দুর্গা পূজামণ্ডপে হামলার প্রতিবাদের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে নতুন করে হামলা

0
517
ছবি: চট্টগ্রামে পূজামণ্ডপে হামলার প্রতিবাদ

হিল ভয়েস, ১৭ অক্টোবর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: কুমিল্লার ঘটনার জেরে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ–প্রতিবাদের মধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) ও শনিবার (১৬ অক্টোবর) ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় হিন্দু মন্দিরে হামলা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। হামলায় নোয়াখালীতে একজন ইসকন–ভক্ত নিহত হয়েছে।

নোয়াখালী:

শুক্রবার নোয়াখালীর চৌমুহনীর ব্যাংক রোডে রাধামাধব জিউর মন্দিরে হামলা চালানো হয়। এতে মন্দিরের ফটক ও জিনিসপত্র ভাংচুর করা হয়। মন্দিরের নিচতলায় পূজা উপলক্ষে তৈরি করা প্যান্ডেলসহ সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় তলার প্রতিমার কক্ষসহ প্রতিটি কক্ষে হামলা-ভাঙচুর করা হয়।

এরপর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর দক্ষিণ বাজারের রামঠাকুরের আশ্রমের প্রতিটি কক্ষ হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে। আশ্রমের সামনে দুটি ব্যক্তিগত গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিকে বেগমগঞ্জের হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ ৪৭ জনকে আটক করেছে বলে জানা যায়।

জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব পাপ্পু সাহা বলেন, ‘শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল থেকে চালানো তাণ্ডবে চৌমুহনী শহরের কমপক্ষে ৩০টি দোকান, ৫০টি বাসাবাড়ি ও ১২টি মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

নোয়াখালীর চৌমুহনীতে শুক্রবার হামলা-ভাঙচুরের পর গতকাল শনিবার মন্দিরসংলগ্ন পুকুর থেকে এক ইসকন–ভক্তের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর নাম প্রান্ত চন্দ্র দাস (২৬)। গতকাল সকাল ছয়টার দিকে মন্দিরসংলগ্ন পুকুরে প্রান্ত চন্দ্র দাসের লাশ ভেসে ওঠে বলে জানা যায়।

ইসকন–ভক্তের লাশ উদ্ধারের পর চৌমুহনীতে উত্তেজনা বেড়ে যায়। ইসকন অনুসারীসহ ক্ষুব্ধ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সকালে লাশ নিয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তাঁরা এ সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ফেনী-নোয়াখালী সড়কে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

এদিকে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। চট্টগ্রামে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গতকাল দিনভর মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। এ ছাড়া নগরে আধা বেলা হরতাল কর্মসূচি পালিত হয়।

চট্টগ্রাম:

গত শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রামের প্রধান পূজামণ্ডপ জে এম সেন হলে হামলা চালানো হয়। জে এম সেন হলে হামলার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই ঘটনায় ৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা যায়।

জে এম সেন হলে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল শনিবার নগরে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতাল কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। পরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে।

সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা মনে করি এবং বিশ্বাস করি সবটাই পরিকল্পিত। দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন দিনে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়।

ফেনী:

গত শনিবার বিকেলে ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে কালীমন্দিরের সামনে জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ মানববন্ধন কর্মসূচি শুরু করে। এ সময় পাশের বড় মসজিদ (ফেনী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ) থেকে আসরের নামাজ শেষে বের হওয়া কিছু লোকের সঙ্গে মানববন্ধনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ফেনী শহরের কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি আশ্রম ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়।

মুন্সিগঞ্জ:

শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার রাশুনিয়া ইউনিয়নে দনিয়াপাড়া মহা শ্মশান কালী মন্দিরের ছয়টি প্রতিমা ভাঙচুর করেছে মুসল্লীরা। উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের দানিয়াপাড়া শ্মশানঘাট কালীমন্দিরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দুর্বৃত্তরা মন্দিরে প্রবেশ করে কালী মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে এবং মহাদেব, শ্যামাকালি, মহাদেব সহচারী, নাগিনী, যুগিনীর মূতি ভাঙচুর করে।

বরিশাল:

শুক্রবার দিবাগত রাতে বরিশালের গৌরনদীতে কোরআন অবমাননা করে ফেসবুকের একটি পোস্টে মন্তব্য করার অভিযোগ তুলে মহানন্দ বৈদ্য নামের এক সনাতন ধর্মালম্বী যুবককে পুলিশে দিয়েছে মুসল্লীরা। এদের মধ্যে অতি উৎসাহী একটি অংশ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ধুরিয়াইল কাজিরপাড় সার্বজনীন দুর্গা মন্দির, পাশের হরি মন্দির এবং জগদীশ বৈদ্যর বাড়ির হরি মন্দিরে হামলা চালিয়েব্যাপক ভাঙচুর ও তাণ্ডব চালায়। গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের ধুরিয়াইল কাজিরপাড় গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

