ঐতিহাসিক নারীমুক্তি আন্দোলনের পাতা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী মুক্তি আন্দোলন

0
1199

নিপন ত্রিপুরা

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন “বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। কবি তাঁর কাব্য ভাষায় সমাজ সভ্যতা বিকাশে নারীর অপরিসীম ও নারীর অধিকারের কথা স্বীকার করলেও সমাজ বিকাশের একবিংশ শতকে এসেও নারী অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও অধিকার বঞ্চিত। নারী মানে কেবলই পণ্যের সমাহার। টেলিভিশন ও বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনে যেভাবে নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখানো হয়, বাস্তবে নারীর বর্তমান অবস্থা তেমনই। পুরুষের সমান সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীকে আজো লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

নারী অধিকার তথা মানুষ হিসেবে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদার বিষয়টি পুঁজিবাদী সমাজে অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় একটি আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে নারী অধিকার কোন প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠা তথা নিশ্চিত করা যাবে সে বিষয়ে চলছে নানান আঙ্গিক থেকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। বস্তুত নারীমুক্তি আন্দোলন তথা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে এসেছে মার্কস ও এঙ্গেলসের লিখিত বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন।

সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ঊষালগ্নে নারীর স্থান ছিল মর্যাদাপূর্ণ। আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে নারী অংশগ্রহণ ছিল বেশি। তখন ছিল না নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ ও বৈষম্য। কৃষিকাজ নিয়ন্ত্রণ করত নারীরা। পুরুষেরা কেবল শিকারের কাজ করত। আহরিত ফলমূলের বীজ থেকে যে শস্য উৎপাদিত হয়, তা সর্বপ্রথম নারীরাই খেয়াল করে। ফলে মানব ইতিহাসে কৃষিবিপ্লব নারীর হাত ধরে বিকশিত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় নারী দীর্ঘদিন কৃষি নিয়ন্ত্রণ করত। সমাজ বিকাশের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভাগের সাথে এরও অনেক কাল পরে মানুষের শ্রম বিভাজনের ঘটনা ঘটে।

কিন্তু ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে নারী সমাজের উপর নেমে আসে পুরুষের চরম আধিপত্য ও নির্মম পারিবারিক দাসত্ব। মানব সমাজ যতই সভ্যতার দিকে ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে ততই নারী সমাজের উপর দাসত্ব ও অধীনতা জঘন্যভাবে জেঁকে বসতে থাকে।

জার্মান Ideolog-তে মার্কস এবং এঙ্গেলস বলছেন, মানুষের ইতিহাসে নারী এবং পুরুষের কাজের পরিধি নিয়ে প্রথম শ্রম বিভাজনের সূত্রপাত। পাশাপাশি প্রথম যে শ্রেণি নিপীড়ন সেটাও নারী এবং পুরুষের মধ্যে। একে আখ্যায়িত করা হয়েছে First great division of labour-হিসেবে। শ্রম বিভাজনে দেখা যায়, উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারী-পুরুষের কাজ পৃথক হয়ে যায়। মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে উৎপাদন। খাওয়া-দাওয়া, সম্পদ এবং আশ্রয়ের জন্য মানুষকে উৎপাদনে যুক্ত থাকতে হয়। সমাজ বিকাশের সাথে এই উৎপাদন প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ পুরুষের হাতে চলে যায়। বলা যায়, উৎপাদন উপকরণের বিকাশের সাথে নারীর অধিকার ধীরে ধীরে খর্ব হতে থাকে।

নারী মুক্তি আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ
অতীতের তুলনায় নারীরা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আন্দোলনমুখী ও সচেতন। তা একদিনে পরিণতি লাভ করেনি। পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আহ্বান বিশ্বব্যাপী নারী কর্মীদের কাছে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে। কিন্তু, ফরাসি বিপ্লবের পরও নারীর প্রত্যাশিত মুক্তি আসেনি। ১৭৯১ সালে ফরাসি নাট্যকার ও বিপ্লবী ওলিম্পে দ্যা গগ্স (Olzmpw de Gouges) ‘নারী অধিকার এবং মহিলা নাগরিকদের ঘোষণা’ প্রকাশ করেন। এতে তিনি বলেন, নারী জেগে উঠো; গোটা বিশ্বে যুক্তির সঙ্কেত ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। তোমার অধিকারকে আবিষ্কার করো। প্রকৃতির শক্তিশালী সাম্রাজ্য এবং পক্ষপাত, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও মিথ্যা দিয়ে অবরুদ্ধ নয়। সত্যের শিখা পাপ ও অন্যায় দখলের মেঘকে দূরে করে দিয়েছে। ১৭৯৩ সালে এ নারীকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। সাথে সাথে নারীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে অসীম সাহসিকতা নিয়ে তিনি বলেন, নারীর যদি ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে, তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন?

