ঐতিহ্যবাহী বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, সাংক্রান এবং কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

0
943

সজীব চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের ঐতিহ্যবাহী সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, সাংক্রান। মনে হতে পারে উৎসবটির এ এক দীর্ঘ নাম, নতুবা ভিন্ন ভিন্ন সব একেকটি উৎসব। প্রকৃতপক্ষে নামে ও পরিসরে পার্থক্য থাকলেও বিষয়বস্তুর আলোকে তথা অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে এটি অভিন্ন এক উৎসব। স্মরণাতীত কাল থেকে তারা এই উৎসব পালন করে আসছে। কালের পরিক্রমায়, আর্থ-সামাজিক বিকাশের গতিধারায় এটি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, অথচ স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এই উৎসবটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আদিবাসী জুম্মদের সংখ্যাগরিষ্ট অংশ ও অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠী এই উৎসবটি অত্যন্ত মর্যাদা ও মমতার সাথে লালন ও পালন করে থাকে। আর এই উৎসবে সামিল হয় ও উপভোগ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ।

বৈসুক, সাংগ্রাইং, বিজু বনাম বৈসাবি

একদা কয়েক দশক আগে সাধারণভাবে ‘বিজু’ নামটিই কেবল প্রকাশ পেয়েছিল। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে এবং তৎপরবর্তী বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু সময় পর্যন্ত সরকারি বিভিন্ন আদেশেও এই ‘বিজু’ শব্দটি প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। তবে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে, বিশেষ করে নব্বই দশকের দিকে বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনেকেই ‘বিজু’ বানানের পাশাপাশি ‘বিঝু’ বানানটিও স্বতস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করতে থাকে। কেউ কেউ অবশ্য এই বানান নিয়ে মৃদু বিতর্ক করতে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আমি উভয় বানান ব্যবহারের মধ্যে সমস্যা যেমন দেখি না, তেমনি এনিয়ে এত বেশি টানাটানি করারও পক্ষপাতি নই। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়ও এধরনের বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। যাই হোক, অপরদিকে ‘বিজু’র পাশাপাশি নব্বই দশকের শুরু থেকে ‘সাংগ্রাইং বা সাংগ্রাই’ ও ‘বৈসুক বা বৈসু’ও প্রচার পেতে থাকে স্বনামে। বৈসুক, সাংগ্রাইং, বিজু এর আদ্যক্ষর নিয়ে সম্মিলিত প্রকাশ হিসেবে প্রচলন হতে থাকে ‘বৈ-সা-বি বা বৈসাবি’ শব্দটি। বের হতে থাকে বিভিন্ন লেখালেখি নিয়ে ‘বৈসাবি সংকলন’, গঠিত হতে থাকে ‘বৈসাবি উদযাপন কমিটি’। এর একটা ব্যবহারিক সুবিধা আছে বৈকি। এভাবে একসময় পত্রপত্রিকায়, বিভিন্ন প্রকাশনায় ‘বৈসাবি’ নামটিই প্রচার পেতে থাকে। পরবর্তীতে এমনভাবে নির্বিচারে এই শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে, কেউ কেউ ‘বৈ-সা-বি’র আদ্যক্ষর এর ব্যাপারটিও গুলিয়ে ফেলে ‘বৈসাবী’ বা ‘বৈসাবীন’ লিখতে শুরু করেন, তাতে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবের প্রকৃত নামগুলোই যেন চাপা পড়তে বসেছিল। এখনও অনেকে তাই ব্যবহার করে চলেছেন। না জানি কোন এক দিন কেউ দাবি করে বসবেন বৈসাবি বা বৈসাবীও নয়- ‘বৈশাখী’। ইতিহাস বিকৃতির এই দেশে এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে একটু আশার দিক হল, অতিসম্প্রতি অনেক গণমাধ্যম বা ব্যক্তি ‘বৈসাবি’ শব্দটি পরিহার করার চেষ্টা করছেন। আবার, উদ্বেগের দিক হল, কিছু গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং কিছু কিছু ব্যক্তি প্রেক্ষাপট না জেনে বা বিবেচনা না করেই সরলভাবে এই শব্দটির পক্ষে বলছেন। প্রকৃতপক্ষে ‘বৈসাবি বা বৈসাবী’ বলে কোন উৎসবের অস্তিত্ব নেই। এটি বড়জোর একটি অপৎড়হুস বা আদ্যক্ষরা। বস্তুত উৎসবে ঐতিহ্যবাহী প্রতিটি নামের সাথে জড়িয়ে রয়েছে যুগযুগান্তরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং এইসব প্রত্যেকটি নামের পেছনে রয়েছে নির্দিষ্ট ব্যঞ্জনা। অথচ বৈসাবি’র আলাদা কোনো অর্থ করা যায় না। এটা ইচ্ছে করলে ‘বিসাবৈ’ বা ‘বৈবিসা’ বা ‘সাবৈবি’ হিসেবেও লেখা যায়। এখন বোধ হয় সময় এসেছে এব্যাপারে সচেতন হওয়ার। বস্তুত এই উৎসবটি চাকমাদের ভাষায় ‘বিজু’ (উচ্চারণ ভেদে ‘বিঝু’), মারমা ও চাকদের ভাষায় ‘সাংগ্রাইং’, ত্রিপুরা ভাষায় ‘বৈসু’ (অথবা ‘বৈসুক’), তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় ‘বিষু’, গুর্খা ও অহমিয়াদের ভাষায় ‘বিহু’, ম্রোদের ভাষায় ‘সাংক্রান (বা চাংক্রান)’, খুমীদের ভাষায় ‘সাংক্রাই’ নামে অভিহিত করা হয়।

