অপ্রতিরোধ্য পিসিপি’র পথচলাঃ লড়াই সংগ্রামের ৩২ বছর

0
860
পিসিপি’র দলীয় পতাকা

বাচ্চু চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’র পথচলা আজ ৩২ বছরে পা দিয়েছে। অনেক ঝড়-ঝঞ্ছা মোকাবিলা করে পূর্ণ করেছে ৩২টি বছর। শৈশব, কৈশোর এবং নব-যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় পেরিয়ে বয়সকালে পা দিলেও আজো পিসিপির সেই তারুণ্যের সঞ্জীবনীর ডাক শুনতে পাই পাহাড় ও সমতলের রাজপথের প্রতিটি প্রান্তরে! স্লোগানের উত্তাল মিছিল- কলম হবে হাতিয়ার-পিসিপির অঙ্গীকার; শিক্ষা, সাম্য, প্রগতি-পিসিপির মূলনীতি, আমাদের ধমনীতে এম এন লারমার রক্ত-এই রক্ত কোনদিনই বেঈমানি করে না। আজ ২০ মে পিসিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এমনই স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হবে পাহাড়ের রাজপথ ও গিরিশৃঙ্গ। পিসিপির স্মৃতির রঙ তুলিতে আঁকা দশ ভাষাভাষী জুম্ম ছাত্র সমাজের সংহতির প্রতীক এখনও সুদৃঢ়চিত্তে বহমান এবং নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সবুজ পাহাড়ের তারুণ্য ও প্রগতির প্রতীকরূপে পিসিপি আজো নতুন প্রজন্মের তথা জুম্ম ছাত্র সমাজের একটি অনুসরণীয় আদর্শের নাম।

১৯৮৯ সালে ৪ ঠা মে ‘লংগদু গণহত্যা’র প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০ মে পিসিপির লড়াই সংগ্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমরা জানি, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ গঠনের আগে জুম্ম ছাত্র সমাজের মধ্যে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক অনেক ছাত্র সংগঠন ছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে লংগদুর গণহত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা করে। এর ইতিহাস অনেকেরই জানা রয়েছে এবং পুরো ইতিহাস লিখতে গেলে আমার লেখাটি অনেক নাতিদীর্ঘ হবে এবং পাঠকদের বিরক্তি করতে চাই না। তারপরও কিছু কথা না লিখে চুপ করে থাকা যায় না, তাই কিছু কিছু বাস্তব ইতিহাস তুলে ধরে চেষ্টা করবো!

এটা স্মরণে রাখা দরকার যে, পাহাড়ের বুকে অপ্রতিরোধ্য ছাত্র সমাজের আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার জন্য এক সময় শাসকশ্রেণি কঠোর পদক্ষেপ হাতে নিয়েছিলো। দমন-পীড়ন, অত্যাচার, জেল, জুলুম, হুলিয়া জারি করে জুম্ম ছাত্র সমাজের আন্দোলনকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ অপচেষ্টা চালিয়েছিল। নিপীড়নের নগ্ন বহি:প্রকাশ জুম্ম ছাত্র সমাজ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে। পাহাড়ের বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল মিছিলে আসা ৭০ বছর বয়সী তারুণ্যের সঞ্জীবনী শহীদ ভরদ্বাজমনিকে এবং ক্যজই মারমা, লাল রিজার্ভ বম, সনজিৎ তঞ্চঙ্গ্যা, রুপম, সুকেশ, মনতোষ, সমর বিজয়, ভূবনমনি, দীঘিনালার রিংকু, পেজকা মারমা, মংচসিং মারমাসহ আরো অনেক বীর ছাত্র-যোদ্ধাদের। লড়তে লড়তে তাঁরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে চলে গেছেন, তারপরও তারা পরাজয় মানেননি। তাঁদের অজেয় শক্তি, র্দুদান্ত সাহসিকতার কথা জুম্ম ছাত্র সমাজকে ভুলে যাওয়া কখনো ঠিক হবে না। পিসিপির মিছিলে আজো ভরদ্বাজমনিদের অমর চেতনা জুম্ম ছাত্র সমাজের কান্ডারী সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদকে শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। ভরদ্বাজমনিদের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না; রক্ত যতই ঝড়বে, ঝড়ুক-আন্দোলন ছাড়বো না!