১৮৩৭ সালে আমেরিকায় প্রথম দাসপ্রথা বিরোধী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে মার্কিন নারীরা রাজনীতি করার অধিকার ও সুযোগ পায়। ১৮৪৮ সালের ১৯-২০ জুলাই নারী অধিকারকর্মীদের উদ্যোগে নিউইয়র্কের সেনেকো ফলস এ বিশ্বের প্রথম নারীর অধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা করে। ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়।

১৮৬৯ সালে মেরী মূলার নামের এক বৃটিশ মহিলা ভোটের অধিকারের দাবিতে নারী সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রচারপত্র ছেপেছিলেন নিউজিল্যান্ডে। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৮৯৪ সালে নিউজিল্যান্ডে মেয়েদের সীমিত ভোটাধিকার দেয়া হয়। বাস্তবে তা কার্যকরী হয় ১৯২৮ সালে। এর আগে ১৮৮২ সালে বিবাহিত মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দেয়া হয়। ১৮৭৯ সালে বিখ্যাত নাট্যকার হেনরি ইবসেন এর কালজয়ী নাটক ‘পুতুলের খেলাঘর’ (The Dolls House) এর নায়িকা নোরা চরিত্রটির মাধ্যমে আধুনিক নারী চেতনা মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। অগাস্ট বেবেল এর ‘নারী: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত’ গ্রন্থটি নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিকদর্শনরূপে চিহ্নিত হয়েছে। আরেকজন বিপ্লবী নারী এ্যামেলিন প্যাংখারষ্ট ১৯০৩ সালে ভোটাধিকারের দাবিতে বিপ্লবী নারী সংগঠন গড়ে তোলেন।

বার্থা ফন সাটনার ১৮৮৯ সালে ‘তোমার অস্ত্র সমর্পন করো’ নামে একটি বই লিখেন। এই বই লেখার জন্য বার্থা ফন সাটনার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনিই নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী। নারী আন্দোলন প্রথম সংগঠিত করেন ইংল্যান্ডের মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, দার্শনিক এবং নারী অধিকারকর্মী। ১৭৯২ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ A Vindication of the Rights of Woman বা নারী অধিকারের ন্যায্যতা’ প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে তিনি বলেন, নারী কোন ভোগের সামগ্রী বা যৌন জীব নয়। তারা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তাই তাদের স্বাধিকার দিতে হবে। ১৮৪৮ সালের ১৯-২০ জুলাই নারীবাদীদের উদ্যোগে নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস-এ বিশ্বের প্রথম নারী অধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলন পরবর্তীতে আমেরিকার সংগ্রামী নারীদের লড়াই-সংগ্রামের চেতনাকে আরো ত্বরান্বিত করে। বিভিন্ন দেশে সমসাময়িক আন্দোলন ১৮৭১ সালে ফ্রান্সের শ্রমজীবী জনগণ প্রথম সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের উদ্দেশ্যে প্যারি কমিউন প্রতিষ্ঠা করেন। এ আন্দোলনে হাজার হাজার শ্রমজীবী নারীর অংশগ্রহণ প্যারি কমিউন প্রতিষ্ঠাকে নতুন গতি দেয়। প্যারি কমিউন রক্ষার্থে ১০ হাজার নারী যুদ্ধে অংশ নেয় বলে জানা যায়। পরবর্তীতে, প্যারি কমিউন পতনের পর যুদ্ধ পরিষদ ১০৫১ জন নারীকে অভিযুক্ত করে। তাদের সবাইকে গুলি করে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে লুই মিচেল এবং এলিজাবেথ ডিট্রিভের নাম ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

বাংলার প্রথম নারী সংগঠন ‘সাখ সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৮৫ সালে এবং তিনি লাঠি খেলা ও অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীর মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৮৮৯ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে ৬ জন নারী যোগদান করেন। সরোজিনী নাইডু ও সরলা দেবী চৌধুরাণী প্রমূখ নারী নেত্রীরা কংগ্রেসের সভা প্রধানের পদেও উন্নীত হন। ১৮৮৯ সালে ভারতবর্ষের প্রথম নারী মুক্তি আন্দোলনের সংগঠিত রূপকার মহারাষ্ট্রের পন্ডিত রমাবাঈ প্রকাশ্য আন্দোলনে নামেন। বাংলার প্রথম নারী মুক্তির দূত খ্যাত সরলা দেবী চৌধুরাণী ১৯১০ সালে সর্বভারতীয় নারী সংগঠন ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’ প্রতিষ্ঠিত করেন।

বাংলার নারী জাগরণের আরেক দূতের নাম বেগম রোকেয়া। তিনি একাধারে বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি বাংলার নারীর মুক্তির জন্য অনেক সংগ্রাম করেছেন। নারীদের অধিকার সচেতন করার জন্য ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন “আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলো দুঃসাহসিক কাজ। তিনি নারী জাগরণের জন্য লেখালেখিও করেন।

বাংলার নারী বিপ্লবীদের ইতিহাস লিখতে গেলে অবশ্যই বিপ্লবী প্রীতিলদা ওয়াদ্দেদার ও বিপ্লবী কল্পনা দত্তের কথা চলে আসে। যে কাজটি সেসময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পুরুষরা করে দেখার সাহস দেখাতে পারেন নি সে কাজটি সহজেই এই দুই নারী বিপ্লবী করে দেখিয়েছেন। তারা দুইজনই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের ক্লাব আক্রমণ করার সময় প্রীতিলতা নিজের প্রাণ আত্মবলিদান দেন। কল্পনা দত্ত মাস্টার দা প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ চট্টগ্রাম শাখায় যোগদান করেন। তার বিপ্লবী মনোভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলেছেন। দলের সদস্য হয়ে কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমা তৈরি করতেন। পাহাড়তলী ব্রিটিশদের ক্লাব আক্রমণের জন্য কল্পনা দত্তও দায়িত্ব পান। কিন্তু তার পূর্বেই পুরুষের ছদ্মবেশে সহকর্মী নির্মল সেনের সঙ্গে সূর্য সেনের কাছে দেখা করতে যাবার সময় পুলিশ কল্পনা দত্তকে গ্রেফতার করে। দুই মাস জেলে থাকার পর প্রমাণের অভাবে তিনি জামিনে মুক্ত হন। ১৯৩৩ সালে ১৯ মে গৈরালা গ্রামে এক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা দত্ত এবং তার সতীর্থ কয়েকজন বিপ্লবী ধরা পড়েন। ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে কল্পনা দত্ত মুক্তি পায়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সেসময়ে নিষিদ্ধ থাকা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যান। দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে চাঙ্গা করেন। সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কুলিদের পড়াতেন, মালিপাড়া, ধোপাপাড়ায় গিয়ে গোপন সভা করতেন। এভাবে তিনি তাঁর সংগ্রাম চালিয়েছিলেন।
পশ্চিমের ইতিহাসে নারীর ভোটাধিকার অর্জনের বছর হিসেবে ১৯২০ কে ধরা হলেও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নারী সর্বপ্রথম ভোটাধিকার পায়। ১৯১৭ সালে বলশেভিক পার্টি ও লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়ার নারী ভোটাধিকার পায়। পরবর্তীতে ১৯২০ সালে যখন ইউরোপ আমেরিকার নারীবাদীরা ভোটাধিকার অর্জনকে উদযাপন করছেন, ততদিনে রাশিয়ার নারী পেয়েছে গর্ভপাতের অধিকারও।

বিশ্বব্যাপী নারী মুক্তি আন্দোলনে সবচেয়ে অগ্রণী ও প্রধান ভূমিকা রেখেছে অগাস্ট বেবেল, ক্লারা জেটকিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই প্রমূখ নারীরা। তারাই সর্বপ্রথম মহান বিপ্লবী সাম্যবাদী আর্দশের প্রবক্তা কার্ল মাকর্সের নারীমুক্তির ভিত্তি রচনা করে বলেছেন শ্রেণি বৈষম্যই নারী অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ। তাই পুঁজিবাদের সমাজ উচ্ছেদ করে শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে নারী মুক্তি সম্ভব। তারা বলেছেন, নারীমুক্তি আন্দোলন পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পুুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং পুরুষতান্ত্রিক পুঁিজবাদী সামাজিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে, অন্যথায় নারী মুক্তি মিলবে না।

