ওয়াশিংটনে ইউএনপিও’র সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণ

0
775

হিল ভয়েস, ২৮ মার্চ ২০২২, আন্তর্জাতিক ডেস্ক:পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রতিনিধিদল আনরিপ্রেজেন্টেড নেশন্স এন্ড পিপল্স অরগানাইজেশন (ইউএনপিও) এর সাধারণ পরিষদের সভায় অংশগ্রহণ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রীতিবিন্দু চাকমা এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিদলের পক্ষে মিজ অগাস্টিনা চাকমা ইউএনপিও’র সাধারণ পরিষদের সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিকায়ন, আন্দোলনকারীদেরকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ, ভূমি বেদখল ও মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।

গত ২৬ মার্চ ও ২৭ মার্চ ২০২২ ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউএনপিও’র সাধারণ পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইউএনপিও’র ৪৫ সদস্যদের প্রায় ৭০ জন প্রতিনিধি এই সাধারণ সভায় অংশগ্রহণ করেন। এই সাধারণ পরিষদের সভার আয়োজক ওয়াশিংটনের ডিষ্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার সিনেটর পল স্ট্রস-এর নেতৃত্বে ইউএনপিও’র সদস্য ‘ডিষ্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া’।

সাধারণ পরিষদের সভার শুরুতে ইউএনপিও’র মহাসচিব রাল্ফ বুনচে ইউএনপিও’র কর্মসূচির উপর একটি সাধারণ রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এছাড়া তিনি গত বছর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্তর্জাতিক মুখপাত্র ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মৃত্যু এবং জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানের ক্ষেত্রে তাঁর ত্যাগ, সংগ্রাম ও অবদান বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।

রাল্ফ বুনচে বলেন, ‘আমরা এমন একজনকে হারিয়েছি, যিনি কেবল জুম্ম জনগণের একজন প্রতিনিধি ছিলেন না, সমগ্র প্রতিনিধিত্বহীন ও প্রান্তিক জাতি ও জাতিগোষ্ঠীর মুখপাত্র ছিলেন। তাঁর সংগ্রাম ও অবদান অব্যাহতভাবে অধিকারকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’

সাধারণ পরিষদের সভায় গোপন ভোটের মাধ্যমে ইউএনপিও’র একটি ১১ সদস্য বিশিষ্ট প্রেসিডেন্সী গঠন করা হয়। প্রেসিডেন্সীর সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন সোমালিল্যান্ডের এডনা এ্যাডান ইসমাইল। এছাড়া প্রেসিডেন্সীর সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন কাটালোনিয়া থেকে এলিসেন্ডা পলুজি এবং সিন্ধ থেকে রুবিনা গ্রিনউড। প্রেসিডেন্সীর ৮ সদস্যের মধ্যে এশিয়া থেকে তিব্বতের রিগজিন জেনখাঙ এবং খেমার ক্রম-এর এলেক্স থাচ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রস্তাবনায়, অগাস্টিনা চাকমা ইউএনপিও সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগের অনুরোধ জানান, যে চুক্তি আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর শান্তি ও সুরক্ষার জন্য ১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়।

বিগত ২৪ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ নিয়ে গঠিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা চালু না হওয়ায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিনিধিদল, যা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে তাদের স্বশাসনের অধিকার ও তাদের নিজেদের উন্নয়ন নির্ধারণের অধিকার অর্জন থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য পার্বত্য চুক্তির ধারাসমূহ বাস্তবায়নের ব্যর্থতা পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ও স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে বাধা সৃষ্টি করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিগণ পূনর্ব্যক্ত করে বলেন যে, একপ্রকার সামরিক শাসন ‘অপারেশন উত্তোরণ’ এর বদৌলতে সেনাবাহিনী প্রশাসন, আইন ও শৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা ও উন্নয়নসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। সেনাবাহিনী এমনকি সেটেলার, সন্ত্রাসী দলসমূহকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দান ও জোরপূর্বক ভূমি দখল এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টিসহ চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে।

এরূপ কর্মকান্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন ও শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা গঠন করে। তাই পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক অনতিবিলম্বে সামরিক শাসন ‘অপারেশন উত্তোরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা উচিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিবৃন্দ বলেন, বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে পূর্বেকার স্বৈরাচারী শাসকদের ন্যায় সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নীতি অনুসরণ করে চলেছে। এই কারণে সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে অান্দোলনরত অধিকারকর্মীদের ও সংগঠনসমূহকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’ ও ‘সশস্ত্র দুর্বৃত্ত’ হিসেবে পরিচিতি দিয়ে তাদেরকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ জোরদার করেছে।

অগাস্টিনা চাকমা বাংলাদেশ সরকারকে জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ অধিকারকর্মীদের নিপীড়ন বন্ধ করার এবং চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করার জোরালো আহ্বান জানান।

প্রতিনিধিগণ আরও উল্লেখ করেন যে, ভূমি কমিশনের অকার্যকারিতারর ফলে এখনও পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারেনি। পক্ষান্তরে বাঙালি সেটেলারদের কর্তৃক স্থানীয় জুম্মদের মালিকানাধীন ভূমি বেদখল চলছে। তাই ভূমি কমিশনকে যথাযথ কার্যকারিতার মাধ্যমে আদিবাসীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হতে পারে বলে অগাষ্টিনা চাকমা উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য যে, ইউএনপিও হচ্ছে বিশ্বব্যাপী প্রতিনিধিত্বহীন ও প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর দাবিনামা জোরদারকরণ এবং তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন এবং সংগঠন।

ইউএনপিও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শান্তির ভূমি খ্যাত হেগ শহরে। বিশ্বজুড়ে ইউএনপিও’র ৪৫ সদস্য রয়েছে। ৪৫ সদস্যের মধ্যে একটি হল পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন।