হিল ভয়েস, ২১ মে ২০২৫; রাঙ্গামাটি: আজ ২১ মে ২০২৫ রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’র দিনব্যাপী ২৯তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও প্রতিনিধি সম্মেলন-২০২৫ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা যায়। সম্মেলনে তিন পার্বত্য জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয়, থানা, কলেজ, শহর, ইউনিয়ন কমিটি থেকে প্রায় তিন শতাধিক প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক অংশগ্রহণ করেন।
উক্ত সম্মেলন দুই অধিবেশনে সম্পন্ন হয় বলে জানা যায়।
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার এবং পিসিপি’র বিদায়ী কমিটির অর্থ সম্পাদক টিকেল চাকমার সভাপতিত্বে এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক জিকো চাকমার সঞ্চালনায় এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশনের শুরুতে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামে আত্মত্যাগী বীর শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
প্রথমে অধিবেশনে আর্ন্তজাতিক, জাতীয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সাংগঠনিক অবস্থা ও আর্থিক প্রতিবেদন সম্বলিত সামগ্রিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা।
এই সময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঊষাতন তালুকদার বলেন, প্রথমে আমাদের নিজেকে বুঝতে হবে, তারপর বিপক্ষ শক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। তবেই আমাদের মধ্যে হতাশা আসবে না, আর তখনই আমরা সঠিক পথে আন্দোলন করতে পারবো। বাস্তবতাকে বিবেচনা করে আমাদের কৌশল নির্ধারণ করে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। একটি সমাজে সবচেয়ে সচেতন ও অগ্রগামী অংশ হচ্ছে ছাত্র সমাজ। সমাজ পরিবর্তন ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজের ভূমিকা অগ্রভাগে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনেও সেই শিক্ষিত সমাজ এগিয়ে এসে জুম্ম জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ছাত্র সমাজ একটা ভাসমান শ্রেণি। এই শ্রেণি থেকে জুম্মদের আন্দোলনে সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী উত্থানের ইতিহাসও আছে। আমাদের আন্দোলন হচ্ছে জাতীয় মুক্তির আন্দোলন। এই আন্দোলনে জুম্মদের মধ্যে সকল শ্রেণির ভূমিকা থাকা উচিত। পার্টির আন্দোলনের নীতি-কৌশল বুঝতে না পেরে, উপলব্ধি করতে না পেরে পার্টির বিরোধী শাসকগোষ্ঠীর মদদে অনেক প্রতিক্রিয়াশীল বিভেদপন্থী গোষ্ঠী আমাদের আন্দোলনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু বিভেদপন্থীরা জাতীয় স্বার্থে ঐক্যের পথে এগিয়ে আসেনি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের চিন্তাচেতনায়, আচার-ব্যবহারে সমৃদ্ধ হতে হবে। জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে। কঠোর সংগ্রামে নিজেকে এগিয়ে আনতে আত্মপ্রস্তুতি প্রয়োজন। এর জন্য আগে আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুতি লাগবে। অর্থ-বিত্ত না থাকা ব্যাপার না, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকতে হবে জীবনে। আমাদের ছাত্রসমাজকেও লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। জুম্ম জনগণের এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ছাত্রদের তাদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের এক একজন প্রতিনিধি। পড়াশোনা কিংবা যেকোন কাজের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে অবস্থান করলে সেখানেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার ব্যাপারে উপস্থাপন করে আমাদের আন্দোলনের পক্ষে মিত্র বাড়াতে হবে। জুম্ম জনগণকে অধিকতরভাবে আমাদের আন্দোলনে যুক্ত করতে হবে। এই কাজে ছাত্রসমাজকে প্রধান ভূমিকা রাখা দরকার।
দ্বিতীয় অধিবেশনে পিসিপি’র বিদায়ী কমিটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমার সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল চাকমা। উক্ত অধিবেশনে বিদায়ী কমিটির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সতেজ চাকমা।
