সন্তু লারমার বিরুদ্ধে ইউপিডিএফের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যে নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া

0
1013

হিল ভয়েস, ২৪ জুলাই ২০২২, রাঙ্গামাটি: গত ২০ জুলাই ২০২২ হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ এর ব্যানারে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) কর্তৃক রাঙ্গামাটিতে আয়োজিত মানববন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)-কে লক্ষ্য করে যে অশ্রাব্য ও অরাজনৈতিক ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে তাতে নেটদুনিয়ায় সাধারণ ও নিরপেক্ষ নেটিজেনদের মধ্যেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এসব নেটিজেনদের অনেকেই ইউপিডিএফের এসব কুরুচিপূর্ণ ও ঔদ্ধত্যমূলক বক্তব্যকে সেটেলারদের ভাষার সাথে তুলনা করেন এবং ‘অযৌক্তিক গালাগালি’, ‘সংঘাতের জন্য উস্কানিমূলক’, ‘তুচ্ছতাচ্ছিল্যমূলক’ বলে অভিহিত করেন।

উল্লেখ্য, ঐদিন আঞ্চলিক পরিষদের কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত ইউপিডিএফের মানববন্ধনে সন্তু লারমাকে ‘খুনী’, ‘সন্ত্রাসীদের গডফাদার’, ‘জাতীয় কুলাঙ্গার’, ‘সেনাবাহিনীর দালাল’ ইত্যাদি আখ্যায়িত করে আক্রমণাত্মক ও কদর্য ভাষায় শ্লোগান ও বক্তব্য দেয়া হয়। নেটিজেনদের বক্তব্য হলো, ইউপিডিএফ কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে, দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারে, শ্লোগান দিতে পারে, এ ধরনের শব্দ ও ভাষা গ্রহণযোগ্য নয়। নিম্নে কয়েকজন নেটিজেনদের মতামত তুলে ধরা হলো।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সুপরিচিত ব্লগার ব্যারিষ্টার ইমতিয়াজ মাহমুদ তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘সন্তু লারমাকে আক্রমণ করতে গিয়ে কোন আদিবাসী সংগঠনের ভাষা যখন সেটেলারদের ভাষার সাথে হুবহু মিলে যায় তখন আপনি কি উপসংহারে পৌঁছেন? আপনি জনসংহতি সমিতির সাথে নানা প্রশ্নে একমত নাও হতে পারেন। আমরা অনেকেই নানা প্রশ্নে নানা ভিন্নমত করি।…কিন্তু সন্তু লারমার বিরুদ্ধে পাহাড়ের ও সমতলের আদিবাসী মানুষের যে সমালোচনা বা অভিযোগ আর তাঁর প্রতি পাহাড়ের সেটেলারদের যে বৈরিতা এই দুইটা তো কখনোই এক নয় এবং এক হতে পারেও না। সেইজন্যেই যখন দেখা যায় যে কোনো আদিবাসী সংগঠনের নামে কর্মসূচীতে আদিবাসী তরুণ তরুণীরা সেটেলারদের ভাষায় সেটেলারদের শব্দে ও সেটেলারদের বাক্যে লিখিত অযৌক্তিক গালাগালি সম্বলিত ব্যানার হাতে অবস্থান নেয়- উদ্বিগ্ন হই। শঙ্কিত হই। সংশয় জাগে।’

সাংবাদিক হিমেল চাকমা লিখেন, ‘ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধের অবশ্যই দরকার আছে। এটি সবার প্রাণের দাবী। এটি বন্ধের জন্য যার কাছে দাবি জানাতে এসেছেন তাকে এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা কি বেশি প্রয়োজন ছিল? যে ব্যানারেই এ আয়োজন হোক এটা তো ইউপিডিএফের কর্মসূচি। ব্যানার ফেস্টুনের ভাষা আরো সুন্দর হতে পারত। যেটা দেখে সন্তু লারমার উপলব্ধি হত। সংঘাত বন্ধে তাঁর অবস্থান থেকে উদ্যোগ নিতেন।’ তিনি আরো লিখেন, ‘ইউপিডিএফের বয়স তো প্রায় ২৪ বছর। এভাবে ঐক্য হয় না। অবিশ্বাস তিক্ততা বাড়ায়। সংঘাত দীর্ঘ হয়। তুমি অধম বলে আমি উত্তম হব না কেন? কিন্তু আমরা সেটি দেখছি না। দেখেছি তুমি যেমন অধম তোমার চেয়ে আমি আরো বেশি অধম। এজন্য সংঘাত লেগে আছে। এসব প্রমাণ করে ভ্রাতৃত্বের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।’

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা লিখেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কথিত মানববন্ধন আয়োজন করে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী সন্তু লারমাকে সন্ত্রাসীর গডফাদার আখ্যা দেওয়া ইউপিডিএফ নামক দলটির চরিত্রের সঙ্গেই যায়। এটা সরাসরি সংঘাতের জন্য উস্কানী দেওয়ারই নামান্তর। শাসকগোষ্ঠীর নয়া নয়া খেলাধুলায় ইউপিডিএফ একটি বিশেষ টীম মাত্র। রঙ্গমঞ্চে এতদিন একটু আড়ালে ছিল। এখন আবার মঞ্চে তারা হাজির। আমরা নাট্যকার, পরিচালক এবং প্রযোজক সবাইকে কমবেশি চিনি। তবে এই পাতানো খেলার উপযোগিতা বহু আগেই শেষ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের এই পাতানো খেলায় দর্শকদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।’

ডেনিম চাকমা লিখেছেন, ‘গত কালকের ইউপিডিএফ যে, সন্তু লারমাকে খুনী-সন্ত্রাসী-গডফাদার এবং জাতীয় কুলাঙ্গার বলে সমাবেশ করল! এইটা ইউপিডিএফের ভুল ছিল তাও কেউই স্বীকার করেননি। ইউপিডিএফের নিশ্চয়ই তথ্য ও প্রচার সম্পাদক আছেন। বিবৃতি দিলেই তো হয়ে যেত। কিছু দিন মগ পার্টি ঠিক একইভাবে প্রোগ্রাম করেছিল..’।

তন্ময় বাবু নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘আজকের এই সমাবেশ থেকে কি আদৌ কোন সমাধান মিললো, নাকি আলোচনার পথ আরো বন্ধ হলো? সংঘাতের দিকে রূপ নিবে? নাকি আলোচনার পথ খুলবে? আমাদের মনে রাখতে হবে- এইসব কিছুর কারণে পাহাড়ে তৃতীয় পক্ষ এসে আমাদের বুকে বার বার হানা দেয়, আর জুম্মোরা নির্যাতিত এবং নিপীড়িত হই।’ তিনি আরো লেখেন, ‘উস্কানি নয়, সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।’

ছোটমনি চাকমা নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এখন সযত্নে এড়িয়ে চলি। আমার সরল চোখে যা দেখি শুধু তাই বলার চেষ্টা করি। আজ রাংগামাটিতে ইউপিডিএফ এর সমাবেশের ব্যানারে যে শব্দ-বাক্য চয়ন করা হয়েছে তার সাথে সেটেলারদের ব্যানারের কোন পার্থক্য নেই। এই ব্যানারের ছবি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়াতে যাবে এবং সেটেলাররা যা চায় সেটাই কিন্তু মিডিয়াতে আবারও প্রকাশ হয়ে যাবে। আমরা সাধারন মানুষ। আমরা কোন দলের, কোন পক্ষের হয়ে চিন্তা করি না। চিন্তা করি আমাদের সাধারন জুম্ম জনগনের ভাগ্যে কি আছে, কি ঘটতে পারে সেসব নিয়ে, আমাদের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে। আশাকরি ইউপিডিএফ এর বুঝদার নেতা-কর্মীরা একটু ভেবে দেখলে বিষয়টা বুঝতে পারবেন।’

ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ফেসবুকে উক্ত বিতর্কিত মানববন্ধনের ছবি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উক্ত স্টাটাসেও অনেক নেটিজেন মানববন্ধনের ভাষা ও বক্তব্যদের বিরুদ্ধে ‘কমেন্ট’ বক্সে মতামত তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যে সুমিত চাকমা নামে একজন ব্যক্তি লিখেছেন যে, ‘এদের সুস্থতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে!’ দর্পন চাকমা লিখেছেন, ‘ব্যানারে খুব সুন্দর শব্দ চয়ন করেছেন- সেটলার পরিষদের সাথে আর পার্থক্য থাকলো কই?’

অসান্তু চাকমা লিখেছেন, ‘অবশেষে শাসকগোষ্ঠী হিল উইমেন ফেডারেশনকে হাতে নিয়ে পার্বত্য চুক্তিকে পদদলিত করতেছে।’ রাসেল চাকমা নামে আরেক নেটিজেন চাকমা ভাষায় মন্তব্য তুলে ধরেন, যার বাংলা অর্থ হলো- ‘সরকারের দালালরা ভ্রাতৃসংঘাত বন্ধ করার জন্য মানববন্ধনে এসেছেন, নাকি উস্কানি দেয়ার জন্য এসেছেন? সেটেলার পরিষদ এবং ইউপিডিএফ (গুন্ডুজ)-দের মধ্যে তো কোনো পার্থক্য থাকলো না আর।’

ইউপিডিএফের মানববন্ধনে সন্তু লারমাকে লক্ষ্য করে যে শ্লোগান ও বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষমূলক, উস্কানিমূলক, মানহানিকর ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে জনসংহতি সমিতি গত ২২ জুলাই ২০২২ তারিখে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, মানববন্ধনের কথা গোপন রেখে ‘কাজ রয়েছে’ মর্মে কথা বলে নান্যাচর উপজেলার ভূইয়াদাম, লাঙেল পাড়া ও ঘিলাছড়ি এবং রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার কুতুকছড়ি ও পুঁটিখালী প্রভৃতি গ্রাম থেকে ২০/২৫ জন যুবতী নারীদের ট্রলার বোট যোগে রাঙ্গামাটি শহরের শিল্পকলা একাডেমী ঘাটে নিয়ে আসে এবং সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ের সামনে গিয়ে তড়িঘড়ি ব্যানার খুলে মানববন্ধন শুরু করে এবং জনসংহতি সমিতি ও সন্তু লারমার বিরুদ্ধে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা আগে থেকে লিখে আনা বক্তব্য পাঠ করতে শুরু করেন।

উক্ত ২০/২৫ জনের নারীর মধ্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ৪/৫ কর্মী বাদে অবশিষ্ট নারীরা ছিলেন সাধারণ গ্রামবাসী। মানববন্ধন বিষয়ে তারা আগে থেকেই কিছুই জানতেন না বলে অংশগ্রহনকারী অনেক নারী হিল ভয়েসকে জানিয়েছেন। তারা হঠাৎ করে ব্যানারের কদর্য ভাষা দেখে ও নীতি চাকমার আক্রমণাত্মক বক্তব্য শুনে হতচকিত ও শংকিত হয়ে পড়েন বলে জানান। ১২/১৩ মিনিটের মধ্যে বক্তব্য শেষ করে আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা অটোরিক্সার মাধ্যমে আবার শিল্পকলা ঘাটে গিয়ে মানববন্ধনকারীরা বোট যোগে চলে যান।