পিসিপির প্রথম আহ্বায়ক প্রশান্ত ত্রিপুরা ও অন্যান্য সদস্যদের হাত ধরে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠনটি হাঁটি হাঁটি পা-পা করে আজ ৩২ বছরের পা দিয়েছে। শৈশব, কৈশোর ও যৌবন পেরিয়ে আজ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ একটা বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়েছে। প্রবীণ ছাত্রনেতাদের অনেকের নাম হয়তোবা মনে নেই, যাদের হাত ধরে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ গঠিত হয়েছে। যারা শুরুতে ভূমিকা রেখেছেন, প্রশান্ত ত্রিপুরা, ধীরাজ, বিধান, প্রতিম রায় পাম্পু, শক্তিপদ ত্রিপুরা, কেএস মং, ভূট্টো দা, পলাশ খীসা, জলি মং, ব্রজ কিশোর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরবর্তীতেও অনেক সহযোদ্ধাদের রক্ত, ঘাম, শ্রম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে গড়ে ওঠা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনটি আজো তাঁর মৌলিক লক্ষ্যপথ থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। এই সংগঠনকে গড়ে তুলতে যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্লান্ত শ্রম ও সময় ব্যয় করেছেন ২০ মে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে সকলকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে স্মরণ করছি। যে ছাত্র সংগঠনের কন্ঠে জড়তা ছিল, সেই ছাত্র সংগঠনটি আজো আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতোই পাহাড়ের দিকে দিকে ফুলকি ছড়িয়েছে। পিসিপির চেতনায় আজো দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ, আদর্শিক চেতনায় সুসজ্জিত এবং সেই প্রেক্ষাপট ধরে প্রতিবাদও হয়ে উঠেছে উদ্দীপ্ত ও বজ্রকন্ঠ।