একজন মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দেশে দেশে উদার, গণতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন মহৎ পুরুষরাও যুক্ত হন। ১৮৬৬ সালে দার্শনিক ও আইনজ্ঞ স্টুয়ার্ট মিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য হবার পর নারীর ভোটাধিকারের পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন পার্লামেন্টে। ১৮৬৯ সালে ভোটাধিকারসহ অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি ‘নারীর অধীনতা’ রচনা করেন। সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ১৮১৮ সালে কলিকাতায় ‘সহমরণ’ বা ‘সতীদাহ’ প্রথা বিলোপের উদ্যোগ নেন। যার ফলে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মেরী ককের সঙ্গে মিলে মোট ৪৩টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তিনি বিধবা বিবাহের সপক্ষেও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৮৬৭ সাল নাগাদ নিজে ৬০টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ৮ মার্চ নারী দিবসকে সামনে রেখে ১৯৮০ সালের মার্চ মাসের ২ থেকে ৮ তারিখকে নারীর ইতিহাস সপ্তাহ ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘নারীর অবদান প্রায়শই উল্লেখ করা হয় না, চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু আজকের আমেরিকাকে গড়ে তোলার পেছনে অর্জন, নেতৃত্ব, সাহস, ভালোবাসা সবকিছুতেই নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে।’

পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ ব্যবস্থা এখনো আধা উপনিবেশিক ও ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থা। জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ১৯৬০ সালের শুরুর দিকে পাকিস্তান সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের নামে মরণফাঁদ কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে জুম্ম জনগণের আন্দোলন দানা বাঁধে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে পারিবারিক জীবনে পুরুষের আধিপত্য এবং জাতীয় জীবনে উগ্র সাম্প্রদায়িক শাসকদের চরম শাসন-শোষণের শিকার জুম্ম নারীর জীবন সংগ্রাম এম এন লারমা প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বুঝতে পারেন রাজনৈতিকভাবে সচেতনতা ছাড়া জুম্ম নারীর মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অধিকার সচেতন করে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে জাতীয় অগ্রগতি ত্বরান্বিত হতে পারে না। সত্তর দশকে জুম্ম নারীসমাজকে পুরুষদের আধিপত্য ও পারিবারিক দাসত্ব থেকে মুক্তির মহান প্রয়াসে অধিকার সচেতন করে সংগঠিত করার রাজনৈতিক প্রয়াস গড়ে ওঠে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনসহ জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জুম্ম নারীসমাজকে শামিল করার উদ্যোগ গ্রহণ শুরু হয়। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচারণার মধ্য দিয়ে জুম্ম নারীসমাজকে রাজনৈতিক সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ ও শামিল করার প্রচেষ্টা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। ফলে জুম্ম নারীদের সংগঠিত করে একটি শক্তিশালী নারী সংগঠন গঠনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে।

উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসক কর্তৃক শাসন-শোষণ আর সামন্তীয় পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী সমাজে জুম্ম জনগণের আত্ননিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তথা জুম্ম নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তথা জুম্ম নারী মুক্তির আন্দোলন জোরদার করতে ১৯৭৩ সালের শুরুতে জুম্ম নারীর সংগঠনের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে অগ্রগামী জুম্ম নারীদের নিয়ে একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলাধীন মহালছড়ি থানার অর্ন্তগত ইটছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহযোগিতায় জুম্ম নারীদের একটি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সে সমাবেশে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’ নামে জুম্ম নারীদের একটি নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ১০ আগস্ট ১৯৭৫-এ। চেঙ্গী, মাইনী, কাচালং অঞ্চল থেকে আগত মোট ৬৫ জন জুম্ম নারী এ সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে মাধবীলতা চাকমাকে সভানেত্রী, জয়শ্রী চাকমাকে সাধারণ সম্পাদিকা, দিপ্তী চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদিকা ও জড়িতা চাকমাকে সাংস্কৃতিক ও প্রচার সম্পাদক করে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির একটি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। পরে কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে মাইনী, চেঙ্গী ও কাচালং অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির ৩ (তিন)টি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয়। ক্রমান্বয়ে মহিলা সমিতির গ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। শুরু হয় জুম্ম নারীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও উগ্রজাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করে জুম্ম নারীর মুক্তির আন্দোলন।
১৯৭৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির নেতৃবৃন্দও সে আন্দোলনে যোগদান করেন। মাধবীলতা চাকমা, জয়শ্রী চাকমা, জড়িতা চাকমার নেতৃত্বে দ্বিপ্তী চাকমা, ম্রেমরাউ মারমা, এলিজাবেথ ত্রিপুরা প্রমুখসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির ৩৫ জন সদস্য ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাস সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রশিক্ষণে অংশ নেন। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণেরও দীক্ষা নেন। মহিলা সমিতির কর্মীরা সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও তাদের নানামুখী সহযোগিতা জুম্ম জাতীয় জীবনে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে মহিলা সমিতির কার্যক্রমে প্রভাব পড়ে। এতদসত্ত্বেও মহিলা সমিতি সীমিত পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকায় সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত থাকে। কেবল বিপ্লবী কর্মী গড়ে তোলা নয়, বিপ্লবী পরিবার গড়ে তোলাও তাদের মূল লক্ষ্য। মহিলা সমিতির সদস্যরা জুম্ম নারীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এবং পুরুষদের মদ-জুয়া ও অহেতুক নির্যাতনের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। মহিলা সমিতির অনেক কর্মী পার্টির সশস্ত্র আন্দোলন চলাকালে সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন অঞ্চলে অসীম সাহসিকতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

হিল উইমেন্স ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা ও আন্দোলন
১৯৮৫ বা তারও কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একঝাঁক সাহসী জুম্ম ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন শামসুন নাহার হলের কক্ষ নং ১৪ ও ১৫ বসে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন বিশেষত সরকারি, মিলিটারি ও সেটেলার কর্তৃক জুম্ম নারীদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন নিয়ে বসে আলাপ করতেন। তৎকালীন সময়ে পাহাড়ের বুকে উত্তাল পরিস্থিতির নিয়ে জনে জনে মত দিতেন। অনেক আলাপ-আলোচনার পর তারা সিদ্ধান্ত নেন জুম্ম নারীদের উপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরার জন্য ও প্রতিবাদ জানানোর জন্য আলাদা সংগঠন গড়ে তুলবেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বিথীকা চাকমা, শিলা চাকমা সহ অনেকেই। অতপর ১৯৮৮ সালে ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসের দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন শামসুন নাহার হলের ১৩ নং কক্ষে হিল উইমেন্স ফেডারেশন নামে আলাদা ও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের মার্স্টাসের ছাত্রী গৌরিকা চাকমা ও ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী শিলা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের মূল দায়িত্ব নেন। জন্মলগ্ন থেকেই হিল উইমেন্স ফেডারেশন পাহাড়ি গণ পরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পাশাপাশি গণতান্ত্রিকভাবে তার কার্যক্রম শুরু করে। তারপর মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তারা সংগঠন গড়ে তোলে। ১৯৯৫ সালের ১৫ জানুয়ারি এই সংগঠনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে গ্রামে গঞ্জে তাদের সংগঠন গড়ে উঠে। কর্মী বাহিনী সবুজ পাহাড়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে জুম্ম নারী সমাজ ও জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি সচেতন করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৯৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই সদস্য কবিতা চাকমা ও বর্তিকা চাকমার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলে যোগ দিয়ে জুম্ম নারীদের অবস্থার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। তারা বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম নারীর প্রতিনিধিত্ব করেন।

