রাঙ্গামাটির আইন-শৃঙ্খলা সভায় জিওসি’র উস্কানিমূলক বক্তব্যে নেটদুনিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া

0
1400
ছবি: রাঙ্গামাটিতে বক্তব্য দিচ্ছেন ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোঃ সাইফুল আবেদীন

হিল ভয়েস, ২৭ মে ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: গত বুধবার (২৫ মে) রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা সভায় ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোঃ সাইফুল আবেদীন-এর উস্কানি ও হুমকিমূলক এবং উদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের বিরুদ্ধে নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নেটিজেনরা জিওসি’র বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং জিওসি’র মতো সামরিক অফিসারদের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি বিরাজ করছে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না, জুম্মদের জায়গা-জমি বেদখল হচ্ছে, জুম্মরা চরম নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে দিনাতিপাত করছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছে।

আইন-শৃঙ্খলা সভায় জিওসি যা বক্তব্য দিয়েছেন, তার সারমর্ম হলো পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে জনসংহতি সমিতির পালনীয় মাত্র ২টি ধারা রয়েছে। সেই ধারাগুলিও জনসংহতি সমিতি বাস্তবায়ন করেনি। পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ভয় থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। জুম্মরা একটা দল থেকে চারটি দলে বিভক্ত হয়েছে এবং গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভাগ করে চাঁদাবাজি করছে। চাকমাদের শিক্ষিতের হার ৭৩% এবং তারা সরকারের অনুগ্রহে দেয়া কোটা ব্যবস্থায় সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে চলেছে। এছাড়া তিনি জুম্মদেরকে সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধের আহ্বান করেছেন।

সরকার এবং জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে। রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করা হয় এবং এসব পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটনসহ ৩৩টি বিষয় ও কার্যাবলী ন্যস্ত করা হয়েছে। বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য চুক্তির যে প্রধান লক্ষ্য ছিল, সেটা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তাহলে পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি আসবে কীভাবে? গোড়ায় পানি না ঢেলে জিওসি সাহেব আগায় ফল কামনা করছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান ব্যতীত কোন দেশে বা কোন অঞ্চলে শান্তি আসতে পারে না এটা মনে হয় জিওসি’র মতো একজন দাম্ভিক সামরিক কর্মকর্তার পক্ষে বুঝা কখনোই সম্ভব নয়। তিনি পার্বত্য চুক্তি সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন, তা বড়াই করতে গিয়ে বলেছেন যে, সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যকার সংলাপ চলাকালে তার ড্রাফ্ট করার চিঠি জনসংহতি সমিতির রূপায়ণ দেওয়ানের কাছে যেতো। কিন্তু বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে পার্বত্য চুক্তি সম্পর্কে, চুক্তির মূল স্পিরিট ও চুক্তি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার চরম অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তা না হলে তিনি চুক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে এভাবে মনগড়া ও বিকৃত ব্যাখ্যা দিতেন না। জিওসি’র বক্তব্যে চরম জাত্যাভিমান, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জিওসি’র মতো সামরিক অফিসারের কাছ থেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আশা করা যায় না। তারা মূলত অস্ত্রশক্তির তথা পেশিশক্তির উপর নির্ভর করে থাকে। তাই তো তিনি বোকার মতো জুম্মদেরকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করেছেন।

শুক্রজিৎ নামে একজন ব্যক্তি তার ফেসবুকে লিখেছেন, জিওসি সাহেব শুধু পাহাড়িদের চাপিয়ে দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। একটা স্বাধীন দেশে পাহাড়িদেরকে যুদ্ধের আহ্বান জানাতে জিওসি সাহেবের লজ্জা করলো কিনা তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন।

এস চাকমা তার ফেসবুকে বলেছেন যে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শক্তিশালী তো হওয়ার কথা। জিওসি’র এসকল কথাবার্তা থেকে বোঝা যায় যে, সেনাবাহিনীর গায়ের জোর কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেন এখনো সেই পুরনো অবস্থায়ই রয়ে গেছে। জিওসি’র মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বক্তব্যকে ইঙ্গিত করে এস চাকমা আরো বলেছেন, কথায় কথায় স্বাধীনতা নিয়ে গর্ব করার কথা বললে কী হবে, কাজেকর্মে আচরণে সবাই ইয়াহিয়া খান হতে চায়!

