এম এন লারমা ও জুম্ম জাতীয় ঐক্য প্রসঙ্গে কিছু কথা

0
640

অসীম ঐক্যতান

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো যুগ যুগ ধরে অবহেলিত, বঞ্চিত, উপেক্ষিত ও পশ্চাদপদ ছিল। একদিকে বিজাতীয় শাসন-শোষণ ও বঞ্চনা, অপরদিকে জাতিগতভাবে সামন্ত শ্রেণির শোষণ-বঞ্চনা ও নিষ্পেষণে জাতিসত্তাগুলো প্রায় বিপন্ন অবস্থা। এহেন অবস্থায় তাদের মধ্যে অনৈক্য ও ভেদাভেদ চরমরূপে বিদ্যমান ছিল। এ ঘুঁণেধরা পশ্চাদপদ সামন্ত সমাজের নিগড়ে ঘুমন্ত ও বিপন্ন প্রায় জাতিগুলোকে নব জাতীয় চেতনায় জুম্মজাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রে দীক্ষিত, জাগরিত ও উজ্জীবিত করার জন্য জাতীয় চেতনার অগ্রদূত শ্রদ্ধেয় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা একটি বৃহত্তর জুম্ম জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভিন্ন ভাষাভাষি এগারটি জাতিসত্তা- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখোয়া, খিয়াং, ম্রো, খুমি ও চাক সবাই মিলে আমরা জুম্মজাতি পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। সেই জাতীয় জাগরণে উজ্জীবিত করে ১৯৫৭ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার উদ্যোগে জুম্ম পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে পাহাড়ী ছাত্র সমিতি গঠনের মাধ্যমে ঐক্যের প্রথম সোপান নির্মাণ করেন।

১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শুরু করলে এ বাঁধ নির্মাণের বিরোধীতা করেন এবং প্রকল্প বাতিলের দাবি সম্বলিত লিফলেট বিলি করেন এম এন লারমা। এ বাঁধের ফলে জলমগ্ন হয়ে চুয়ান্ন হাজার একর ধান্য জমি ও বাস্তুভিটা ছেড়ে গিয়ে হাজার হাজার জুম্ম পরিবার তেষট্টি ও চৌষট্টি সালে দেশে ও বিদেশে উদ্বাস্তু হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়, এতে তিনি গভীরভাবে বেদনাহত হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য যে, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বিরোধীতা ও প্রতিবাদের কারণে পাকিস্তান সরকার জননিরাপত্তা অধ্যাদেশে ১৯৬৩ সালে ১০ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ বাসা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। দুই বছরাধিক সময় করাভোগের পর ৯ মার্চ ১৯৬৫ সালে তিনি মুক্তি পান।

জেল বন্দী থেকে মুক্তির পর আবার জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নানান সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং গ্রামে-গঞ্জে সফর করে সাধারণ মানুষকে অধিকার সচেতন করেন। এভাবে সময়ের পরিক্রমায় ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের আসনে ও দক্ষিণাঞ্চলের আসনে চাথোয়াই রোয়াজা প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বি করেন। বিশিষ্ট জনদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয় এবং এলাকায় এলাকায় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে বিপুল উৎসাহের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হয়। এভাবে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ভোটারগণ তাদের মূল্যবান ভোট প্রদানের মাধ্যমে উভয়েই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠিত হয়। এমএন লারমা গণপরিষদের সদস্য হন। তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ও গণপরিষদের অধিবেশনে চারদফা সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু ঘৃণাভরে সেই দাবি প্রত্যাখাত হয়। বিফল মনোরথে তিনি অধিবেশন থেকে ভারাক্রান্ত মনে ফিরে এসে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সাল তার উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করা হয়। এতে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আবারও পার্বত্য চট্টগ্রামের উভয় অঞ্চল থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও দক্ষিণ অঞ্চল থেকে চাথোয়াই রোয়াজা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ নিয়ে সারাদেশের মানুষ যেভাবে স্বত:ফুর্ততার সাথে ভোটদানে অংশগ্রহণ করে, ঠিক তেমনিভাবে এমনকি আরও অধিক উৎসাহের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করে তাদের মনোনীত প্রার্থীদ্বয়কে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতায় জয়যুক্ত করে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম পাহাড়ী মানুষ বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হতে থাকে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, একলা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম পাহাড়ী মানুষ অধিকাংশ জুম কৃষিচাষের উপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক কারণে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে ভবঘুরে জীবপ-যাপনে অভ্যস্ত ছিল। তার উপর শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অবহেলা, বঞ্চনা, ভোদাভেদ-বৈষম্য, নিপীড়ন-নির্যাতন ও শাসন-শোষণ এবং ভাগ কর শাসন কর নীতির ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠতে পারেনি। এমনতর পরিস্থিতি প্রেক্ষাপটে এমএন লারমা তাঁর একের পর এক নানান কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জুম্ম জাতীয় ঐক্যের একমাত্র আলোকবর্তিকা হয়ে প্রজ্জলিত হয়ে উঠেন। একদিকে জাতীয় সংসদে জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের গণমানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিনিধিত্ব করা, অপরদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা রূপে সমগ্র দেশের আপামর নিপীড়িত, বঞ্চিত, দুঃখী মেহনতি মানুষের অধিকারের জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা, তারপক্ষে যেন উগ্রবাঙালি জাতীয়তাবাদের কুলকিনারাবিহীন জনসমুদ্রে সাঁতার কাটার সামিল হয়েছিল।

এমতাবস্থার প্রেক্ষিতে যতদিন যায়, তিনি আরও গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম পাহাড়ী মানুষের মৌলিক অধিকার বা সাংবিধানিক অধিকার নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জাতীয় সংসদে গণপ্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব নয়। তাই তিনি একটি অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার কথা মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছিলেন। সেভাবে তিনি একটি সময় সংসদের ভিতরে থেকে অতি গোপনে সশস্ত্র আন্দোলন-সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।

১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার গোপন নির্দেশনায় তার অনুজ জ্যেতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীকে সুসংগত ও সুসংঘবদ্ধ করে একটি সুশৃঙ্খল ও চৌকষ গণবাহিনীতে উন্নীত করেন। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল প্রকার পথ রুদ্ধ হলে জুম্ম জনগণ সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয় এবং ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হয়। এভাবে দিনের পর দিন একের পর এক আক্রমণ জোরদার হতে থাকে। ফলে সরকার আন্দোলন দমনের নামে নানান অপকৌশল অবলম্বন করে। শুরু হয় ঘরবাড়ি জ্বালাও-পোড়াও, গ্রেপ্তার, জেল-জুলুম ও নানান অবর্ণনীয় অত্যাচার-উৎপীড়ন। তাসত্বেও আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সরকার নানান ধরনের ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করেও জুম্ম জনগণের মধ্যে বড় ধরনের বিভেদ ও ফাটল সৃষ্টি করতে পারেনি।

বলাবাহুল্য যে, ১৯৮৩ সালে গৃহযুদ্ধের আগ পর্যন্ত একটানা ছয়-সাতটি বছর সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অদম্য লড়াই চলে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে, ১৯৮৩ সালে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের খপ্পরে পড়ে পার্টির মধ্যে লুকিয়ে থাকা কতিপয় অদূরদর্শী, নীতি-আদর্শহীন, ক্ষমতালোভী, উচ্চাভিলাসী, সুবিধাবাদী ও চরম স্বার্থপর নেতা-কর্মী জাতির কুলাঙ্গার বিভেদপন্থী প্রীতি-গিরি-দেবেন-পলাশ চক্র পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে পুরো জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করে এক বিভীষিকাময় গৃহযুদ্ধের সূচনা হলে জুম্মজাতি এক চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। জাতির কুলাঙ্গার, বেইমান ও বিশ্বাসঘাতক বিভেদপন্থীরা ১৯৮৩ সালের প্রথমার্ধে পার্টির ক্যাচে করা মজুদকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্যাচে হাউস থেকে চুরি করে হেফাজতে বা দখলে নিয়ে লুকিয়ে রাখতে শুরু করে এবং কর্মীদের মধ্যে নানান বিভ্রান্তিকর প্রচারনা করে পুরো পরিস্থিতি ঘোলাতে করতে থাকে। এমনকি পার্টির সুপ্রীমো শ্রদ্ধেয় এমএন লারমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের ন্যাক্কারজনক মিথ্যা-বানোয়াট অপপ্রচার শুরু করে। এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের লোকজনকে জিম্মি করে বন্দীদশায় গালিগালাজ, শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনসহ নানা অবান্তর ও অযৌক্তিক শর্ত দিয়ে পার্টিকে চাপে ফেলে তাদের হীন উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেষ্টা চালায়। এভাবে যত দিন যাচ্ছিল পাল্টপাল্টি নানা ঘটন-অঘটন ঘটে যাচ্ছিল এবং এমন ক্ষণে একদিন ‘৮৩ সালের ১৪ জুন বিভেদপন্থীদের সাথে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়, তখন যেন জুম্ম জাতীয় জীবনে এক কালো মেঘের ঘনঘটা নেমে আসে।

এ অনাকাঙ্খিত ও অবাঞ্ছিত ভ্রাতিঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য শ্রদ্ধেয় এমএন লারমা সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ও সহনশীলতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কর্মীবাহিনীকে আহ্বান জানান। সেইসাথে তিনি বিভেদপন্থীদের উদ্দেশ্য করে ‘ক্ষমা করা, ভুলে যাওয়া নীতির’ ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। অপরিসীম ধৈর্য্য ও সহনশীলতায় অনেক প্রচেষ্টার পর এক পর্যায়ে বিভেদপন্থীদের সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সংঘাত বন্ধ করে উভয়পক্ষ ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। কিন্তু কয়েক দিন-মাস যেতে না যেতেই বিভেদপন্থীরা ‘৮৩ সালের ১০ নভেম্বর রাতের গভীরে অতর্কিত এক প্রচণ্ড আক্রমনে জুম্মজাতীয় জাগরণের অগ্রদূত পার্টির সভাপতি, সুপ্রীমো মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সহ আটজন বিশিষ্ট সহযোদ্ধাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে এক চরম বেইমানী ও বিশ্বাসঘাতকতা করে মীরজাফরের ভূমিকায় জুম্ম জাতীয় ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা করে। এতে পার্টির কর্মীবাহিনী ও ব্যাপক জনগণ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা ও দেশপ্রেমিক সহযোদ্ধাদের হারিয়ে দারুন শোকে ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফলে একদিকে নেতাকে হারিয়ে চরম হতাশা-নিরাশা এবং অপরদিকে প্রতিশোধের আগুনে দাউ দাউ জ্বলে ফুঁসে উঠে। ক্ষিপ্ত, উন্মত্ত, উদ্দীপ্ত কর্মীবাহিনী এবং জনগণ বিভেদপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।

এমতাবস্থায় চরম বিপর্যয়ের মুহুর্তে পার্টির সভাপতি প্রিয় নেতাসহ আপন দুই সহোদর ভাই ও একঝাঁক নেতাকর্মী হারানোর বেদনা শোকে আপ্লুত হয়েও কঠিন হৃদয়ে এক দৃঢ় বলিষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্টি তথা জুম্মজাতিকে নতুন দিশা ও নেতৃত্ব দানের জন্য নিজ কাঁধে পার্টির সর্বময় দায়িত্বভার তুলে নিলেন আমাদের বর্তমান প্রিয়নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। এ অনাকাঙ্খিত ও অবাঞ্ছিত গৃহযুদ্ধ অবসানের জন্য পার্টি কর্মীবাহিনীকে নির্ভীক ও দৃঢ়চিত্তে অকুতোভয়ে লড়াই শুরু করার নির্দেশ জারী করলেন এবং এ লড়াইয়ে আপামর জুম্মজনগণের ঐকান্তিক সহযোগিতার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। শুরু হয় তীব্র লড়াই, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত অনেক প্রাণহানি ঘটে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠে। জাতির মধ্যে পরস্পর সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দেয়। চারিদিকে জনমনে চরম অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করতে থাকে। একদিকে ভাইয়ে ভাইয়ে নৃশংস যুদ্ধ। অপরদিকে সরকারি সশস্ত্রবাহিনী নিরীহ জনগণের উপর মারধর, গ্রেপ্তার, জেল-জুলুম, হত্যা, গুম, নারীর উপর ধর্ষণ, ঘর-বাড়ী জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি দমন-পীড়নে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। এমনিতর অবস্থায় জাতি দিশাহীন ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তবুও লড়াই অব্যাহতভাবে চলতে থাকে দীর্ঘ প্রায় তিনটি বছর তুমুল লড়াইয়ের পর অবশেষে বিভেদপন্থীরা হটে গিয়ে অসহায় ও নিরুপায় হয়ে সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় একটি অংশ সরকারের কাছে ও আরেকটি অংশ আমাদের পার্টির নিকট আত্মসমর্পণ করে নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়লে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে।

উল্লেখ্য যে, গৃহযুদ্ধ অবসানের পর কর্মীবাহিনীর মধ্যে ও জনগণের মধ্যে এক বিরাট স্বস্তি ও ব্যাপক আনন্দ-উল্লাস দেখা দেয়। পার্টির নেতা ও নেতৃত্ব এক অগ্নি পরীক্ষায় পরিক্ষীত হয়ে উঠে। ফলে গোটা রাজ্যের জুম্মজনগণ পার্টি নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে তাদের পূর্ণসমর্থন যুগিয়ে চলে। পার্টি ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং জুম্মজাতীয় ঐক্য অধিকতর সুদৃঢ় হয়ে উঠে। ফলে পার্টি আবারও শাসক সরকারের বিরুদ্ধে তথা তার লেলিয়ে দেওয়া সেনাবাহিনীর উপর হামলাসহ আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করে। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বার বার শান্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমনের মুখে পড়ে সাহস ও মনোবল হারিয়ে ফেলে বিপর্যস্ত হয়ে উঠে। এভাবে দীর্ঘ লড়াইয়ে উপর্যুপরি গেরিলা আক্রমনে সেনাবাহিনী যুদ্ধ ময়দানে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

লড়াইয়ে এক পর্যায়ে রণক্লান্ত ও বিপর্যস্ত প্রায় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের মধ্যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মীলন ঘটে এবং শাসকগোষ্ঠী সরকারেরও শুভবুদ্ধির উদয় হয়। তারা অন্তত এটুকু বুঝতে সক্ষম হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সশস্ত্র উপায়ে দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিকভাবে স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের জন্য বিভিন্ন সরকারের আমলে দফায় দফায় উদ্যোগ চলতে থাকে। কখনো সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধির সাথে কখনো বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সাথে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক চলে। আমাদের পার্টি পক্ষ থেকে ১৯৯২ সালের ১০ মার্চ একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। সেই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকে এবং একের পর এক সংলাপ চলতে থাকে। উল্লেখ্য যে, সকল বৈঠকের ফলাফল ইতিবাচক না হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পালা-বদলে বিভিন্ন দলীয় সরকারের সাথে বৈঠকের ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেসেই সরকারের শাসনামলে দীর্ঘ সংলাপের মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত ও সম্পাদিত হয়।

