কক্সবাজারের ইক্বরা তাহসীনুল কুরআন মাদ্রাসায় ধর্মান্তরিত ৩০ ম্রো শিশুর সন্ধান

হিল ভয়েস, ২০ মে ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: সম্প্রতি কক্সবাজারের ইদগাঁও এলাকার ইক্বরা তাহসীনুল কুরআন মাদ্রাসায় ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত ৩০ ম্রো শিশুর সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে শিক্ষার কথা বলে মৌলবাদী ও ধর্মব্যবসায়ী একটি চক্র বান্দরবানের আলীকদম, থানচি, লামা সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে গিয়ে এসব ম্রো শিশুদের ধর্মান্তরিত করে প্রায় গৃহবন্দী অবস্থায় সেখানে রেখেছে। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইক্বরা তাহসীনুল কুরআন মাদ্রাসায় পড়ানো হয় বলে জানা গেছে।

ম্রো শিশুদের গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে উক্ত মাদ্রাসারই নির্মাণাধীন আবাসিক ভবনের তৃতীয় তলায়। এই শিশুগুলো অনেকেই জানে না বা ভুলে গেছে তাদের নিজের গ্রামের নাম। আর তাদের পিতা-মাতারাও জানে কিনা জানা নেই যে, শিক্ষার নামে তাদের সন্তানদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। এইসব শিশুদের আবার বিভিন্ন ক্লিনিক সহ নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

মাদ্রাসার আবাসিক ভবনে ম্রো শিশুদের থাকার জায়গা ও বিছানা

এই ম্রো শিশুদের ধর্মান্তরিত করে উক্ত মাদ্রাসায় রাখার পশ্চাতেও ডা: মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর হাত রয়েছে বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সুকৌশলে ও সুপরিকল্পিতভাবে বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারে দরিদ্র আদিবাসী ম্রো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা শিশুদের শিক্ষা ও আর্থিক সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে মাদ্রাসায় নিয়ে গিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার পশ্চাতে যাদের ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে এই ডা: মোহাম্মদ ইউসুফ আলী অন্যতম বলে জানা গেছে।

গত ১২ মে ২০২৫ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ ম্রো শিক্ষার্থীর উক্ত প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে নতুন এই তথ্য জানা গেছে। তিনি আরও জানান, কক্সবাজারের জালালাবাদের ডিসি রোডে মমতাজ আবাসিক এলাকায় নির্মিত হচ্ছে ডা: মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর নামে ৬ তলা বিশিষ্ট ‘ডা: মোহাম্মদ ইউসুফ আলী হাসপাতাল’। এই হাসপাতালের সামান্য দূরত্বেই রয়েছে ইক্বরা তাহসীনুল কুরআন মাদ্রাসা।

সূত্রটির একটি বিবরণ নিম্নরূপ, ‘আবাসিক হলে ঢুকার আগেই একটা ছবি তুলে নিলাম। গেইটের ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা ‘ইক্বরা তাহসীনুল কুরআন মাদ্রাসা’। আবাসিক ভবনটি তিন কি চার তলা বিশিষ্ট। কোনোরকম বানানো আপাতত। ম্রো শিশুরা সবাই থাকে তিন তলায়। জীর্ণশীর্ণ ভবন। তিন তলায় উঠে অনেক ম্রো শিশুকে দেখতে পেলাম। মোটামুটি সবার সাথে ভাব বিনিময় করার চেষ্টা করলাম। তাদের নাম, ঠিকানা, শ্রেণি জানার চেষ্টা করলাম। বেশিরভাগই ঠিকমতো বলতে পারেনি। কয়েকজন নিচতলা থেকে ইট তোলার কাজ করতেছিল।’

মাদ্রাসার আবাসিক ভবনে ম্রো শিশুদের থাকার জায়গা

এসময় সূত্রটি যাদের পরিচয় নিতে পারেন তারা হল- (১) লাংরুং ম্রো, সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তার বাড়ি থানচির মেনরুয়া পাড়া গ্রামে। (২) মাংক্রি ম্রো, সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সে থানচির অংপুং পাড়া থেকে। (৩) রেংনং ম্রো, সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তার তথ্য অনুযায়ী, তার বাড়ি বলিবাজারের সাকক্ষয় পাড়া গ্রামে। সূত্রটি আরও বলেন, অন্যরা তাদের নাম, ঠিকানা ভালো করে বলতে পারেনি। কেউ কেউ শুধু উপজেলা আলীকদম এর নাম উল্লেখ করতে পেরেছে। কয়েকজন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছিল।

সূত্রটি জানায়, আগে এই মাদ্রাসায় ত্রিপুরা শিশুর সংখ্যা বেশি ছিল। বর্তমানে ম্রো ছাত্র রয়েছে।

সূত্রটি আরও জানায়, পড়াশোনা, ছুটি ও রুটিনের ব্যাপারে জানার চেষ্টাও করলাম। একজন বললো- খুব ভোরেই আযানের সময় ঘুম থেকে উঠতে হয় এবং নিয়মিত নামায পড়তে হয়৷ এগুলো বিরক্তিকর বলেও সে জানালো।

গত ১৬ মে ২০২৫ রেং হাই ম্রো নামে এক ব্যক্তি তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ধর্মীয় আগ্রাসনের শিকার কোমলমতি ম্রো সম্প্রদায়ের শিশুদের বিষয়ে সত্য কথা বললে অনেকেই আমাকে আবার খারাপ লাগতে পারে বা মামলা দিতে পারে। ভালো করে ছবিগুলো খেয়াল করুন তাদের থাকার ব্যবস্থাপনা কি বেহাল অবস্থা।’

তিনি আরও লেখেন, ‘বিগত ২০২৩-২০২৪ সালে ঈদগাহ মাদ্রাসা (কক্সবাজার) থেকে মোট ১৪ জন কোমলমতি ম্রো সম্প্রদায়ের শিশুদের উদ্ধার করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় এবং উদ্ধার করতেও সক্ষম হই। উদ্ধার করে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন বৌদ্ধ আশ্রমে পাঠানো হয় এবং উদ্ধারকৃত ম্রো বাচ্চাগুলো বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) দুটি বৌদ্ধ আশ্রমে রয়েছে, পড়াশোনা করছে।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘মাদ্রাসা থেকে শিশুগুলোকে উদ্ধার করতে গিয়ে আমাকে বা আমার টিমকে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছিলো। অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছিলো। আমার টিমের সকল সদস্যদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও আমার উপর বিভিন্নভাবে চাপ আসে, আমার নামে নানানভাবে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয় যা আমার জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু জাতির টানে নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজ চলমান রাখি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে উদ্ধারের চেষ্টায় ধর্মান্তরিত হতে যাওয়া মোট ৯ জন কোমলমতি শিশুকে উদ্ধার করতে আবারও সক্ষম হয় আমাদের উদ্ধার টিম।’

More From Author