হিল ভয়েস, ২৩ আগস্ট, ২০২৫, ঢাকা: আজ ২৩ আগস্ট, ২০২৫, শনিবার, বিকাল ৩:০০ টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও রাজশাহীর তানোরে সাঁওতালদের ওপর নৃশংস হামলা, শেরপুরে গারোদের জমি দখলের ষড়যন্ত্র, সিলেটে খাসিয়াদের পানজুম কর্তন ও উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং দীর্ঘদিন মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী নিরীহ নারী, শিশু সহ নিরপরাধ বম আদিবাসীদের মুক্তির দাবিতে আদিবাসী ছাত্র, যুব, সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল সংগঠনসমূহের আয়োজনে এক বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এই সময় উপস্থিত ছিলেন রাজেকুজ্জামার রতন, সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল; দীপায়ন খীসা, সদস্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি; রিপন চন্দ্র বানাই, সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; বিথী ঘোষ, গানের দল সমগীত; উজ্জ্বল আজিম, ক্রীড়া, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; হিরণ মিত্র চাকমা, তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; খোকন সুইটন মুর্মু , আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ; ফিলিমন বাস্কে, সভাপতি, সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি; জগদীশ চাকমা, সভাপতি, ঢাকা মহানগর শাখা পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি টনি চিরানের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি আন্তনী রেমা এবং সমাবেশে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সদস্য টুম্পা হাজং।
রাজেকুজ্জামার রতন তার বক্তব্যে বলেন, নতুন করে পুরোনো ধারার আক্রমণ শুরু হয়েছে। আমরা যে বলছি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন সেটি আসলেই সত্যি হয়েছে? এখনো পর্যন্ত আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য রাস্তায় নামতে হয় কেন? আমাদের রাষ্ট্র কি এই মানবিক দ্বায়িত্ব পালন করতে পারে না যে এখনো পর্যন্ত বিনাবিচারে পাচঁশত দিন ধরে বম আদিবাসীদের আটকে রাখা হয়েছে, তাদেরকে মুক্তি দিতে? সিলেটের খাসিয়া পুঞ্জিতে তাদের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম পানজুম কেটে দেওয়া হয়, গোবিন্দগঞ্জে সাওঁতালদের জমি দখল করা হয়। আমাদের রাষ্ট্র কি পারে না এসকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুষ্ঠু বিচার করতে?
দীপায়ন খীসা বলেন, আমরা এই শাহবাগে যার জন্য দাঁড়িয়েছি, তার তালিকা অনেক দীর্ঘ। এই তালিকা তো থাকার কথা ছিল না, কারণ এই তালিকাগুলো না থাকার জন্যই তো জুলাইয়ে বৈষম্য বিলোপের জন্য অভ্যুত্থান হয়েছিল। তার মানে বুঝতে হবে এই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র রাষ্ট্রের উপরমহলে যারা বসে থাকেন তাদের জন্যই অভ্যুত্থান। দেশের আপামর সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আদিবাসী মানুষের জন্য এই অভ্যুত্থান নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিনাবিচারে সাধারণ বমদের জেলে আটকে রাখার প্রসঙ্গ টেনে মি. খীসা প্রশ্ন রাখেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আপনি কি একটিবারও আমাদের বম আদিবাসীদের কাছে গিয়েছেন? কারাগারে বিনা বিচারে যে নিরীহ নিরপরাধ বম আদিবাসী মারা যায় এটির দায় কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের না?
রিপন চন্দ্র বানাই তার বক্তব্যে জুলাই সনদে আদিবাসীদের ভূমিকা ও পরিচয়কে অস্বীকার করা সহ বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিকদলগুলো যে বহুত্ববাদকে স্বীকার করতে চায় না এটি উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখেন, এটির মানে কি? আপনারা শুধুমাত্র মুখে মুখে বৈষম্য বিলোপের গল্প শুনান কিন্তু কাজে আর হয় না বলে মন্তব্য রাখেন মি. বানাই।
বিথী ঘোষ তার বক্তব্যে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আওয়ামীলীগ আমলে সেনাশাসন চলে, আজকের বাংলাদেশেও সেখানে সেনাশাসন চলে, গোবিন্দগঞ্জে আওয়ামীলীগ আমলে পুলিশ দিয়ে সাওঁতালদের বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আজকের বাংলাদেশেও একইভাবে সাওঁতালদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা চলছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এটি কি কেবল বৈষম্য বিলোপের নামে ক্ষমতার পরিবর্তন?
হিরণ মিত্র চাকমা বলেন, বিগত সময়ে আজকের যারা উপদেষ্টা পদে রয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের সাথে, আদিবাসীদের সাথে এই দাবিগুলো নিয়ে আমাদের সাথে রাজপথে-আন্দোলনে সবসময়ই সংহতি জানিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি তারাও এখনো পর্যন্ত এই বিষয়গুলো নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নি। তাহলে কি আমরা বুঝে নেবো তারা ঐ যৌক্তিক দাবিগুলো থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন? তারাও কি আমাদের সাথে প্রতারণা করছেন?
খোকন সুইটন মুর্মু বক্তব্যে বলেন, আদিবাসীদের প্রতি যে বৈষম্য তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরেও আপামর জনতা থেকে শুরু করে আদিবাসী মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ তো হয়নি, বরং তাদেরকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা। বহুত্ববাদের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছি, সেই বহুত্ববাদের প্রতিফলন আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। জুলাই সনদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সংস্কারের যে সংস্কার কমিশন, ঐকমত্য কমিশন কোথাও আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সংগঠনের মতামত নেওয়া হয়নি।
ফিলিমন বাস্কে বক্তব্যে বলেন, বিগত সরকারের আমলে আমরা যেসকল হামলা-মামলার স্বীকার হয়েছি, বর্তমানেও এটির কোনো পরিবর্তন নেই। এরমধ্যেই সেখানে ভূমিদস্যুরা হামলা করে সেখানকার তিনজন সাওঁতালকে মারাত্মকভাবে আহত করেছে। পল্লীবিদ্যুৎ থেকে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে, যেটি করা হলে আমরা আমাদের ফসলের সেচকাজ ঠিকমত করতে পারবো না। এটি আমাদের জীবনধারণের উপর আঘাত।
এই সময় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সংহতি প্রকাশ করেন সমগীত, কৃষ্ণকলি, বাংলা ফাইভ, তুহিন কান্তি দাস, এফ মাইনর, দি রাভুগা, হিভক্ল, থিয়াম বম, উসৈশিং মারমা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক দল ও শিল্পীবৃন্দ।
উক্ত বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে নিমোক্ত দাবিসমূহ করা হয়:
১. আদিবাসীদের উপর নৃশংস হামলার সাথে জড়িত ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীদের অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২. মিথ্যা মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দী নিরীহ নারী-শিশু-শিক্ষার্থীসহ বম আদিবাসীদের দ্রুত মুক্তি দিতে হবে।
৩. শেরপুরে গারো এবং সিলেটে খাসিয়া আদিবাসীদের পানজুম কর্তন, ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
৪. বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের সংবিধানে আদিবাসী বহিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
৫. পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের মানবাধিকার সুরক্ষায় অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৬. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় এবং ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
+ There are no comments
Add yours