আশি-নব্বই দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে বিরাজমান কট্টর সামন্তীয় ও ধর্মভীরু সমাজে নারী সমাজের পক্ষে স্বীয় মুক্তি তথা রাজনৈতিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়ার পথ কোনভাবে মসৃণ ছিল না। একদিকে শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন আর গ্রেফতার আতঙ্ক কাজ করত, অন্যদিকে পরিবার, সমাজের চাপ ছিল প্রবল। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি গৌরিকা চাকমার সাথে আলাপকালে বলেছিলেন, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কাজ করার জন্য তাঁকে পরিবার বাড়িতে ডেকে নিয়ে করা ভাষায় শাসিয়েছিল, মেয়ে হিসেবে রাজনীতি করা যাবে না বলেও বলেছিল। মেয়েদের এসব কাজে শোভা পায় না, পড়াশুনা করা আর চাকুরী করতে তোমাকে বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে, রাজনীতি করতে নয়। রাজনীতি করতে চাইলে পরিবার থেকে সব খরচ বন্ধ করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হয়েছিল। এসবে কাজ না হলে বনভান্তের কাছে নালিশ দিয়েছিল যাতে মেয়েকে ভান্তে যেন বুঝিয়ে বলেন, মেয়ে হয়ে রাজনীতি করা মানানসই না, কেবলই পড়াশুনায় মনোযোগ দিবে। সেজন্য তাঁকে (গৌরিকা চাকমা) বনভান্তের কাছে যেতে হয়েছিল। বনভান্তেও তাকে একই কথা শুনিয়েছিলেন। সবাইকে তিনি একই উত্তর দিয়ে বলেছিলেন, আমি মেয়ে হতে পারি কিন্তু আমার জাত ভাই-বোনদের উপর অমানবিক নিপীড়ন ও নির্যাতন বসে দেখতে পারি না। আমারও দায়িত্ব আছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার। আমি সঠিক কাজটি করছি। আপনারা আমাকে শৃঙ্খলে বেঁধে রাখতে পারবেন না। শুধু গৌরিকা চাকমা নন, সেসময়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হওয়া অনেক ছাত্রী কর্মীকে পরিবার ও সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

তবুও অগ্রগামী ছাত্রী সমাজ সে বাধা ডিঙিয়ে পাহাড়ের বুকে নারী জাগরণের লড়াই জারি রেখেছিল। সে সংগঠন থেকে কল্পনা চাকমার মত বিপ্লবী নারী জন্ম নিয়েছিল। এখনো মুক্তির ঝান্ডা হাতে নিয়ে সবুজ পাহাড়ের ভাজে ভাজে দ্রোহের ফুলকি জ¦ালিয়ে রেখেছে জুম্ম নারী। কট্টর সমাজকে একহাত নিয়ে জুম্ম নারী অধিকার তথা মুক্তির জন্য যে সাহস তারা দেখিয়েছিল তা অসীম গল্পগাঁথা যা এখনো প্রত্যেকটি জুম্ম জনগণের সংগ্রামের ইতিহাসে গেঁথে থাকবে। তাদের সে সাহস ও দৃঢ়তাকে লাল সালাম।

সংগঠনের বাইরে সশস্ত্র আন্দোলনের সময় বহু জুম্ম নারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুপ্ত সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা শ্লীলতাহানি, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও জুম্ম নারীরা যুদ্ধরত যোদ্ধাদের জন্য তথ্য, চিঠিপত্র ও অন্যান্য গোপন দলিল বহনের ব্যাপারে সক্রিয় কাজ, সমর্থন ও সহযোগিতা যুগিয়েছে। তাছাড়া তারা খাদ্য সরবরাহ, আহতদের সেবাশুশ্রুষা দান ও বিনা পারিশ্রমিকে বস্ত্র তৈরি করে দেয়ার মাধ্যমে সশস্ত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সংঘাতকালীন সময়ে গ্রামাঞ্চলে জুম্ম নারীরা জনসংহতি সমিতির সদস্যদের জন্য ভাত রান্না করা, গতিবিধি গোপন রাখার জন্য ছেলে মেয়েদের বুঝানো, পথঘাট দেখানো, কাপড়-চোপড় বুনে দেয়া সহ নানাবিধ উপায়ে সহায়তা করেন। জনসংহতি সমিতির আহত সদস্যদের সেবা-শুশ্রুষা করা, বিস্ফোরক দ্রব্য বহন করে দেয়া, প্রতিপক্ষের অবস্থান জানানো ও সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বও পালন করেন।

তাই বলতে হয়, নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা তথা নারী মুক্তির যে সংগ্রাম অদ্যাবধি দেশে দেশে চলে আসছে তা কেবলমাত্র নারী সমাজের একক সংগ্রাম নয়। সমস্ত নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অধিকারহারা মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে নারী মুক্তি সংগ্রাম অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। তাই নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আন্দোলন তথা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সাথে শামিল করা ব্যতীত নারীর প্রকৃত মুক্তি অর্জন হতে পারে না। পক্ষান্তরে নারীর প্রকৃত মুক্তি ব্যতীত জাতীয় মুক্তি তথা বিশ্বের নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের মুক্তি অর্জিত হতে পারে না।

লেখক: নিপন ত্রিপুরা, সাংগঠনিক সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