পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা চেয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর খোলা চিঠি

হিল ভয়েস, ৬ নভেম্বর ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন: পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা চেয়ে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি খোলা চিঠি দিয়েছে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন”। গতকাল ৫ নভেম্বর ২০২৩ সংগঠনটির দুই যুগ্ম সমন্বয়কারী মানবাধিকার কর্মী জাকির হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক খোলা চিঠিতে এই আহ্বান জানানো হয়।

নিম্নে পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে খোলা চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো –

সম্মানিত জাতীয় নেতৃবৃন্দ,

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন । আপনারা সকলে অবগত আছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম আদিবাসী অধ্যুষিত একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল । স্মরণাতীত কাল থেকে এই অঞ্চলে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে। কিন্তু দেশের সকল জাতিগোষ্ঠীর অবদানে সৃষ্টি হওয়া নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনার সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জুম্ম জাতিসহ দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের পরিচয়কে অস্বীকার করা হয় এবং এইসব সমৃদ্ধ আদিবাসী জাতিসমূহকে তাদের অধিকার ও রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। ফলে এই আদিবাসী জাতিসমূহ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেছে এবং নিজেদের স্বকীয় শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিকাশের মাধ্যমে বহুত্ববাদী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় সামিল হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এমনি এক বাস্তবতায় দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংঘাতের অবসানে ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। দেশের মানুষ আশা করেছিল, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে এইসব আদিবাসী জাতিসমূহকে অস্বীকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র যে ঐতিহাসিক ভুল করেছিল তা থেকে মুক্তির পথ কিছুটা হলেও সমাধান দিবে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনও বাস্তবায়িত হয়নি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে তার অনন্য বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও বিকাশের কাজটি এখনো অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে এখনো ঔপনিবেশিক কায়দায় পাহাড়ী মানুষের উপর সামরিক-বেসামরিক শাসন ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে।

সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ,

পার্বত্য সমস্যাকে জিইয়ে রেখে বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রা সম্ভব নয়, এই মর্মবাণীকে উপলব্ধি করে এবং দেশের সচেতন নাগরিকবৃন্দের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের সম্মিলিত প্রয়াসে ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ বাস্তবায়নে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে একটি প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছে। এই প্লাটফর্মের নানা উদ্যোগ ও আহ্বানে ঢাকাসহ সারাদেশে সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা ইতোমধ্যেই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের চলমান আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের সকল রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের আহ্বান যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন কর্তৃক উত্থাপিত নিম্নলিখিত সাত (৭) দফা বাস্তবায়নে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা রাখুন:

  • পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে এই চুক্তির দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করা;
  • পাহাড়ে সামরিক কর্তৃত্ব ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের স্থায়ী অবসান;
  • আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিকীকরণ ও স্থানীয় শাসন নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক যথাযথভাবে ক্ষমতায়িত করা;
  • পার্বত্য ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত থেকে প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের পুনর্বাসন করে তাঁদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা;
  • দেশের মূলধারার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা;
  • ইউনিয়ন পরিষদসহ সকল স্তরের স্থানীয় সরকারে সমতলের আদিবাসীদের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ ও আদিবাসী জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং;
  • সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা ।

শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ,

দেশের এক দশমাংশ ভূখণ্ডকে ক্রমাগত ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসনের মধ্যে রাখা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের প্রিয় দেশমাতৃকার মূল চেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের পরিপন্থি। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে সেখানকার জুম্ম আদিবাসী জনগণের ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়িয়ে উক্ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিতকল্পে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। রাজনীতিবিদরাই সমাজকে পথ দেখিয়েছেন, নীতির ভিত্তিতে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন । আমরা আশা করি দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের স্ব স্ব দল ও অবস্থান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের পন্থা হিসেবে ১৯৯৭ সালে যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতি চাপ সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নকে বেগবান করার জন্য আপনাদের কাছে নিম্নোক্ত চার (৪) দফা আহ্বান তুলে ধরছি:

১. সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর পক্ষে উত্থাপিত ৭ দফা দাবিনামার আলোকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণা করা;

২. প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের উত্থাপিত সাত (৭) দফা দাবিসমূহ গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা;

৩. রাজনৈতিক দল ও তার সহযোগী সংগঠনসমূহে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আদিবাসী জনগণের বিষয়ে একজন মুখপাত্র ও সাংগঠনিকভাবে সম্পাদকীয় পদ তৈরি করা;

৪. জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহের সকল স্তরে আদিবাসীদের দলীয় মনোনয়ন প্রদান করা ।

More From Author