দীর্ঘ ৩২ বছরের পথচলায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রয়েছে অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দিন। এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্মরণীয় দিনগুলোর মাঝে উত্তাল মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ যা স্বমহিমায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। স্বাভাবিকভাবে পিসিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০ মে আসলে আমাদেরকে করে অনেক স্মৃতিকাতর। এই সংগঠনের সাথে জুড়ে আছে অনেকেরই অনেক দিনের স্মৃতি। মিছিল, মিটিং, আনন্দঘন মুর্হুত এবং সহযোদ্ধা হারানোর বেদনার মুর্হুতসহ সেই ফেলে আসা দিনগুলো আমাদেরকে এখনও উদ্বেলিত করে তুলে। হৃদয়ে এখনও পিসিপির দলীয় সংগীতের বিন বাজে এবং মনের মধ্যখানে নাচন ধরিয়ে যায়। টগবগে তারুণ্যের বাধা-বন্ধনহীন ছাত্র জীবনের জোয়ারে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এখনও হারিয়ে যেতে নেই কোনো মানা। আমরা আসি তো থাকবো, যুগে যুগে লড়বো-এই বলে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দায়িত্বরত তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যায় ক্ষণে-ক্ষণে। তাইতো বলি, পিসিপি আজও অপ্রতিরোধ্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্র সমাজের আদর্শ ও চেতনার একটি অন্যতম নাম। জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজের একটি রাজনৈতিক পাঠশালার নামও। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত রাজপথের মিছিল এবং সমাবেশের পিসিপির কন্ঠে আগুন জড়ানো বক্তব্য শুনে শুনে নিজেকে আরও সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেছি। সার্বক্ষণিক সময় দিয়ে পিসিপির আন্দোলনকে এক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টারও কোন কমতি ছিল না এবং সংগঠনকে আরও অধিকতর সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে ছাত্র সমাজের প্রাণের স্পন্দনে পরিণত করার চেষ্টার কোন প্রকার ত্রুটি ছিল না। তাইতো ফেলে আসা দিনগুলো মনে পড়লে আজও আমি উদ্দীপ্ত হয়ে যায়। প্রিয় সহযোদ্ধা মংচসিংদের হারানোর বেদনা ও যন্ত্রণাগুলো আজও অনেক সহযোদ্ধা ভুলতে পারেনি। শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন, নিপীড়ন ও প্রতিক্রিয়াশীলদের শত হুমকির মধ্যেও তরুণ ছাত্র সমাজকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শাসকশ্রেণির হাজারো-বাধা উপেক্ষা করে এক সময় শত শত ছাত্র সমবেত হয়েছিল পিসিপির পতাকাতলে। কোন প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তিই অপ্রতিরোধ্য ছাত্র সমাজকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আজ দিন দিন অসহনীয় এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার দিকে দাবিত হচ্ছে। যখনই জাতীয় জীবনে বিরাজ করেছে একটা বিরাট শূণ্যতা তখনই ছাত্র সমাজের কান্ডারী হিসেবে যৌবনেরা সেই শূণ্যতা পরিপূরণে বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মৃত্যুকে স্বমহিমায় আলিঙ্গন করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে দেখতে পাই, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ ৯০-এর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন-এই প্রতিটি ধাপগুলোই বাস্তব সাক্ষী। এমনই সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক বিরাট শূণ্যতা বিরাজ করছিল, ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই শূণ্যতা দূর করতে সক্ষম হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে আজো জুম্ম জাতীয় জীবনে একটা বিরাট শূণ্যতা বিরাজ করছে। এই শূণ্যতা পূরণের জন্য দরকার এক ঝাঁক সংঘবদ্ধ ছাত্র-যুব, যাদের মধ্যে থাকবে আদর্শিক চেতনা, বুকে থাকবে বল, মনে আছে আশা, সাহস, ধৈর্য্য ও শক্তি। আজকে এমনই জুম্ম ছাত্র তরুণদের প্রয়োজন খুব বেশি। শত দুঃখ-কষ্টকে আপন করে নিতেও দ্বিধাবোধ করবে না, শত বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে নিজেকে ইস্পাত-দৃঢ় করে লক্ষ্য-পথে এগিয়ে যাওয়ায় নিজেকে স্থির রাখতে পারবে এবং প্রগতিশীল আদর্শ ও চেতনাকে উচ্চস্থানে রাখবে। একজন পরাজিত সৈনিকের ন্যায় দেখতে ছাত্র-যুবদের মানায় না, বিজয়ের মুকুট পরিধান করে ঘরে ফেরার দীপ্ত শপথ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেতনাকে ধারণ করতে হবে। আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আন্দোলন-সংগ্রাম কোন ভোজসভা নয়, প্রবন্ধ রচনা কিংবা সূচিকর্মও নয়। আন্দোলন-সংগ্রাম হলো বলপ্রয়োগের কাজ, যা শোষিতশ্রেণির বলপ্রয়োগের দ্বারা শোষকশ্রেণিকে উৎখাত করে। আজ জুম্ম জাতির উপর যে নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার স্টিমরোলার চলমান রয়েছে, তারই প্রেক্ষিতে জুম্ম ছাত্র সমাজের আশু করণীয় নির্ধারণ করা জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুনিয়া জুড়ে করোনা মহামারী পরিস্থিতি এক ভয়ংকর সংকট ডেকে এনেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণ অনেক দেশে চেষ্টা করেও সম্ভব হযনি। বাংলাদেশেও এখনও তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়ে গেছে। একটু অসচেতন বা অসতর্ক হলেই তা আরও মহামারী রূপ নিতে পারে। মহামারী মোকাবেলায় উপর্যুপরি লকডাউনের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি যেমন নাজুক অবস্থা অতিক্রম করছে, তেমনি সরকার কর্তৃক পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা, উপরন্তু সরকারের একটি মহল ও সেনাবাহিনী কর্তৃক চুক্তিবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ এবং সেনাশাসনের মাধ্যমে জুম্মদের উপর দমন, পীড়ন, অত্যাচার, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, বাড়ি তল্লাশি ও সামরিক অভিযানের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আজ শ্বাসরুদ্ধকর ও জটিলতর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এমনতর পরিস্থিতি ও বাস্তবতার চরম মুর্হুতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদের জুম্ম জাতির সামনে হাজির হয়েছে। একদিকে দুনিয়া জুড়ে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের জয় জয়কার এবং বিশ্ব জুড়ে করোনা মহামারীর ভয়ংকর সংকটে দেশে দেশে অর্থনীতির ধস, মানুষের জীবনমান মহা সংকটে পতিত হচ্ছে-এই দুই বৈপরীত্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠছে, অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ফলে এমনই একটা জটিলতর পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় পিসিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কেবল অনলাইনে আলোচনাতে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে তা নয়। সমগ্র জুম্ম জনগণের মাঝে এবং প্রতিটি মানুষের মনের গহীনে পিসিপি’র অন্তর্নিহিত বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে যে, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এখনও জীবন্ত ও সজীব। পিসিপি’র দামাল ছেলেরা জুম্ম জনগণের সামগ্রিক মুক্তির জন্যে এখনও স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্ন বুনে চলেছে প্রতিটিক্ষণ!