দীপায়ন খীসা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হুমকি ধামকি চলছে। উন্নয়নের গালগল্পও উপচে পড়ছে। কিন্তু লামার এই জুমিয়া জনপদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া রাবার কোম্পানির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ আমরা দেখলাম না।

জিওসি’র “কত হাজার আদিবাসী আসবে আসুক, ৩০ মিনিটও তাদের সাথে ঠিকতে পারবে না” বক্তব্যে চাকমা পাপন বলেছেন, জেনারেল সাহেব নিজেই বললেন পাহাড়ের দুর্গমতার কথা। তার বুঝা উচিত ছিল, পাহাড়ে যদি যুদ্ধ হয় সেখানে আধুনিক ট্যাংক, যুদ্ধ বিমান, ড্রোন কোন কাজে আসবে না, যেমনটি আমেরিকার আধুনিক সমরাস্ত্র আফগানিস্তানে কোন কাজে আসেনি। …এই উগ্র বাঙালি জাতিয়তাবাদী মৌলবাদী মানুষগুলোর মনোভাবের কারণে পাহাড়ে এত অশান্তি। তারা চাইনা পাহাড়ে শান্তি আসুক।

সুজন চাকমা বলেছেন, ২০/২১ বছর যুদ্ধ করেও দমন করতে না পারায় রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে। আর এখন বলেন, পাহাড়িরা যুদ্ধ করলে ৩০ মিনিটও টিকতে পারবে না।

লাবন্য কিম নামে আরেকজন ফেসবুকে বলেছেন, তিনি কীভাবে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হলো বুঝলাম না। ভাষণ দিয়েছিলেন যেন হিটলারের মতো। তিনি নিজেই প্রমাণ করলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূল হোতা তিনি নিজেই।

রতন শীল নামে আরেকজন নেটিজেন বলেছেন যে, বর্তমানে সংস্কারপন্থী জেএসএস গ্রুপ, কুকি-চিন গ্রুপ সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত।

দিবাকর নামে একজন বলেছেন, তিনি যে ভয়ের কথা বলেছেন, পাহাড়ের মানুষদেরকে নিজেদের জমি হারানোর ভয় থেকে মুক্তি দিন। সাধারণ জনগণকে সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে মুক্তি দিন।

ব্যবিলন চাকমা বলেছেন, যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বক্তব্য প্রদান করা দরকার সেখানে তিনি অশান্তির প্রস্তাব (যুদ্ধের প্রস্তাব) দিয়েছেন। আরেক নেট নাগরিক প্রশ্ন করেছেন, চাকমারা যে ৭৩% শিক্ষিত তিনি তা কোন পরিসংখ্যানে পেয়েছেন? এতদিন বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বইয়ে ঘেটেও পাহাড়িদের জাতিভিত্তিক তথ্য খোঁজেও পাইনি। তথ্য সন্ত্রাস ও জুম্মদের মধ্যে জাতিগত সংঘাত উস্কে দেয়ার জন্যই জিওসি এভাবে কেবল চাকমাদের টার্গেট করেই উন্নয়ন ইনডেক্স তুলে ধরেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

জিওসি বক্তব্যের প্রতিবাদে ডেনিম চাকমা লিখেছেন, শিক্ষিত করার জন্য আপনারা সেটেলার বাঙালিদেরকে পাহাড়ে নিয়ে যাননি। নিয়ে গেছেন পাহাড়িদের নির্মূল করার জন্য। আপনাদের মত ধর্ষণ, ভুমি দখল, পাহাড়িদের হত্যা করার জন্য। যেমনটা গণহত্যাও চালিয়েছেন, সেটেলার লেলিয়ে দিয়েছেন।

বার্মিজ বর্ণে নিজের প্রোফাইলের নাম লেখা একজন ব্যক্তি লিখেছেন, জুম্ম জাতি যুদ্ধ চায় না। শান্তি চায়। চুক্তির পর থেকে পিসিজেএসএস’এর নেতৃত্বে জুম্মজাতি শান্তিপূর্ণভাবে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার তথা চুক্তির বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করেছে। তাও আজ সেনাবাহিনীরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনের পথ বন্ধ করে পাহাড়ে সেনাশাসন কায়েম করেছে।

বি কে ত্রিপুরা বলেছেন, সিএইচটি ইস্যুতে গণপ্রজাতন্ত্রের বেতনভোগী বাহিনীর কর্মকর্তারাও রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে শুরু করেছে। কারণ দেশের গণতন্ত্র এখন কোমায়।

কোটাকে সরকারের অনুগ্রহ বলে জিওসি’র বক্তব্যের বিরুদ্ধে আরেক নেটিজেন বলেছেন, দেশের নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান গ্রহণ করা কোন অনুগ্রহ নয়, এটা হচ্ছে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বীকৃতি মৌলিক অধিকার। এতবড় সামরিক অফিসার হলেও জিওসি সেই গণতান্ত্রিক অধিকারকেও অনুধাবন করতে চরমভাবে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।