দ্বিতীয় অধিবেশনের শুরুতে বিদায়ী কমিটির পক্ষ থেকে ১৩ দফা প্রস্তাবনা পেশ করেন বিদায়ী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা এবং পরবর্তীতে সেই প্রস্তাবনা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জুয়েল চাকমা বলেন, শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণকে নিয়ে কী চিন্তাভাবনা করে, কেমন দৃষ্টিভঙ্গি রাখে সেটা তাদের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। তারা আমাদের ভূমি চায়, কিন্তু জুম্ম জনগণকে চায় না। তারা আমাদের ভূমিতে পর্যটন, বড় বড় ইমারত তৈরি করতে চায়, কিন্তু আমাদের জীবন মানের মৌলিক পরিবর্তন চায় না। জুম্ম জনগণের যে চাওয়া, তার বিপরীতে শাসকগোষ্ঠীর চাওয়ার মধ্যে রয়েছে বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্যের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে আমাদের বিজয় হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে আমাদের তথা জুম্ম জনগণের অভ্যন্তরীণ ভিত্তির উপর।
তিনি আরও বলেন, শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ঐতিহাসিক দমন-নিপীড়ন জুম্ম জনগণ মেনে নিতে পারেনি বলেই আমাদের লড়াই সংগ্রামের উত্থান হয়। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে অনেক ঘাত প্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু সেই বাধা পেরিয়েও জুম্মরা আজ অবধি লড়াই সংগ্রামে অটল। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সেসময় শিক্ষিত, সচেতন তরুণ সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে শাসকের নিপীড়ন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তারা উগ্র জাত্যভিমানী বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জুম্ম জনগণের বঞ্চনার কথা বলার মতো জাতীয় পর্যায়ে কোন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ছিল না। এজন্য তারা উপলব্ধি করেন নিজেদের অধিকারের কথা বলার জন্য নিজেদেরই বলতে হবে। এভাবেই জনসংহতি সমিতি জন্ম লাভ করে। তৎকালীন সময়ে এম এন লারমার ডাকে ‘শিক্ষা গ্রহণ করো, গ্রামে ফিরে চলো’ নীতিতে বিশাল জুম্ম ছাত্র সমাজ জুম্মদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে শরিক হয়।
জুয়েল চাকমা আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে একদিকে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগ্রাম আরেকদিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র সমাজের তীব্র প্রতিরোধে শাসকগোষ্ঠী আমাদের সাথে চুক্তিতে উপনীত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই চুক্তির ২৭ বছরেও বাস্তবায়নের জন্য এযাবৎকালের একটি সরকারও যথাযথভাবে এগিয়ে আসেনি। বর্তমান সময়েও ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকারও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কোন আন্তরিকতা দেখায়নি। পূর্বেকার সরকারসমূহের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ক্যাম্প, পর্যটন ও সেটেলারদের দখলে জুম্ম জনগণ তার নিজ ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য, মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য আমাদের রক্তপিচ্ছিল পথ অতিক্রমের বিকল্প নেই। এই পথ অতিক্রমের জন্য ছাত্র সমাজের অগ্রসর ভূমিকা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন আছে। আজকের এই দিনে ছাত্র সমাজের পূর্বের ন্যায় তাদের ঐতিহাসিক দায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এই কণ্টকময় পথে পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। গিরি-দেবেন-পলাশের উত্তরসূরিরা ইউপিডিএফ নাম ধারণ করে আজকের দিনে জুম্ম জনগণের আন্দোলন সংগ্রামকে নস্যাৎ করে দেওয়ার চেষ্টাকে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে। আমরা আশাবাদী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে যে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিয়েছে সেই ডাকে এই ছাত্র সমাজ দৃপ্ত চিত্তে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে।
দ্বিতীয় অধিবেশনের সভাপতি ও বিদায়ী ২৮তম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরা দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।
কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ২৯তম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে রুমেন চাকমা, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সৈসানু মারমাকে নির্বাচিত করে গঠিত ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট নব নির্বাচিত কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান বিদায়ী কমিটির সহ-সভাপতি খোকন চাকমা।
+ There are no comments
Add yours