারহীনতার অবসান দেখতে চাই। আদিবাসীদের উপর হামলার ঘটনাগুলোর পরে নানা গল্প তৈরি করা হয় যে অমুক উস্কানি দিয়েছে। এইসব আজগুবি গল্প আমাদেরকে শোনাবেন না। যারা আসলে এই ঘটনাগুলো ঘটায় তাদের মুখোশ কখনো উন্মোচিত হয় না।
বাংলাদেশ জাসদ এর স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক বলেন, খাগড়াছড়িতে যে হত্যাকান্ড হয়েছে সেই সমস্যার সমাধানের বদলে সরকারের দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ করেছেন। যারা এই ধরনের নারী নির্যাতন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে জড়িত, আমরা বাংলাদেশের মানুষ তাদের বিচার নিশ্চিত করবো। গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশের সকল মানুষের উচিত আদিবাসীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে সমর্থন করা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ড. খায়রুল চৌধুরী বলেন, পাহাড়ের অবস্থা শান্তিপূর্ণ করার জন্য এই সরকার কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র দরকার হয়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামেও গণতন্ত্র দরকার। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চু্ক্তি হওয়ার মাধ্যমে জনগণের মনে যে আশা-বিশ্বাস ফিরে এসেছিল, গত ২৬ বছরে চু্ক্তি বাস্তবায়ন না করার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতা, সামরিক শাসন, ভূমি সমস্যা সহ সেখানকার মানুষের জীবনকে দূর্বিষহ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দীপক শীল বলেন, আদিবাসীদের উপর হামলার ঘটনায় প্রশাসনের দায়িত্বে যারা আছেন, তারা কোনো টু শব্দ করছে না। বরঞ্চ আরও বেশি করে মদদ দিচ্ছে। ফ্যাসিস্ট সরকার হাসিনার পতন হওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশে আর কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু না। এক স্বৈরাচার চলে গিয়েছে, এখন আরেক স্বৈরাচার একই চেয়ারে অধিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল(বিএমএসসি), ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি নুমংপ্রু মারমা বলেন, খাগড়াছড়িতে চলমান সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার দায় বাংলাদেশের প্রশাসন ও সরকারকে নিতে হবে। হামলার সাথে জড়িত সকলকে চিহ্নিত করে আইনে আওতায় আনতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত সকল আদিবাসীদেরকে সরকারকে উদ্যোগ নিয়ে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ঘটনা ঘটলো সেই ইস্যুতে আমরা সরকারের উপদেষ্টাদের থেকে কেবল দায়িত্ব জ্ঞানহীন কথাবার্তা শুনতেছি। তিনি আরও বলেন, খাগড়াছড়িতে যে ঘটনা ঘটেছে সেই ইস্যুতে বাংলাদেশে যে মানবাধিকার সংস্থাগুলো রয়েছে, তাদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চু্ক্তি যদি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হতো তাহলে আমরা এই ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতাম না।
সভাপতির সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিবাদ সমাবেশটি শেষ হয়।
প্রতিবাদ সমাবেশে সংহতি জানিয়েছেন দৈনিক আমাদের সময় এর সম্পাদক সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।
এছাড়াও, খাগড়াছড়িতে একজন মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগে ৩ জন নিহত ও ঘটনায় অন্তত ৩০ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে।পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন উক্ত ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ও পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান উপদেষ্টার দ্রুত হস্তক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে নিম্নোক্ত বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান করেছে-
১. খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; এবং নির্যাতিত কিশোরী এবং তাঁর পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
২. সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং মদদের অভিযোগের বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
৩. নিহত ও আহতদের পরিবারকে সুরক্ষা, যথার্থ ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. পাহাড়ে দীর্ঘদিনের সামরিকীকরণ নীতি পর্যালোচনা করে শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক সমাধানের পথে এগোতে হবে।
৫. পাহাড়ে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর দমন না হয় এবং জনগণ সত্য জানতে পারে।
৬. খাগড়াছড়ি ও গুইমারার ঘটনাবলীর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি যুক্ত করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে
৭. হত্যার শিকার হওয়া প্রতিটি পরিবারকে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৮. সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করে পার্বত্য সমস্যার স্খায়ী সমাধান করতে হবে।