বিভিন্ন দেশে এই উৎসব

জানা যায়, এই একই প্রকৃতির উৎসব ভারতের আসামে ‘বিহু’, হিমাচল প্রদেশ ও হিমালয়ের প্রায় সবক’টি রাজ্যে ‘বিষুব সংক্রান্তি’, ‘বিষু’ বা ‘বৃষু’ এবং নেপালে ‘বিষু উৎসব’ নামে পরিচিত। অপরদিকে মায়ানমারে এটি ‘ছিংগায়ান’ (Thingyan), থাইল্যান্ডে ‘সংক্রান’ (Songran) নামে পরিচিত। জানা যায়, উল্লিখিত দেশ ও প্রদেশে এটি অন্যতম জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়।
উৎপত্তি

চৈত্র সংক্রান্তির দিনকে পঞ্জিকার ভাষায় বলা হয় ‘বিষুব সংক্রান্তি’ বা ‘মহাবিষুব সংক্রান্তি’। কারও কারও মতে, সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্ত’ (যার অর্থ পরিবর্তন) থেকেই ‘সংক্রান্তি’ শব্দের উৎপত্তি। বাংলা একাডেমির অভিধানে ‘বিষুব’, ‘সংক্রান্ত’ বা ‘সংক্রান্তি’ শব্দসমূহের উৎপত্তি নির্দেশ করা হয়েছে ‘সংস্কৃত’ থেকে। এতে ‘বিষুব’ শব্দের অর্থ ‘যে সময়ে দিন ও রাত্রি সমান হয়’ ইত্যাদি উল্লেখ রয়েছে। আর ‘সংক্রান্তি’ শব্দের অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে ‘সূর্য ও গ্রহাদির এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন; সঞ্চার’, ‘মাসের শেষ দিন (চৈত্রসংক্রান্তি)’ ইত্যাদি। এও জানা যায়, সুপ্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসবকে বলা হতো ‘বিষুব সংক্রান্তি’। তাই ধারণা করা যায়, উক্ত শব্দ দুটি থেকে ধীরে ধীরে সংক্ষেপিত ও পরিবর্তিত রূপে কোথাও ‘বিষু’, ‘বিহু’, ‘বৈসুক’ বা ‘বৈসু’ ও ‘বিজু’ হয়েছে; আবার কোথাও ‘সংক্রান’, ‘সাংক্রান (চাংক্রান)’, সাংক্রাই’, ‘সাংগ্রাইং’, ‘ছিংগায়ান’ ইত্যাদি রূপ নিয়েছে। প্রফেসর মংসানু চৌধুরী ও উ ক্য জেন তাঁদের ‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সংস্কৃত ‘সংক্রান্তি’ থেকেই ‘সাংগ্রাইং’ শব্দের উৎপত্তি। তবে কখন, কিভাবে এসবের উৎপত্তি তা সঠিকভাবে এখনও জানা যায় না।

ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব

বাংলা বর্ষপঞ্জীর হিসেবে সাধারণত বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন -এই তিন দিনে বা তিন পর্বে এই উৎসবটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ‘ফুল বিজু’, মারমারা বলে ‘পাইং ছোয়াই’, ত্রিপুরারা বলে ‘হারি বৈসুক’, তঞ্চঙ্গ্যারা বলে ‘ফুল বিষু’, গুর্খা ও অহমিয়ারা বলে ‘ফুল বিহু’, ম্রোরা বলে ‘সাংক্রানি ওয়ান’, চাকরা বলে ‘পাইংছোয়েত’। উৎসবের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ বাংলা বর্ষপঞ্জীর বিদায়ী বর্ষের শেষ দিনকে চাকমারা বলে ‘মূল (বা মূর) বিজু’, মারমারা বলে ‘সাংগ্রাইং আক্যা’, ত্রিপুরারা বলে ‘বৈসুকমা’, তঞ্চঙ্গ্যারা বলে ‘মূল বিষু’, গুর্খা ও অহমিয়ারা বলে ‘মূল বিহু’, ম্রোরা বলে ‘সাংক্রানি পানী’, চাকরা বলে ‘আক্যাই’। উৎসবের শেষ পর্ব অর্থাৎ বাংলা বর্ষপঞ্জীর নববর্ষের প্রথম দিনের উৎসবকে চাকমারা বলে ‘গোজ্যায়পোয্যা দিন’, মারমারা বলে ‘সাংগ্রাইং আপ্যাইং’ (তাকখীং), ত্রিপুরারা বলে ‘বিসিকাতাল’, তঞ্চঙ্গ্যারা বলে ‘গর্য্যাপর্য্যা বিষু’, গুর্খা ও অহমিয়ারা ‘নববর্ষ’ পালন করে, ম্রোরা বলে ‘সাংক্রানি চুর’ আর চাকরা বলে ‘আপ্যাইং’।