ঢাকা:

গত শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজের পর রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে কয়েক শত মুসল্লি মিছিল বের করেন। মিছিলটি পল্টন মোড় হয়ে নাইটিঙ্গেল মোড়ে গেলে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। এ সময় শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। পুলিশকে লক্ষ্য করে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল ছোড়েন। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে।

দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় পুলিশের পাঁচ সদস্যসহ নয়জন আহত হন। সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থল থেকে ১৭ জনকে আটক করে পুলিশ। শুক্রবার রাত ১২টার পর পল্টন ও রমনা থানায় মামলা দুটি করে পুলিশ।

হতাহত:

শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনার জের ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হামলার ঘটনার তালিকা তুলে ধরা হয়। এ সময় লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিজয়া দশমীর দিন নোয়াখালীর চৌমুহনীতে পূজামণ্ডপে যতন কুমার সাহাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। ইসকন মন্দিরের প্রভু মলয় কৃষ্ণ দাসকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। শুক্রবার সকালে ইসকন মন্দিরের পুকুরে উক্ত ইসকন-ভক্তের লাশ ভেসে ওঠে। একই দিনে চট্টগ্রাম মহানগরের জে এম সেন হলেও হামলা হয়েছে। এর আগে চাঁদপুরে হামলায় মানিক সাহা নামে একজন মারা যান।

নিন্দা প্রতিবাদ:

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শনিবার সকালে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি পালন করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুসারী আটটি সংগঠনের ব্যানারে এসব কর্মসূচি পালন করা হয়। আটটি সংগঠন হলো বাংলাদেশ হিন্দু ছাত্র জোট, বাংলাদেশ হিন্দু যুব পরিষদ, শারদাঞ্জলি ফোরাম, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাসংঘ, বাংলাদেশ সনাতন কল্যাণ জোট ও জাগো হিন্দু পরিষদ।

শনিবার বিকেলে জেলা পূজা উদযাপন কমিটির উদ্যোগে কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করা হয়েছে। সম্প্রীতি সমাবেশ করেছে সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগ।

কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাকে নজিরবিহীন ও নিন্দনীয় বলে আখ্যায়িত করেছেন ৩১ জন লেখক, কবি ও সাহিত্যিক। শনিবার এক বিবৃতিতে সহিংসতার ঘটনার নিন্দা জানান তাঁরা। বিবৃতিটি দিয়েছেন অন্যান্যের মধ্যে ইমতিয়ার শামীম, শাহনাজ মুন্নী, আহমাদ মোস্তফা কামাল, কবির হুমায়ূন, শামীম রেজা, আলফ্রেড খোকন, টোকন ঠাকুর, রাজীব নূর, পিয়াস মজিদ প্রমুখ।

কুমিল্লার পূজামণ্ডপে ‘কোরআন অবমাননার’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানের পূজামণ্ডপে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীলদল। শনিবার দুপুরে নীলদলের ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক ড. মো.আব্দুস ছামাদ এবং যুগ্ম-আহবায়ক ড. মো. আবদুর রহিম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই দাবি জানানো হয়।

শনিবার সকালে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘জনতার অবস্থান’ ব্যানারে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক হামলা ও রাজনৈতিক অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধের আহ্বানে এক প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার মানুষের কোনো নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এমনকি মানুষের উৎসবগুলো পর্যন্ত অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ এই সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্ন রেখেছেন সমাবেশের বক্তারা।

১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সুনামগঞ্জের ঝুমন দাশকে ধরে ছয় মাস কারাগারে রেখে দেওয়া হয়েছে। অথচ সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতাদের ধরতে সরকার গড়িমসি করে। হেফাজতে ইসলামকে আশকারা দেওয়া হয়। সরকারের নীতিতেই সমস্যা রয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

সারাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গোৎসবের প্রতিমা ভাংচুর, বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন প্রতিবাদী ‘আলোক প্রজ্জ্বালন’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবার এবং পাহাড় থেকে ঢাবি’তে পড়ুয়া জুম্ম শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ’ এর যৌথ আয়োজনে আজ রবিবার (১৭ অক্টোবর, ২০২১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জগন্নাথ হলের বুদ্ধ মূর্তির সামনে এই মৌন প্রতিবাদী আলোক প্রজ্জ্বালনের আয়োজন করা হয়।