এ পার্বত্য চুক্তি দেশবাসীসহ পৃথিবীর নানা দেশে প্রশংসিত ও ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে এক শান্তির বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে এবং এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। যে কারণে বাংলাদেশ সরকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কো শান্তি পুরষ্কার লাভ করেছেন। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে, দীর্ঘ চব্বিশটি বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে তবুও এ চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হতে পারছেনা সরকারের নানান ধরনের গড়িমসি, ষড়যন্ত্র ও অসদিচ্ছার কারণে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বিশেষত চুক্তির প্রথম পর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সরকারের বিশেষ মহলের মদদে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ-এর সৃষ্টি, উত্থান ও তার যে বাড়-বাড়ন্ত কার্যকলাপ অবাধে চলতে দেওয়া সরকারের এক দুরভিসন্ধিরই বহি:প্রকাশ এবং চুক্তি বাস্তবায়নে অসদিচ্ছারই প্রতিফলন বৈ কিছু নয়।

পার্বত্য চুক্তির সাথে সাথে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর চুক্তিবিরোধী ইউপিডিফ-এর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের মধ্যদিয়ে চুক্তিবিরোধী সংগঠনের যতটুকু না গণতান্ত্রিক তার চেয়ে কয়েকগুণে অগণতান্ত্রিক সশস্ত্র কার্যকলাপ শুরু হয়। চুক্তিপক্ষের কর্মীবাহিনীর উপর ও চুক্তি সমর্থকের উপর হামলা, অপহরণ, হত্যা, চাঁদাবাজি, পণবন্দী তথা মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি অপকর্ম চালিয়ে চুক্তিবাস্তবায়নে চরম বাধা সৃষ্টি করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নানা কর্মসূচীতে বিরোধীতা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবেশ নষ্ট করে। এতদসত্তে¡ও সরকার চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ’কে নিবৃত্ত করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং গোপন মদদে চুক্তিপক্ষের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক কাজে ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচীতে নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে বারবার। দীর্ঘ সময় তারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের শ্লোগান তুলে আন্দোলন-সংগ্রামের নামে চুক্তিবিরোধীতা করে চুক্তিবিরোধী নানান অপপ্রচার চালিয়ে মিথ্যা-বানোয়াট বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে জনসাধারকে বিভ্রান্ত করে তুলে এবং জনসাধারণ দ্বিধা-বিভক্ত করে, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করে। বিশেষত ছাত্র-যুব সমাজের একটি অংশকে নতুন যুগের নতুন আন্দোলন, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ইত্যাদি নামে রোমান্টিকতায় ভরপুর বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে উন্মত্ত ও বিভ্রান্ত করে চুক্তিবিরোধী অপকর্মে লিপ্ত করে নতুন প্রজন্মের একটি অংশকে তথাকথিত বিপ্লবী উন্মাদনায় আত্মনিবেদন করার মিথ্যা প্ররোরচনায় দিকভ্রান্ত করে জাতি ধ্বংসের কার্যক্রম অবলীলাক্রমে চলতে থাকে একটানা দীর্ঘ একটি সময়। বিশেষত চুক্তিপক্ষের কর্মীবাহিনী, সমর্থক ও সহযোগী জনগণের উপর যখন মারধর, হামলা, হত্যা, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি, পণবন্দী, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি অপকর্ম বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন কর্মীবাহিনী ও চুক্তি সমর্থক মিলে আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং চুক্তিবিরোধীদের প্রতিহত ও মোকাবিলা করার লড়াই জোরদার হয়ে উঠে, পাল্টাপাল্টি প্রতিরোধ মোকাবিলায় শতশত মানুষের তাজা প্রাণ ঝরে। অনেক মা-বাবা সন্তান হারা, মা-বোন স্বামী হারা, ভাই-বোন ভাই হারা এবং এমনকি অসংখ্য পিতৃহারা হয় সন্তান। এমনতর নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত জীবন নিয়ে জুম্মজাতি এক চরম দুর্দশার মাঝে কালাতিপাত করছে।

এমন সময়ে যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। ২০০৭ সালের ১/১১ সারা দেশে ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। রাষ্ট্র তথা সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার, বিরাজনীতিকরণ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তথাকথিত “টু মাইনাস ফরমূলা সংস্কারের শ্লোগান” চারিদিকে তুঙ্গে উঠে এবং প্রথমদিকে দেশবাসীর কাছে সংস্কারের শ্লোগান যথেষ্ট হট কেক হিসেবে দেখা দেয়। খুবই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। কিন্তু যতই দিন গড়িয়ে যাচ্ছিল, ততই সেনামদদপুষ্ট ফখরুদ্দীন সরকারের মুখোশ ও দুরভিসন্ধি স্পষ্ট হয়ে উঠে। জরুরী আইনের বদৌলতে সকল রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম, সকল প্রকার সভা-সমাবেশ, মিছিল, মিটিং নিষিদ্ধ ছিল।

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতির সুপ্রীমো ও অবিসংবাদিত নেতা সন্তু লারমাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় ১/১১-এর কুশীলবরা। ইত্যবসরে আবার জনসংহতি সমিতির মধ্যে ভাঙন শুরু হয় এবং সরকারের সংস্কারের শ্লোগানের আবহে পার্টির কতিপয় নীতি-আদর্শচ্যুত, সুবিধাবাদী, স্বার্থপর, একগুঁয়ে, একরোখা ও ক্ষমতালোভী নেতাকর্মী পার্টি নেতৃত্বের মধ্যেও সংস্কার প্রয়োজন দাবী তুলে এবং তথাকথিত সংস্কারের জিগির তুলে একধরনের সস্তায় কর্মীবাহিনী ও জনগণের মধ্যে সমর্থন আদায়ের অপচেষ্টা শুরু করে। ফলে একদিকে জরুরী আইনের ধকল সরকারের তথা ডিজিএফআই সহ নানা গোয়েন্ডা বাহিনী, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার মিলে যৌথবাহিনীর নানা অপতৎপরতা, পার্টি কমীদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার, জেল-জুলুম ও নানা ধরনের হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড জোরদার হতে থাকে। অপরদিকে সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সেনা ও গোয়েন্দাবাহিনীর গোপন ইন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও তার নেতাকর্মীদের নিস্ক্রিয় ও নির্মূল করার জন্য ষড়যন্ত্রের আরেক নতুন ধাপ জনসংহতি সমিতির বিচ্যুত অংশকে হাতে নিয়ে একটি বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির উত্থান ঘটিয়ে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে যে চুক্তি বাস্তবায়নসহ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রাম তা বানচাল করে দিয়ে জুম্মজাতিকে চিরতরে ধ্বংস করার পায়তারা শুরু করে। দিঘীনালায় ঘোষণার মধ্য দিযে পার্টির ক্ষুদে দলবাদী সংস্কারপন্থী রূপায়ন, সুধাসিন্ধু, চন্দ্রশেখর ও তাতিন্দ্রলাল গং এর নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(এম এন লারমা) নামে তথাকথিত একটি (ভগ্নাংশ) পার্টির জন্ম হয়।

বাহ! সরকারের বিশেষ মহলের কি চমৎকার! চাতুরিপূর্ণ আয়োজন! কিষে তাদের দিবাস্বপ্ন! পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দুই বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তিকে এক করে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে জনসংহতি সমিতিকে বাজিমাৎ করে, জুম্ম জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রাম ধ্বংস করে দিয়ে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার মহাযজ্ঞ শুরু করে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির সাহসী, যোগ্য, বলিষ্ট ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ, ক্ষুদেদলবাদী সংস্কারপন্থী ও সরকারের হীন উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনি। কারণ সরকারের বিশেষ মহলের উদ্যোগে দুই প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনের তথাকথিত সমঝোতা এক সময়ে বালির বাঁধে পরিণত হয়। তাই জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের প্রতিরোধের প্রবল স্রোতে বাঁধ ভেঙে যেতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের মধ্যে নানা স্বার্থগত মতপার্থক্য ও ভুল বুঝাবুঝিতে ভাঙ্গন দেখা দেয়। তাদের সম্পর্কে ছিড় ধরে এখন উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে যার যার অবস্থান করছে।

