এইচডব্লিউএফ রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির ১৩তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল সম্পন্ন

হিল ভয়েস, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, রাঙ্গামাটি: আজ বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) “সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ইস্পাত-দৃঢ় জুম্ম জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি, জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে নারী সমাজ বৃহত্তর আন্দোলনে অধিকতর সামিল হোন” স্লোগানকে সামনে রেখে রাঙ্গামাটি সদরস্থ উদ্যোগ রিসোর্স সেন্টার হল রুমে হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির ১৩তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।

উক্ত সম্মেলন ও কাউন্সিলে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ছাত্র বিষয়ক সহ-সম্পাদক জুয়েল চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশিকা চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক উলিসিং মারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুবসমিতি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি জিকো চাকমা প্রমুখ।

সম্মেলনে জুয়েল চাকমা বলেন, আমরা যদি পরিবর্তন হতে চাই তাহলে প্রথমে আমাদের নিজেদেরকে দক্ষ হতে হবে। তারপরেই পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে সহজ হবে। আদিম সাম্যবাদ যুগে নারীরা সমঅধিকার ভোগ করত। উৎপাদন থেকে শুরু করে বিজ্ঞান অগ্রগতির পেছনে নারীদের অবদান ছিল অসীম। আজকে যে সারা পৃথিবীতে কাজের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট হওয়া এখানেও নারীদের ভূমিকা রয়েছে। তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সত্তর-আশির দশকে সামন্তীয় সমাজের নানা গোঁড়ামিকে উপেক্ষা করে, সমাজে শাসন-শোষণ এবং অশিক্ষিত ও কুসংস্কার আচ্ছন্ন সমাজকে উপেক্ষা করে অধিকার আদায়ে সংগ্রামে নারীদের ভূমিকাও অপরিহার্য রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আজকে নারীদের রাজনৈতিক বিমুখতা সেটার জন্য অনেক কারণ চিহ্নিত করা যায়। নারী সমাজকে পশ্চাৎপদভাবে ফেলে রাখা হয়েছে সে কারণে নারীরা রাজনীতি বিমুখ, প্রগতিবিমুখ এবং তারা নারীর মুক্তিতে বিশ্বাসী নয়। পাহাড়ে রাষ্ট্র ভয়ের সংস্কৃতি জিইয়ে রেখেছে, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী বলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। যার কারণে কেবলই নারী সমাজ নয়, পুরো প্রজন্ম অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে যথাযথভাবে সচেতন হতে পারছে না।

জুয়েল চাকমা আরো বলেন, রাষ্ট্র চায় আমরা চিন্তা-চেতনায় পিছিয়ে থাকি, তারা চায় আমরা অধিকার বিমুখ হই, তারা চায় আমরা হতাশায় নিমজ্জিত থাকি। সেকারণে তারা এখানে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে যে পরিবেশ আমাদের ভাবতে দেয়না, চিন্তা করতে দেয়না। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে জুম্ম নারীদের সৎসাহসের সাথে এইসব বাধা অতিক্রম করে জুম্ম জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে।

আশিকা চাকমা বলেন, যুগে যুগে সমাজ যখনি পরিবর্তন হয়েছে তখনি নারীদের অধিকারের জন্য করতে হয়েছে এক অদম্য লড়াই। যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সীমাবদ্ধতার সাথে সংগ্রাম করে জয় করতে হয়েছে বিশ্বকে। বলা যায় যত বেশি নারী সচেতন ততবেশি প্রগতিশীল সমাজ তৈরি হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও দেশে নারীর অর্জন ও অবদানকে এখনো যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।

তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক বৈষম্য ও সুযোগের অভাব নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে এখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পিতৃতন্ত্রের শিকার বাংলাদেশের নারীরা। সেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীরা আরো বেশি প্রান্তিক। কাজেই নারীদের প্রান্তিক অবস্থান এর সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে এবং বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হতে হবে।

উলিসিং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীসমাজ একদিকে বিজাতীয় শাসন-শোষণ অপরদিকে সামন্ত চিন্তাধারার সমাজের শাসন-শোষণের শিকার। তাই বর্তমানে জুম্ম নারীদের মধ্যে রাজনীতি বিমুখতা লক্ষ্য করা যায়। সেজন্য এইচডব্লিউএফ যেহেতু জুম্ম নারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন তাই এইচডব্লিউএফের সকল নেতাকর্মীদের আরো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে দক্ষ হয়ে ওঠতে হবে। প্রান্তিক জুম্ম নারী সমাজের কাছে পৌঁছাতে হবে।

তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ ২৪ বছরেরও অধিক রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয় নি। সুতরাং চুক্তিকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী সমাজ তথা সমগ্র জুম্ম জণগণের ঐক্য সুদৃঢ় করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন জোরদার করতে হবে।

সুমিত্র চাকমা বলেন, যুগে যুগে সমাজ পরিবর্তনে নারীদের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আজকে আমাদের ঠিকে থাকার সংগ্রামের মধ্যেও নারী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একদিকে বিজাতীয় শাসন আরেক দিকে সামাজিক নিপীড়ন এই দুইটি বাধা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে নারীদেরকে । আমরা এখনো উপনিবেশিক শাসনের স্টীমরোলারে পিষ্ট রয়েছি, ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকেরা ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত মানুষের উপর শোষণ আর জুম্মদের মনে যে ভয়ের সংস্কৃতি বীজ বপন করে গিয়েছিলো সেই একই প্রক্রিয়া পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে চলমান রেখেছে।

তিনি আরো বলেন, চুক্তি পূর্ববর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বাস্তবতা বিরাজমান ছিল তা এখনো বিদ্যমান। আর এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে ভয়ের সংস্কৃতি থেকে আমাদের তরুণ জুম্ম নারী সমাজকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে এবং লড়াই সংগ্রামে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে নিয়োজিত করতে হবে।

জিকো চাকমা বলেন, বর্তমান সময়ে বিশ্ব জগতে অনেকাংশে নারীদের নেতৃত্ব অবস্থান দেখা যায় কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস্তবতা ভিন্নরূপ। পাহাড়ের সমাজ ব্যবস্থা এখনো সামন্তীয় ঘুণেধরা। যেখানে নারীদেরকে দমিয়ে রাখা হয়, তাদের মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতাতে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। ফলে অনেক নারী অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেও একটা ভয়ের দ্বিধায় ভুগে। জুম্ম জনগণের যে চাওয়া, তার বিপরীতে শাসকগোষ্ঠীর চাওয়ার মধ্যে রয়েছে বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্যের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে আমাদের বিজয় হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে আমাদের তরুণ সমাজের পাশাপাশি নারীদের অবস্থান আভ্যন্তরীণ ভিত্তির উপর। যার জন্য নারীদের রাজনৈতিক সচেতন হতে হবে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙ্গামাটি জেলার বিদায়ী কমিটির সহ-সভাপতি কবিতা চাকমা সভাপতিত্বে এবং বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমা সঞ্চালনায় উক্ত সম্মলেন ও কাউন্সিলে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন কাঞ্চনমালা চাকমা।

সম্মেলন অধিবেশন শেষে কবিতা চাকমাকে সভাপতি, এলি চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক এবং কাঞ্চনমালা চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে এইচডব্লিউএফ রাঙ্গামাটি জেলার ১৩তম কমিটি গঠন করা হয়।

নবনির্বাচিত কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা।

More From Author

+ There are no comments

Add yours