আগেই বলা হয়েছে, ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন নামে অভিহিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এই উৎসবসমূহের বৈশিষ্ট্য এবং অন্তর্গত ভাবধারা মূলত একই। যেমন উৎসবের প্রথম দিনে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বিভিন্ন বাগান বা বন থেকে নানা রকমের ফুল সংগ্রহ করে সেই ফুল দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি সাজায়। সঙ্গী-সাথীরা মিলে নদী বা ছড়ায় গিয়ে স্নান করে। কেউ কেউ কেয়াঙে গিয়ে সকালে ফুল দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করে, নানা ধর্মীয় কর্ম সম্পাদন করে এবং সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে। আগেকার দিনে গ্রাম জনপদে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা ঝাঁক বেঁধে সকাল বেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহপালিত পশু-পাখিদের খাবার দিত। কেউ কেউ নিজেদের নানান রকম ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরী করে। এই দিন থেকে শুরু হয় ত্রিপুরাদের জনপ্রিয় ‘গরয়া নৃত্য’। শুরুর দিন থেকে একটানা ৫-৭ দিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গরয়া শিল্পীরা ঢোল-বাঁশী বাজিয়ে ‘গরয়া নৃত্য’ পরিবেশন করত। উৎসবের দ্বিতীয় দিনই উৎসবের মূল পর্ব এবং কাক্সিক্ষত দিন। এদিন ঘরে ঘরে সকলের জন্য খানাপিনার আয়োজন করা হয়। হরেক রকম পিঠা, নানা জাতের সেদ্ধ করা আলু, ফলমূল, পায়েস, শরবত ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়। তবে এ সমস্ত খানাপিনার মধ্যে মূল আকর্ষণ হল শুটকী কিংবা শুকনো বা সেঁকা মাছ মিশিয়ে নানা প্রকার পাঁচমিশালী শবজি দিয়ে রান্না করা ভেষজগুণ সমৃদ্ধ এক ধরনের সুস্বাদু তরকারি। এটিকে চাকমারা বলে ‘পাজন’ বা ‘পাজোন’, আর ত্রিপুরারা বলে ‘পাচন’। মারমারা এ ধরনের তরকারিকে বলে ‘হাঙ-র’, তবে এটি তাদের প্রধান উপাদান নয়। সবাইয়ের চেষ্টা থাকে বা প্রতিযোগী মনোভাব থাকে কার পাজন কত পদ দিয়ে তৈরী বা কত সুস্বাদু। আর প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য মদ চাকমা ভাষায় ‘দ-চোয়ানি’, ‘এক-চোয়ানি’ ও ‘জগরা’ পরিবেশন করা হয়। এছাড়া আজকের দিনে সামর্থ্য অনুযায়ী মিষ্টি, জিলাপী, চটপটি, মাংস ও নানা স্বাদের কোমল পানীয়সহ আরও অনেক খাবারও পরিবেশন করা হয়। উৎসবের শেষ পর্বেও খানাপিনার আয়োজন থাকে। এদিনে ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণীরা নদী বা ছড়ায় গিয়ে ফুল ভাসিয়ে দেয়। তবে এদিনের অন্যতম অনুষঙ্গ হল ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা। এদিন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যাওয়া হয় অথবা বাড়িতে ধর্মীয় গুরু এনে ধর্মীয় সূত্রাদি শ্রবন করা হয়। আগেকার দিনে তরুণ-তরুণীরা নদী-কুয়ো থেকে কলসী কাঁকে করে জল তুলে এনে বয়স্কদের স্নান করাত। বুদ্ধমূর্তিকে স্নান করানো হয়। এই স্নান করানোটা হল পুরানো বছরের ময়লা-আবর্জনা বা আপদবিপদ ধুয়ে পূতঃপবিত্র হওয়ার প্রতীক। সন্ধ্যায় বাসার কামরায় বা দরোজায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয় এই উদ্দেশ্যে যে, পুরানো বছরের যাবতীয় অজ্ঞানতা, আপদ-বিপদের অন্ধকার যেন দূরীভূত হয়ে যায়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মারমাদের অন্যতম আকর্ষণীয় উপাদান হল ‘রিলংবোয়ে’ (অর্থাৎ পানি খেলা)। এটা প্রায় দুই দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। এই পানি উৎসবকে তারা বাংলায় ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’ বলে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাসহ ‘বলীখেলা’ও আয়োজন করা হয়।