অবস্থাদৃষ্টে আর বুঝার বাকী নেই, সবচেয়ে ক্ষুদেদলবাদী সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-দের নির্লজ্জ পেহায়াপনা, দালালীপনা ও আদর্শহীনতার কারণে একের পর এক পতন শুরু হতে দেরি হয়নি। জুম্মজাতির গভীর মর্মবেদনাহত হৃদয়ের অভিসম্পাতে- নেতা নয়, কর্মী নয়, জাতির কুলাঙ্গার চন্দ্রশেখর, সুধাসিন্ধু, তাতিন্দ্রলাল সহ আরো অনেকে দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিপতিত হয়েছে। পৃথিবী যে তাদের অন্যায়, অবিচার ও পাপের ভার সইতে পারছিল না। আর জুম্মজাতি তাদের ঘৃণ্য ও নারকীয় কর্মযজ্ঞের হাত থেকে পরিত্রান পেতে চায়, এমনতর অবস্থা! তাদের অনুগামী-অনুসারী, অনুচরদের পরিণতি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে তা অনিবার্য। শুধু কালপূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায়। যুগে যুগে জাতীয় বেইমান ও বিশ্বাসঘাতকরা বরাবরই বহুরূপী, ছলনা ও প্রতারণাময় চরিত্র গ্রহণ করে থাকে। এদের কাছ থেকে জাতি কি আশা করতে পারে? ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে তারা বেইমান ও বিশ্বাসঘাতক রূপে মীরজাফরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং হবেই। তাহলে এটা আমাদের বরাবরই স্মরণ রাখা উচিত যে, নীতি-আদর্শহীন ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যবিহীন কোন ব্যক্তি, সংগঠনের সাথে কখনো সমঝোতা ও আপোষ মীমাংসা হতে পারেনা। এটা একটি নির্ভুল প্রকৃষ্ট উদাহরণ যে, আমাদের জুম্ম জাতির প্রাণপ্রিয় অবিসংবাদিত নেতা এম এন লারমা চার কুচক্রী বিভেদপন্থীদের সাথে “ক্ষমা করা, ভুলে যাওয়া নীতির” ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে না হতেই ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর সেই বিভেদপন্থী জাতীয় বেইমান ও বিশ্বাসঘাতকের হাতে নিজের জীবন আত্মহুতি দিয়ে সেই নির্ভুল ও সত্য তত্ত্বটি প্রমাণ করে গেছেন।

তাই আজ মহান নেতা এম এন লারমার মহাপ্রয়াণ দিবসে জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন- আমরা ঐক্য চাই, সমঝোতা চাই, কিন্তু কার সাথে সমঝোতা ও ঐক্য? আপনারা জানেন যে, এলজেব্রার সূত্রমতে প্লাস+প্লাস= প্লাস, প্লাস-মাইনাস = মাইনাস, মাইনাস+মাইনাস = প্লাস। তাহলে ঐক্য মানে যোগ, সুতরাং যোগসূত্রমতে প্লাস+প্লাস= প্লাস। তাহলে উপ বা বিচ্যুত মানে- বিয়োগ বা মাইনাস। কাজেই প্লাস+মাইনাস= মাইনাসই, কখনো প্লাস বা যোগ হতে পারেনা। সুতরাং যোগবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ হতে হলে প্লাস+প্লাস=প্লাসই হতে হবে। তাহলে বস্তুত ঐক্যের মূলসূত্র মতে, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচ্যুত, বিভক্ত বা উপদলসমূহ জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে একই নীতি-আদর্শ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে এক ও অভিন্ন হয়ে চিন্তাধারার ঐক্য ও কর্মসূচীগত ঐক্য গড়ে তুলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঐক্যের মূলসূত্র অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রাম সামিল হই এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল করি ও জাতিকে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করি। পরিশেষে প্রয়াত এমএন লারমাসহ সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও লাল সালাম।