সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রক্ষার দাবি ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান নাগরিক সমাজের

0
702

হিল ভয়েস, ১২ মে ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা বন্ধ এবং উদ্যান রক্ষার দাবি জানিয়েছে দেশের নাগরিক সমাজ। উদ্যানের মধ্যে কংক্রিট এবং অন্যন্য স্থাপনা ৫ শতাংশের বেশি থাকা যাবে না বলে যে বিধিমালা আছে সেটাও লংঘিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন বিশিষ্টজনরা।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা বন্ধ এবং উদ্যান রক্ষার দাবিতে ভূমি-বন-বনবাসী রক্ষা জাতীয় কমিটি আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় এই দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের মানুষ।

আজ ১২ মে ২০২১ অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনা সভাটি মিডিয়া পার্টনার হিসাবে লাইভ সম্প্রচারণ করে আইপিনিউজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় এবং নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় সংযুক্ত ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য, নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির, স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব, সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও গাছ কাটার বিরুদ্ধে রিটকারী আইনজীবী এডভোকেট মনজিল মোরশেদ, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, জনউদ্যোগের সদস্য সচিব তারিক মিঠুল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং প্রমূখ।

উক্ত আলোচনার সূত্রপাত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীন। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, আমরা যেসময় এই গাছ কাটার মহোৎসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি সেসময় পুরো পৃথিবী জুড়ে অক্সিজেনের বদ্ধ অভাব এবং অক্সিজেনের জন্য লড়াই করছি। সুন্দরবন ধ্বংস, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ওসমানী উদ্যান, মধুপুরের শালবন ধ্বংস ও পাহাড়ে বন ধ্বংস করে হোটেল নির্মাণ- এসব একই সূত্রে গাঁথা বলেও মনে করেন তিনি। পুঁজিবাদের মহাসম্প্রসারণ, তার পেছনের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের চক্রান্তের কারণে গাছ কেটে, বন কেটে, উদ্যানকে বাণিজ্যিক জায়গায় পরিণত করা হচ্ছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, সরকারে যে থাকুক তাকে অন্ধভাবে দেশ চালাতে দেয়া যাবে না। লোভের কারণে ইতিহাস মুছে যাবে তা হতে দেয়া যাবে না। এই জায়গা (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ধ্বংস হলে বঙ্গবন্ধু, জাহানারা ইমাম সহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধ্বংস হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার জন্য সোচ্চার নাগরিক আন্দোলন জারি রেখে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ধ্বংস হলে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে যাবে, জাহানারা ইমামের নাম মুছে যাবে এবং যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে সেটা মুছে যাবে। আমরা একটা নি:শ্বাস নেওয়ার জায়গা পেয়েছি। সেটা মুছে যাবে। এটা হতে দেয়া যাবে না। যার জন্য এই আন্দোলন জারী রাখতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, একটি দেশের মিনিমাম যে পরিমাণ গাছ থাকা দরকার, সেটা আমাদের দেশে নাই। সরকারিভাবে ১৬ শতাংশের বেশি বলা হচ্ছে। কিন্তু তা আসলে নেই। মধুপুর গড়ের গাছ কেটে একাশিয়া ও ইউক্যালিপটাস লাগিয়ে এই শালবনকে ধ্বংস করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাঁর।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একটা ঐতিহাসিক জায়গা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এই ঐতিহাসিক জায়গাটি রক্ষা করার জন্য নতুন প্রজন্মকে সোচ্চার হতে হবে। গাছ কাটার মূল উদ্দেশ্যটি হচ্ছে বাণিজ্যিক এবং টাকা বানানো। নানাভাবে পেচিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে এই প্রকল্পগুলো করা হয় যার পেছনে কিছু মানুষের স্বার্থ জড়িত বলেও মনে করেন তিনি। এই জায়গাটা’র গাম্ভীর্য নষ্ট করে বাণিজ্যিক জায়গা না করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া গাছ না কেটে পরিবেশের স্বার্থে ভালো হয় এমন গাছ লাগানোরও দাবি করেন এই মানবাধিকার কর্মী।