পরিবর্তনশীল এই উৎসব

বলাবাহুল্য, জগতের সবকিছুই যেমনি পরিবর্তনশীল, তেমনি এই উৎসবও এক অবস্থায় বা একরূপে থাকতে পারেনি। নানা প্রতিকূলতায় এই উৎসবের অনেক কিছুই যেমনি ক্ষুণ্ন হতে বা হারিয়ে যেতে বসেছে, তেমনি সময়ের প্রয়োজনে নতুন বাস্তবতার আলোকে অনেক নতুন উপাদানও সংযোজিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশেষত শহর এলাকায়, তবে এখন গ্রাম এলাকায়ও, অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য র‌্যালি, আলোচনা সভা, সেমিনার, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কবিতা পাঠের আসর, নাটক মঞ্চায়ন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আদিবাসী বিজু মেলা, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে প্রকাশ করা হয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও গবেষণা বিষয়ক নানা প্রকাশনাও এবং বের করা হয় নতুন নতুন গানের এ্যালবাম, ভিডিও চিত্র বা ভিডিও ফিল্ম। অধুনা এই উৎসব বরণ বা পালনের অন্যতম অনুষঙ্গ র‌্যালিতে থাকে নির্মল আনন্দ ও উৎসবের আবহ। এদিন সকল জাতির নারী-পুরুষ স্ব স্ব পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ও ঐতিহ্যবাহী গীত পরিবেশন করে, রেং বা আনন্দ ধ্বনি দিয়ে র‌্যালিতে অংশগ্রহণ করে। র‌্যালিতে ধারাবিবরণীর মধ্য দিয়ে উচ্চারণ করা হয় জাতীয় ঐক্যের কথা, স্বকীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশের কথা, প্রগতির কথা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও মানবজাতির শান্তির কথা, সকলের মঙ্গলের কথা। তবে কখনও কখনও এই র‌্যালি ও আলোচনা সভা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উচ্চারণের এক মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়। নিঃসন্দেহে নতুন নতুন এই সকল দিকগুলো বা আয়োজনসমূহ এই উৎসবের তাৎপর্যকে এবং দায়-দায়িত্ব বা ভূমিকাকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক বেশী। কিন্তু পাশাপাশি কোন কোন ক্ষেত্রে উৎসবের নামে বা উৎসবের আতিশয্যে কেউ কেউ ঘটায় নানা বিপত্তি ও অপ্রীতিকর ঘটনা। ফুল তোলার নামে কারো ফুলের বাগান করা হয় তছনছ, ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কারো বাড়ির আঙিনায় থাকা গাছের ফলমূল। অথবা অপরিমিত মদ্যপানে নেশাগ্রস্ত হয়ে বিনষ্ট করা হয় পারস্পরিক সম্প্রীতি। ফলে নির্মল উৎসব ও আনন্দের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। এই ধরনের পরিবেশ কোনভাবে কাম্য হতে পারে না।

এই উৎসবের তাৎপর্য

কোন জাতিই সংস্কৃতি ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। আদিবাসীদের সংস্কৃতিই আদিবাসীদের জীবন। বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, সাংক্রান আদিবাসী জুম্ম সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপ্রবাহ, অনুপ্রেরণা ও অভিব্যক্তি। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও প্রধানত এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই আদিবাসী সংস্কৃতি কর্মীরা উজ্জীবিত হয়। এই উৎসবকে সামনে রেখে অনেকে বিভিন্ন প্রকাশনা ও বই-পুস্তক প্রকাশ করেন। আর সচেতন, অনুসন্ধিৎসু ও বোদ্ধা পাঠক-ক্রেতারা সেই প্রকাশনা সাগ্রহে সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। বই পড়া ও কেনার প্রতি অনাগ্রহী এই সমাজে এখনও এই দিকটি ক্ষীণ হলেও এটিও অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ একটি ব্যাপার। হয়তো একদিন এই উৎসবকে কেন্দ্র করে অনেক বই প্রকাশ হবে, সেই বইয়ের পাঠক হবে, বড় বড় বইমেলা হবে; অনেক গান, নাটক ও ছায়াছবির সৃষ্টি হবে; ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাগুলো অনেক বিকশিত হবে। তখন এই উৎসবটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই উৎসবের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ চেতনা হলÑ এটি মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতাবোধ, সম্প্রীতি, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক চেতনা, অকৃপণতা, উদারতা, আন্তরিকতা, অকৃত্রিম সেবা, ভালোবাসা আর মমত্ববোধ জাগিয়ে দেয়, জোরদার করে। এই দিনগুলিতে এই উৎসব যেন নিরব ভাষায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি বিভেদের বিপক্ষেই কথা বলে যায়। এদিন প্রতিটি জুম্ম যেন প্রতিবেশী বা কাছে-দূরের, চেনা-অচেনা প্রত্যেক অতিথির জন্য ঘরের দুয়ার খুলে বসে থাকে উদার চিত্তে, পরম আন্তরিকতায় আপ্যায়নের জন্য। বস্তুত এই উৎসব আদিবাসী জুম্মদের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি ও জীবনের কথাই বলে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের কথা বলে।

