হিল ভয়েস, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের ত্রিপুরা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ক্যাম্পেইন ফর হিউম্যানিটি প্রোটেকশন’ (সি.এইচ.পি)-এর ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার প্রেসক্লাবে গতকাল সোমবার (১৭ নভেম্বর) এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দুই পর্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের প্রথম পর্বে সকালে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। মধ্যাহ্ন বিরতির পর বিকালে দ্বিতীয় পর্বে সংগঠনের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
সি.এইচ.পির সভাপতি নিরঞ্জন চাকমার সভাপতিত্বে ও সি.এইচ.পির সদস্য প্রিয়লাল চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক ও প্রবীণ সাংবাদিক স্রোত রঞ্জন খীসা, ব্লক এ্যাডভাইসরি কমিটির প্রাক্তন প্রধান বিপাংশু চাকমা, ইন্টারন্যাশনাল চাকমা ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রগতি চাকমা, সি.এইচ.পির সদস্য নয়ন জ্যোতি ত্রিপুরা।
দ্বিতীয় পর্বে সংগঠনের কাউন্সিলে সংগঠনের ত্রি-বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করেন সি.এইচ.পির সদস্য প্রিয়লাল চাকমা। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সারা বিশ্বে মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন, যেখানে কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং কোথাও তা উন্নত হচ্ছে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করছে, তবে অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধ, সংঘাত, বৈষম্য, এবং আইনের শাসনের অভাবের কারণে মানবাধিকারের লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্বের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি মিশ্র প্রকৃতির, যেখানে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও, সংঘাত, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মতো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। যদিও জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচারের জন্য কাজ করছে, তবুও অনেক দেশেই মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, যেমন বাকস্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা এবং জীবনের অধিকার। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮ সালে তৈরি করা হয়েছিল এবং এটি বিশ্বের অনেক মানবাধিকার আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
ত্রিপুরাসহ ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতিও মিশ্র। কোন কোন রাজ্যে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নত হচ্ছে। আবার কোথাও অবনতি হচ্ছে। তবে ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের মাধ্যমে জনজাতিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার অনেকাংশে নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দেয়। অধিকন্তু চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক প্রকার সেনাশাসন জারী করা হয়। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ সরকার দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। বরঞ্চ অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানের অসমাপ্ত কার্যক্রম সমাপ্ত করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল।
ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না হতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, মন্দির ভাঙচুর, ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, নৃশংস হত্যাকান্ড, ধর-পাকড় ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে। পক্ষান্তরে তথাকথিত বৈষম্য বিরোধী বাঙালি ছাত্র আন্দোলন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের ব্যানারে মুসলিম সেটেলার এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে লেলিয়ে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জোরদার করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ত্রি-বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করার পর প্রিয়লাল চাকমা সংগঠনের নতুন কার্যকরী কমিটির প্যানেল উপস্থাপন করেন। আলোচনা-পর্যালোচনার পর নিরঞ্জন চাকমাকে সভাপতি, প্রিয়লাল চাকমাকে সম্পাদক ও বিভূতি চাকমাকে কোষাধ্যাক্ষ হিসেবে ৯ সদস্য-বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। এছাড়া স্রোত রঞ্জন খীসাকে মুখ্য এ্যাডভাইজার করে ৫ সদস্য-বিশিষ্ট একটি এ্যাডভাইজারী কমিটিও গঠন করা হয়।
পরিশেষে সমাপনী বক্তব্যে নিরঞ্জন চাকমা বলেন, বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার স্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি স্বাক্ষর করলেও একের পর এক সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি মোতাবেক ল্যান্ড কমিশন গঠিত হয়েছে সত্য, কিন্তু একটি ভূমি বিরোধও এই কমিশন নিষ্পত্তি করতে পারেনি।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাদের পেছনে যাওয়ার কোন পথ নেই। তাদের সামনেই এগুতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতিদিন মানবাধিকার হরণ হচ্ছে। সেই মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। সি.এইচ.পির মাধ্যমে এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রচারকার্য জোরদার করতে হবে বলে তিনি দৃঢ় মত ব্যক্ত করে ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন সমাপ্ত ঘোষণা করেন।