গাছ কাটার বিরুদ্ধে রিটকারী আইনজীবী এডভোকেট মনজিল মোরশেদ ‘বিভাগীয় শহর, জেলা শহরের পৌর এলাকা ও দেশের সকল স্থানের উন্মুক্ত এলাকা, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন’ এর উল্লেখ করে বলেন, উদ্যানের কোনো ক্যারেক্টার পরিবর্তন করা যাবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেহেতু ডিকলার্ড উদ্যান । তাই আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে যে কোনো রূপ বৃক্ষরাজির নিধনকেও শ্রেণি পরিবর্তন হিসাবে গণ্য করা হবে। গাছ যদি কাটা হয় তাহলে উদ্যান ধ্বংস হিসেবে বিবেচিত হবে বলেও আইনে বলা আছে। আর যদি ধ্বংস করা হয় তাহলে পাঁচ বছর পর্যন্ত শাস্তি হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পন এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোন জায়গায় হয়েছে তা এখন সহজে বোঝা যাবে না। তৎসময়ের যারা ছিলেন তাঁদের নিয়ে কমিটি করে সে জায়গাগুলোকে আইডেনটিফাই করে সেগুলোর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আদালতের নির্দেশনা আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে আদালতের আদেশ না মানায় আবার নতুন করে আদালত অবমাননার মামলা করতে হচ্ছে বলেও জানান এই আইনজীবী। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য স্থাপনা হলে ঐতিহাসিক স্মৃতিকে বুঝতে পারা যাবে না বলেও মনে করেন তিনি। অনেকেই এখন বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবসা, বাণিজ্য ও নানা স্বার্থে ব্যবহার করছে এবং ‘প্রধানমন্ত্রীর জানা আছে’ অজুহাতে অনেক অন্যায় চাপিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, আর কিছু না হোক এ্ই মুহূর্তে এই বিষয়টিকে (গাছকাটা) আমরা একটা স্থগিতাদেশের মধ্যে নিয়ে গিয়েছি। এই বিষয়গুলোর পেছনে আসা সিদ্ধান্তগুলোর উৎস জানতে হবে। কেবল সিদ্ধান্ত নয়, দৃঢ়তার সাথে গাছ কেটে সাফ করে সেখানে ‘উন্নয়ন’ দাঁড় করানো হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এ বিষয়টির পেছনে তিনটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশন বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের পেছনে ব্যুরোক্র্যাটদের হাত রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর গাছ কাটা বিষয়ে ‘দুঃখিত’ হওয়া নিয়ে তিনি আরো বলেন, এই দু:খ জেনে কী করবো। উদ্যান, গাছ ও অন্যান্য পরিবেশ বিষয়ক বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের মত একটা কমিশন গঠন করতে হবে। যার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়।

এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, যখন একটা বৈশ্বিক মহামারীর সংকট চলছে এবং সে মহামারী আসছে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার প্রতিক্রিয়া হিসাবে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। সেখান থেকে আমরা মনে হয় কিছুই শিখলাম না। প্রকৃতিকে ধ্বংস করার যে ধারাবাহিক কার্যক্রম চলছে তারই একটা অংশ। আমলা প্রশাসনের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে। সেটা হলো গাছ, প্রকৃতি, বন, জলাধার ধ্বংস করে ‘উন্নয়ন’ কাজ পরিচালনা করা। পরিকল্পনা গ্রহণ করে সারা দেশব্যাপী পরিবেশ রক্ষার যে আন্দোলনগুলো চলছে সে আন্দোলনগুলোকে সমন্বিত করারও আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আকসাদুল আলম বলেন, প্রকৃতিকে যে রক্ষা করতে হবে, তার কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রকৃতি ধ্বংসের যে রাজনীতি সেটাকে আমরা কতটুকু সামনে আনি। একটা জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির ইতিহাসকে ধ্বংস করা হচ্ছে। তাছাড়া পরিবেশকে সামনে এনে রেসকোর্স বাদ দিয়ে উদ্যান হওয়া এবং শিশু পার্ক স্থাপন এসবের পেছনে যে রাজনীতি এগুলো সামনে নিয়ে আসা জরুরী। পরিবেশ ও উদ্যান রক্ষার আন্দোলনকে জনগণের সামনে নিয়ে যেতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই কাজগুলোর পেছনে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উদাসীনতা এবং কর্পোরেটদের স্বার্থ জড়িত। বাংলাদেশ এখন বিশাল আমলা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সরকারি আমলা’রা মনে করেন যে, একটি গাছের জন্য কী আন্দোলন করে তারা। এই ধরনের উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট নির্মাণকে সঠিক উন্নয়ন দর্শন নয় বলেও মনে করেন তিনি।

আলোচনায় অংশ নেন জনউদ্যোগের সদস্য সচিব তারিক মিঠুল, আমিনুর রসুল, জনউদ্যোগের লুনা নুর, মিহির বিশ্বাস, আলমগীর কবীর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং প্রমুখ।