উৎসব, রাষ্ট্র ও বিদ্যমান পরিস্থিতি

মানুষের জীবন সংগ্রামের সাথে উৎসবের রয়েছে নিবিড় ঐতিহাসিক সম্পর্ক। গোড়াতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে উৎপাদন সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে সেই উৎপাদন সংগ্রামেরই একটি ব্যাপার ছিল এই উৎসব। ফলে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সমাজ, জীবন-জীবিকা, ভূপ্রকৃতি, উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটেই একটি নির্দিষ্ট উৎসবের উৎপত্তি হয় এবং তার বিকাশ হয় সেই নিয়মে। বস্তুত কোন সমাজ বা সামাজিক জীবনের সাথে সেই সমাজের মানুষের কোন উৎসবের থাকে একটা গভীর সম্পর্ক। বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, সাংক্রান উৎসব আদিবাসী জুম্মদের জীবন ও সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যদি যথাযথ ও অকৃত্রিমভাবে উদযাপন করা যায় তাতে জুম্মদের সমাজ জীবনে গভীর অনুপ্রেরণা সৃষ্টি ও প্রাণের সঞ্চার করতে পারে। আবার এটি যদি বাধাপ্রাপ্ত হয় কিংবা বিপথে পরিচালিত হয় তাতে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকেই উৎসাহিত করবে। বলাবাহুল্য, জুম্মদের জীবন ও এই উৎসব বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় নীতি এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ঐতিহাসিকভাবে এই দেশটি বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি ও বহু জাতির একটি দেশ হলেও সাংবিধানিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতিমালার আলোকে এদেশের সংখ্যালঘু আদিবাসী জাতিসমূহ বৈষম্যের শিকার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে পনের-ষোলবার সংবিধান সংশোধন করা হলেও আদিবাসীদের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে তাদের যথাযথ ও মর্যাদাপূর্ণ আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। তাদের প্রাপ্য রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্তরে স্তরে তারা এখনও ব্যাপক শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হন। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মানবাধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হলেও দীর্ঘ ২৪ বছরেও চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে অনেক জুম্ম তাদের হারানো ভূমি ফিরে পায়নি, তাদের বসতবাটিতে ফিরতে পারেনি। তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারসমূহ এখনও চরমভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে যে অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্র, চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়ন না করার কারণে সেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জুম্মরা। উপরন্তু সরকার কর্তৃক উন্নয়নের নামে চুক্তির মূল চেতনার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং জুম্ম স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কারণে জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্বই আজ চরম হুমকীর মধ্যে পড়েছে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হল, চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার দীর্ঘ ১২/১৩ বছর ধরে একনাগাড়ে ক্ষমতায় থেকেও বর্তমানে চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। উপরন্তু সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যতম পক্ষ জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপর দমন-পীড়ন জোরদার করার ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তির পূর্বের ন্যায় সেনাকর্তৃক জোরদারসহ নতুন নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন, জুম্মদের ভূমি বেদখল এবং জনসংহতি সমিতির শত শত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে আবারও শ্বাসরুদ্ধকর ও বিস্ফোরন্মুখ হয়ে উঠেছে।

এই অবস্থায় জুম্মদের জাতীয় জীবন এখনও গভীর এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। তাই জুম্মদের জীবনে তাদের এই মহান ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি যেভাবে, যেরূপে ও যে মহিমায় উদযাপিত হওয়ার কথা সেভাবে স্বতস্ফূর্তভাবে উদযাপিত হতে পারছে না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বস্তুত এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু, স্বাভাবিক পরিবেশ, নিঃশংক ও নিরুদ্বিগ্ন জীবন, সুষম উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা। সর্বোপরি জরুরী দরকার হল রাষ্ট্র কর্তৃক ভিন্ন ভাষী আদিবাসী জাতির জীবন, সংস্কৃতি ও অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান এবং তা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

তথ্যসূত্রঃ
১। সজীব চাকমা, পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব, সাপ্তাহিক ‘রোববার’, ১১ এপ্রিল ২০১০, পৃষ্টা ১৮-২০।
২। শ্রী সুপ্রিয় তালুকদার, লেখক ও প্রাক্তন পরিচালক, উসাই, রাঙ্গামাটি।
৩। বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিয় গবেষণা, প্রথম খন্ড, ডিসেম্বর ২০১০, উৎস প্রকাশন, ঢাকা ও বালাদেশ আদিবাসী ফোরাম।