হিল ভয়েস, ১০ জুন ২০২৫, ঢাকা: গত ৯ জুলাই, ২০২৫, বিকাল ৩.৩০ ঘটিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি অডিটোরিয়ামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের আয়োজনে “জুম ম্যাগাজিন প্রকাশনা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব – ২০২৫” অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় শুরুতে সংগঠনটির বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘জুম’ এর চাংক্রান-সাংগ্রাইং-সাংগ্রাই-বৈসু-বিঝু-বিহু-সাংগ্রাই-বিষু-সাংলান-পাতা-থাংগ্রেন ২০২৫ সংকলন এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, ঢাকাস্থ জুম্ম সমাজের প্রতিনিধি ডা: অজয় চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণের কঠিন কাজে আমরা ভূমিকা রাখতে চাই। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে আমরা চলতে চাই। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণের কঠিন কাজটি বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাই। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও নৃগোষ্ঠীদের অধিকার রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কখন সবকিছু ভালো হয়ে যাবে, তারপর সবকিছু করব- সেটি না করে, সমস্ত দূর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে মিলিয়ে চেষ্টা করতে হবে। বহুত্ববাদের জয়গান শুরু করতে হবে। সর্বশেষ তিনি জুম ম্যাগাজিনের প্রশংসা ও শুভ কামনা জানিয়ে তাঁর বক্তব্যের ইতি টানেন।
পাভেল পার্থ বলেন, সরকার ইউক্যালিপটাস আর একাশিয়া গাছ রোপণ নিষিদ্ধ করলেও কিছুদিন আগে বনবিভাগ বান্দরবানের আলিকদমে কলাগাছ, পেঁপে গাছের বাগান উজাড় করে সেখানে ইউক্যালিপটাস আর একাশিয়া গাছ লাগিয়েছে। তার মানে আলিকদমে ম্রোদের এলাকা কি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এলাকা? জাত্যভিমানী বাঙালি রাষ্ট্র পাহাড়ের সেই বার্গী পাখিটিকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে সেই প্লুং, উবোগীত, হেঙরঙ এর সুরকে। জ্ঞানতাত্বিক ছিনতাইয়ের মাধ্যমে আদিবাসী সমাজকে প্রান্তিকতার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার অন্যতম প্রতিফলন এই ‘জুম’ ম্যাগাজিন। আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে জুম্ম তরুণ সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। জাত্যভিমানী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, জুলাইয়ের পরবর্তীতে প্রথম যে পাতাটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে সেটি ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত পাতা। ঔপনিবেশিক গ্যাঁড়াকলে পড়ে আদিবাসী সমাজ আজ বিপন্ন, রুপাইয়া শ্রেষ্ঠার আক্রমণের শিকার হওয়া তার প্রমাণ। লোক দেখানো অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র লুকোচুরি খেলা খেলতে চায়। যার ফলে ক্ষমতার মসনদে বসা শাসকের প্রতি জন্ম নেয় হতাশা, ক্ষোভ। কিন্তু লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া জরুরি। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার নিজস্ব মডেল দাঁড় করাতে হবে।
পল্লব চাকমা বলেন, সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি আমাদের সবাইকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদের পাহাড়ের অনেক জায়গার নাম পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। যেমন: মালছড়ি হয়েছে মহালছড়ি, কেওক্রডং এর নাম হয়েছে ডিম পাহাড়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে আমাদের পাহাড়কে বিদ্রুপভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য ইউনেস্কো ২০২২- ২০৩২ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে হারিয়ে যেতে বসা আদিবাসী ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য এখনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমানে বান্দরবানের রেংমিটচ্য ভাষাকে হারিয়ে যেতে বসেছি। আমরা ঋতুপূর্ণা চাকমাদের জয়জয়কার দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই ঋতুপূর্ণা চাকমাদের উঠে আসা ও সংগ্রামের গল্পগুলোকে কেউ বলে না। আমাদের সবাইকে সেই গল্পগুলো বলতে হবে। আমরা যতই বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে পারব, ততই সুন্দরভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
ডা: অজয় চাকমা বলেন, জুম সংস্কৃতিকে চর্চা ও প্রসারের জন্য এই সংগঠনের সদস্যরা জুম ম্যাগাজিন প্রকাশনা সহ নানান যে উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে, তা সংস্কৃতি ও সাহিত্যমনারই পরিচয়। আমি নিজেও সাহিত্যমনা মানুষ। এই প্রতিষ্ঠানে জুম্ম শিক্ষার্থীদেরকে পাহাড় থেকে শুরু করে ঢাকার রাজপথে আমি সোচ্চার হতে দেখি। আমি তোমাদের সেই তারুণ্যকে বাহবা জানাই। তিনি জুম ম্যাগাজিনের সফলতা কামনা করে তার বক্তব্য সমাপ্ত করেন।
স্বাগত বক্তব্যে সুর্মী চাকমা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত আদিবাসী সংস্কৃতি চর্চা ও প্রসারের একটি প্ল্যাটফর্ম, যা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্বর সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় পাহাড়ে বর্ণাঢ্য সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালনের জন্য ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এই সংগঠনের পদচারণা শুরু হয়। তিনি মাননীয় উপাচার্যের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রধান সামাজিক উৎসবের দিনগুলোতে ক্লাস ও পরীক্ষা না রেখে সেগুলোকে একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ছুটির আওতাভুক্ত করা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদকে তাঁর কার্যপরিধি বিকাশের জন্য টিএসসি ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।
উক্ত আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ এর সহ সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা।
পরবর্তীতে সংগঠনের সদস্যদের পরিবেশনায় ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী গান, নাচ ও মঞ্চ নাটকের মাধ্যেমে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।