জুম্ম ছাত্র সমাজকে স্বপ্ন দেখাতে পিসিপি কখনোই ক্লান্তিবোধ করে না এবং তারা এও জানে যে, দেখানো স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে কঠোর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন। যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জন্ম হয়েছিলো, সে চেতনার মশাল জুম্ম ছাত্র সমাজের হৃদয় থেকে এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। পিসিপি আজও হয়নি পথভ্রষ্ট। মনে রাখতে হবে, হীন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার কর্দমাক্ত নর্দমায় পিসিপির দামাল ছেলেরা আজো ডুবে যায়নি। আজো পাহাড়ের কোনে কোনে পিসিপি’র সেই আদর্শ ও চেতনার ধারা অক্ষুণ্ন রেখে চলার পথে দৃঢ়তা ও সাহসিকতা সম্পন্ন ছাত্র-যৌবনের অস্তিত্ব রয়েছে।

যুগে যুগে আদর্শিক ছাত্র তরুণরাই জাতীয় সংকটময় দিনে এগিয়ে এসেছিল। ৩২ বছরের মাথায় আজও তা পাহাড়ের বুকে জ্বলজ্বল করছে। এই আদর্শিক চেতনায় জুম্ম ছাত্র-যুবরাই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের গৌরবোজ্জ্বল পতাকাকে সবার উর্ধ্বে তুলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শত বাধা-বিপত্তিতেও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ দমে যায়নি। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে রয়েছে অবিচল, অটল ও আপোষহীন এক সংগ্রামী। শত-প্রলোভনের কাছে হয়নি এখনও পরাজিত। শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিকিয়ে দিতে পারেনি পিসিপির নীতি-আদর্শ। প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির হুমকি-ধামকি ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে চলার গতিকে অব্যাহত রেখেছে। নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত জুম্ম জনতার সপক্ষে কাজ করার যে শপথ নিয়েছিলো, তার সাথে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ আজও বেঈমানী করতে পারেনি। শাসকগোষ্ঠীর রণহুংকারে ভীতু ও দিশাহারা হয়নি। বরং নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো। এখনও অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই জারী রাখতে সক্ষম।

আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, পিসিপি’র গঠন ও অগ্রযাত্রা কখনোই সহজ পথে ছিলো না। জন্মলগ্ন থেকেই পিসিপি’কে বহু দৃশ্য-অদৃশ্য বাধা মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রগতিশীল জুম্ম ছাত্র সমাজের অজেয় শক্তিকে সামনে এগুতে হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে। লড়াইয়ের দীর্ঘ পথযাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি কালো মেঘের মতো ছায়া ফেলে বাধা সৃষ্টি করলেও, তা কখনই চিরস্থায়ী হতে পারেনি। কথায় বলে, সূর্যকে মেঘ কখনই চিরদিনের জন্য ঢেকে রাখতে পারে না। অবস্থার নিরিখে কখনো কখনো সাময়িকভাবে সূর্যকে মেঘ আড়াল করে রাখতে পারে মাত্র। পৃথিবীর ইতিহাসে সব দেশের মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রামে তাই দেখতে পেয়েছি। পিসিপি’র আন্দোলন সংগ্রামের চলার পথেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। বহু আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে সামনে এগিয়ে যেতে অতীতে যেমন বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করতে হয়েছিল, আজো তা চলমান রয়েছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ৩২ বছর আগে ফিরে তাকালে সেই অতীতের দিনগুলো ছাত্র সমাজের ইতিহাসের মধ্যে হয়ে উঠবে জীবন্ত। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ আজো অপ্রতিরোধ্য ভূমিকায় নিজেকে মেলে ধরার সাহস রাখে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের ঘন্টা বাজবার সাথে সাথে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামের বুক ছিঁড়ে আপোষহীন কন্ঠে গর্জে উঠেছিল। পিসিপি’র প্রতিবাদী মিটিং-মিছিল-সমাবেশে উদ্যত রাইফেল-মেশিনগান-বেয়নেট এবং শাসকগোষ্ঠীর শত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমবেত হয়েছিলো হাজারো অকুতোভয় সাহসী, সংগ্রামী ও প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা। ষড়যন্ত্রমূলক মামলা-হুলিয়া-জেল-জুলুম কিংবা হত্যার হুমকি কোন কিছুই মুক্তিকামী প্রতিবাদী তরুণদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। সেখান থেকে শক্তি ও প্রেরণা নিয়ে জুম্ম ছাত্র-যুবরা আবারও রাজপথে সামিল হবে এবং অধিকার আদায়ের মিছিল আরও দীর্ঘতর করবে-এটাই আমার প্রত্যাশা!

লেখক: বাচ্চু চাকমা, প্রাক্তন সভাপতি, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি