ইউপিডিএফ কর্তৃক অপহরণ হওয়া আমি এবং আমার এক সহযোদ্ধা

কাঞ্চনা চাকমা

চলমান বছরের অনুরূপ গত বছরও এই দিনে অর্থাৎ ৬ আগস্ট ২০২৪ কিছুটা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। তার আগের দিন ৫ আগস্ট ২০২৪ এক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে এবং সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সমগ্র দেশজুড়ে তখনও তোলপাড়, অস্থিরতা চলছে। এমন সময় রাতে এক গোপনীয় সুত্রে জানা যায়, পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ’ এর সাথে যোগাসাজশ করে পিসিজেএসএস ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপর হামলার পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’কে প্রস্তাব দেওয়া হয় জেলা পরিষদ এবং দীপংকর তালুকদারের বাসভবন দখল করা এবং আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) স্যারের বাসভবন ঘেরাও করে হাসিনার মতো পালিয়ে যেতে বাধ্য করা। যদিও বিএনপি তাদের কর্মকান্ডের অবস্থা জেনে তাদের হীন প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করে বলে জানা যায়।

সকাল হলো পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে। কিছুটা রোদ, আবার কিছুটা মেঘলা। এর পরপরেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে শুভাকাঙ্ক্ষীদের খবর আসা শুরু হয় যে, ইউপিডিএফরা তাদেরকে হুমকি দিচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক বাড়ি থেকে একজন সমাবেশে যেতে হবে, না গেলে ১ (এক) কেজি হাঙ্গর মাছ, পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা এবং একটি কোদাল নিয়ে তাদের কাছে হাজির হতে হবে।

ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের বাসভবনে হামলা এবং লাশ ফেলানোর পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে দেশীয় অস্ত্র, ইট, গুলতি, লাঠিসোটা নিয়ে অস্ত্রের মুখে ও জোরপূর্বক রাঙ্গামাটি জেলাস্থ কাউখালী, ঘাগড়া, কুতুকছড়ি, সাপছড়ি, নান্যাচর, বন্ধুকভাঙ্গা প্রভৃতি এলাকা থেকে কয়েক হাজার সাধারণ জনগণকে নিয়ে আসে।

পরে রাঙ্গামাটি শহরে স্থিতিশীলতা রক্ষা ও জুম্ম জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুইটি টিম নিয়ে আমরা স্ব স্ব এলাকায় শৃঙ্খলার সহিত তাদেরকে থামানোর জন্য অবস্থান নিই, কেননা রাঙ্গামাটিতে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে। সেটেলার বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত করার সুযোগ নিতে পারে। এমনিতেই পরিস্থিতি টালমাটাল অবস্থা।

এরপর সকাল ৯ ঘটিকায় আমরা ২৫ জন গেলাম শিমুলতলী, রাঙ্গামাটি বেতার কেন্দ্র নামক স্থানে। আনুমানিক বিকাল ৩ ঘটিকায়, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমরা ভেবে নিয়েছিলাম তারা আর আসবে না। ঠিক যে মূহূর্তে আমরা ফেরত আসার কথা ভাবছিলাম এমনই সময় নানা উস্কানিমূলক শ্লোগান দিয়ে ২৫ থেকে ২৬টি গাড়ি এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। সেখানে ২০ থেকে ৩০ জন ইউপিডিএফের কর্মী বাদে অন্য সব লোকজন সাধারণ জুমচাষী। যাদেরকে জোরপূর্বক ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। অত:পর এসেই আমরা তাদেরকে থামতে বলি। তাদের সাথে কথা হয় অনেকক্ষণ। একপর্যায়ে আমাদের পক্ষ থেকে নমনীয়ভাবে বুঝিয়ে বলা হয়, আপনারা যেতে পারবেন না, যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে যান। আমরা চাইনা ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি হোক এখানে। পরে তারাও মেনে নেয় যে, চলে যাবে নিজের স্থানে। কিন্তু এমন সময়ে সেনাবাহিনীর দুইটি গাড়ি সেখানে চলে আসে। তারপর ইউপিডিএফ কর্মীদেরকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের সাথে কথা বলে। কথা বলার পরপরই ইউপিডিএফ নেতাকর্মীদের মত পাল্টে যায় এবং তারা আমাদের সাথে তর্ক করতে শুরু করে যে, তারা রাঙ্গামাটিতে সমাবেশ করবে, কার সাহস তাদেরকে আটকানো।

পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হই। কেননা সেনাবাহিনী সদস্যরা তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যাবে এমন খবর আমাদের জানানো হয়েছিল । পরে যখন তারা যাচ্ছে তখন ভিডিও কল করে বলছে, দেখেন, আমরা ওদের জায়গায় এসে দখল করেছি, কিচ্ছু করতে পারছে না, কুকুরের মতো দাঁড়িয়ে আছে (হুগুরো সান্নে দাড়েই আগনদে শুয়োরো চগুন), আরো অনেক উস্কানিমূলক কথাবর্তা।

এরপর সেনাবাহিনীর গাড়িগুলো আগে চলে যায়, আর ইউপিডিএফদের গাড়িগুলো একটু সামনে গিয়ে থামে এবং আমাদের উপর হঠাৎ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা শুরু করে। যাকে পেয়েছে তাকেই মারছে, সে ছেলে হোক বা মেয়ে। তাদের মধ্যে আমি একজন গণপিটুনির শিকার।
২০-৩০ জন ইউপিডিএফের পুরুষ সন্ত্রাসী জনসমক্ষে ইট, লাঠি, ধারালো অস্ত্র দিয়ে বেধড়ক আঘাত করে। এসময় সন্ত্রাসীরা পাশবিক কায়দায় পেটে, পাছায়, বুকে পা দিয়ে আঘাত করে, এমনকি পরিধান করা কাপড় খুলে দিয়ে পিঠে আঘাত করে। অনেক ক্ষণ মারধর করার পর টেনে হিঁচড়ে আমাকে গাড়িতে তুলে আর সেখানে দেখি আমার এক সহযোদ্ধা (সুষ্টি চাকমা)’কে মেরে গাড়িতে তুলে রেখেছে তারা। সুষ্টি চাকমাকেও ১০-১২ জন শুধু পুরুষ ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী উপর্যুপরি আঘাত করেছে। ইট, লাঠি, কাঠ দিয়ে মাথায়সহ পুরো শরীরে আঘাত করে। উভয়ের শরীরের স্পর্শকাতর অংশেও আমাদের আঘাত করে তারা।

গাড়িতে বিভিন্ন গালিগালাজ করে আমাদের দুইজনকে মারতে থাকে একপর্যায়ে মেরে ফেলার জন্য বন্দুক খুজঁতে থাকে শুভ নামের একজন ছেলে। পরে আমরা জানতে পারি ঘটনাস্থলে তাদের অস্ত্রধারী সদস্যরাও উপস্থিত ছিল এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা সব কিছুই জানার পরও রাঙ্গামাটিতে উক্ত ঘটনাটি ঘটানোর জন্য উস্কে দিয়েছিল।

অতপর আমাদেরকে অজ্ঞান অবস্থায় অস্ত্রের মুখে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মানিকছড়ি-ঘাগড়া পার হয়ে কাউখালীর দিকে দুর্গম এক জায়গায়। ঐ দিন রাতে আমাদেরকে বলা হয় টাকা বা মোবাইল থাকলে জমা দিতে আর মিথ্যা বললে ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে। তখন আমি বলেছিলাম আমাদের কাছে কোনো টাকা বা মোবাইল নেই । আর যদি আমাদেরকে মেরে ফেলে পূর্ণস্বায়ত্বশাসন অর্জন করতে পারেন তাহলে মেরে ফেলুন সমস্যা নাই। কারণ আমরা মৃত্যুকে ভয় করিনা।

পরের দিন অর্থাৎ ৭ আগস্ট ২০২৪ , তাদের অভিযোগ, আমরা নাকি ফোন দিয়ে সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেছি। সেই অজুহাতে তারা পরে আমাদের পরনে থাকা কাপড় খুলে খোঁজাখুঁজির পরও কিছুই পায়নি। আমি এবং আমার সহকর্মী মারধরের কারণে তখন হাঁটতে পারছি না। এরপর সেখান থেকে রাত ১০ ঘটিকায় প্রায় ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের মতো পায়ে হেঁটে একটা ঝিড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। আমাদের তখন না দিয়েছে প্রাথমিক কোনো চিকিৎসা, না দিয়েছে কোনো খাবার।

সেখানে গিয়ে আরো বিশেষ সূত্রে নাকি তারা জানতে পারলেন, আমি নাকি সামরিক ট্রেনিং নিয়েছি। কারণ ২৫,২৬ জন ছেলে পরনে কাপড় খুলে গুলটি লাঠি নিয়ে মারধর, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম, এমনকি বুকে হাত দেওয়া, পেন্টের বোতাম খুলে দেওয়ার পরও স্ট্রং কিভাবে আছি? ইউপিডিএফের নেতাকর্মীরা তখন আমাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছে। যেটি তাদের স্বাভাবগত চরিত্র। আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে প্রচার করেছে, ভুল করে আমরা ওদের গাড়িতে নাকি উঠেছিলাম।

এরপর ৮ আগস্ট ২০২৪ আমাদের দুইজনকে আলাদা করে কথা বলা হয়, ভিডিও ধারণ করে সেখানে জোর করে বলাতে বাধ্য করা হয় যে, নেতৃত্ব আমাদেরকে অনিশ্চিত মৃত্যুর স্থানে পাঠিয়ে বড় ভুল করেছেন। হ্যাঁ বা না। আমি তখন বলেছিলাম, আপনারা সন্তু লারমা স্যার এর বাসভবন ভেঙে দিতে যাবেন, এইটা মানবো কিভাবে? সেটি আপনাদের হঠকারী সিদ্ধান্তের মধ্যে পরে। তখন তারা বলেছিল, সন্তু লারমা স্যার নাকি মরাধরা করে আছেন, তার বাসভবন ভাঙতে শনি, রবিবারও লাগবে না। আর আমি যখন জিজ্ঞেস করি, যদি আপনাদের প্রসিত খীসার বাড়ি আমরা ভাঙতে যাবো- এই খবর পেলে আপনারা কি করবেন? তখন তারা সেই উত্তরটি যথাযথভাবে সেখানে দিতে পারেননি।

ইউপিডিএফ কর্তৃক ৬ আগস্ট ২০২৪ হতে ৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত এই তিনদিন প্রতি সেকেন্ডে আমি নিজের মৃত্যুকে কাছ থেকেই দেখেছি। এখনও আমাকে মারধরের দাগগুলো দেখলে মনে পড়ে আজকের দিনটি।

পরিশেষে, সংগ্রামের দৃপ্তকন্ঠ নিয়ে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে আমরা রাজপথে নিয়োজিত আছি। পাহাড়ের প্রতিক্রিয়াশীল কোনো শক্তি এবং শাসকগোষ্ঠী আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। কথায় আছে, সবচেয়ে ভালো ইস্পাতকে অধিক উত্তপ্ত আগুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সুতরাং ইচ্ছা ও তার সংহতিই হলো একজন মানুষের বৃহৎ শক্তি।

লেখক: তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটি।

More From Author

+ There are no comments

Add yours