ড. আর এস দেওয়ানের আত্মত্যাগ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগাবে: স্মরণসভায় বক্তারা

0
835

হিল ভয়েস, ২৮ জুলাই ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মহান অবদান ও তাঁর আত্মত্যাগে নিপীড়িত-নির্যাতিত মুক্তিকামী মানুষ আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হবে বলে ভার্চুয়াল স্মরণসভায় বক্তারা অভিমত তুলে ধরেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্তর্জাতিক মুখপাত্র ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান গত ২৯ মার্চ ২০২১ যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টারে নিজ এ্যাপার্টমেন্টে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যুতে তাঁর মহান অবদান ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বুধবার ২৮ জুলাই২০২১ সকাল ১১:০০ ঘটিকা থেকে একটি ভার্চুয়াল স্মরণসভার আয়োজন করে জনসংহতি সমিতি।

জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারের সভাপতিত্বে এবং জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরিন কণা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা প্রমুখ। এছাড়াও ড. দেওয়ানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সাবেক সভাপতি জ্যোতিপ্রভা লারমা ও তাঁর জীবনী পাঠ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা’র শোকবার্তা পাঠ করেন দীপায়ন খীসা প্রমুখ।

জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তাঁর শোক বার্তায় বলেন, তাঁর মৃত্যুতে জুম্ম জাতি হারালো এক বিপ্লবী সন্তানকে আর পার্টি হারালো এক আদর্শবান ও নি:স্বার্থ বন্ধুকে। শোক বার্তায় সন্তু লারমা আরো বলেন, তিনি (ড. দেওয়ান) ছিলেন একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক, মানবাধিকার সুরক্ষা কর্মী ও দৃঢ়চেতা সংগ্রামী। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হিসেবে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের পক্ষে তিনি ছিলেন অটুট মনোবলের অধিকারী একজন অতুলনীয় প্রচার সৈনিক। তাঁর নিরলস প্রচারাভিযানের ফলে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে উঠে এবং তা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। তাঁর প্রয়াণে যে শুন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা অপূরণীয়।

ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মৃত্যুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর আত্মীয়বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহমর্মিতাও জানান জেএসএস প্রধান। এছাড়া জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে ড. আর এস দেওয়ানের মহান অবদান ও তাঁর আত্মত্যাগ জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণ চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এবং মুক্তিকামী মানুষ আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হবে বলেও মনে করেন তিনি।

এদিকে স্মরণ আয়োজনে প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, জনসংহতি সমিতি নেতা উষাতন তালুকদার এবং মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬ সালে তাঁর সাথে দেখা করার পর যে বিবরণ দিয়েছেন তা দেখে আমি ভাবছিলাম যে, আমরা একটা দুষ্প্রাপ্য খনি আবিষ্কার করেছি। সেই খনির মধ্যে অনেক মনি মুক্তা আছে। ভোগবাদী সমাজ তাকে ভোগবাদী বানাতে পারেনি। তাঁর সাধক চেতনা ও আদর্শ ক্রমাগত তরুণ প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাঁর আত্মনিবেদন করা ছিল সবসময় জনগণের জন্য। তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা জুম্ম জনগণের জন্য আত্মবলিদান করে গেছেন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য তিনি ‘নেপথ্য নায়ক’ বলেও মনে করেন এই প্রবীণ নেতা।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জন্য তিনি সারা বিশ্বব্যাপী যে প্রচার অভিযান চালিয়েছিলেন তা কোনোমতেই ছোট করা যাবে না। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটি স্মারক গ্রন্থ এবং সচিত্র চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তরুণ প্রজন্মের কাছে আহ্বানও জানান। যে জীবন নিজের নয়, মানুষের-দশের জন্য যাপন করে গেছেন সে জীবনকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

স্মৃতিচারণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সাবেক সভাপতি জ্যোতিপ্রভা লারমা বলেন, ড. আর এস দেওয়ান সম্পর্কে আমার ছোট মামা। ছোটকালে তিনি আমাদের বাড়ীতে থেকে পড়াশুনা করেন। তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তিনি বৃত্তি পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সময় তার সাথে দেখা হত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। বিদেশ গমনের পর তাঁর সাথে পত্রবিনিময় হত এবং তিনি তাঁর স্বজাতির মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাথে আমার একটা অনুষ্ঠানে থাকার সৌভাগ্য হলেও সাক্ষাত পরিচয় হয়নি। মানুষের মানবাধিকারের আন্দোলন একটি বিশ্বজনীন সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে আর এস দেওয়ান অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি আসলে সকল জাতির জন্য বাংলাদেশকে একটি বাসযোগ্য করতে চেয়েছিলেন। সকলের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছিলেন। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে তার মনটা যে দেশে পড়েছিল তা তার কাজ থেকে সেটা বুঝা যায়। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমাকে অনেক গভীরে গিয়ে পড়াশুনা করতে হয়েছে, জানতে হয়েছে। এই গবেষণা করতে যেয়ে দেখেছি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের সর্বাগ্রে বার বার আমি পেয়েছি ড. আর এস দেওয়ানের কথা।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের পরিস্থিতিকে যখন অনুধাবন করা হচ্ছে না, সেই ১৯৭২ সালে সংবিধানে যখন স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে পাহাড়ের নেতারা তখন প্রেস কনফারেন্স করতে চেয়েছিলেন। তখন সেই প্রেস কনফারেন্স করতে দেয়া হয়নি। সেসময় পাহাড়ের নেতারা টাঙ্গাইলে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাষানীর সাথে দেখা করতে যান। সেখানে মাওলানা ভাষানী বলেছিলেন, দেশে যখন তোমাদের কথা শোনা হচ্ছে না, তোমরা বিলেতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংযোগ গড়ে তুলে আন্দোলন সংগঠিত করো। সেই ভাবনা ড. আর এস দেওয়ানের ছিল। কেবল ইউরোপ নয়, পৃথিবীর বহু দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ক্যাম্পেইন গড়ে তোলার কাজটি সমন্বিত করার কাজটি করেছিলেন এই ড. দেওয়ান। তিনি একটা বিশ্বজনীন ক্যাম্পেইনের প্রধান মুখপাত্র এবং তিনি লড়াই করেছিলেন মানুষের অধিকারের জন্য।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের মানুষ তো আকাশের চাঁদ চাননি। তারা চেয়েছিলেন বৈচিত্রের স্বীকৃতি। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে যে ঐক্যতান তার স্বীকৃতির কথা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেছিলেন, সন্তু লারমা বলছেন এবং ড. আর এস দেওয়ানও বলে গেছেন। এই একবিংশ শতাব্দীতে এই স্বীকৃতি না দেওয়া মানে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়া বলেও মনে করেন তিনি। একটা বিশাল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং একটা সময় গিয়ে নিশ্চয় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা বলেন, তিনি জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাধক। দীর্ঘ স্থায়ী সংগ্রামে বিশ্বাসী এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় আশাবাদী মানুষ। তিনি ব্রিটেনের মত দেশে থেকেও কোনো ধরনের হিটার ছিল না, রান্নার ব্যবস্থাও ছিল না। শেষ বয়সে তিনি বৈদ্যুতিক লাইন কেটে স্ট্রিট লাইট নিয়ে চলতেন। এমনি একটা পরিস্থিতিতে তিনি আসলেই কৃচ্ছ্বসাধন করেছেন। তিনি আসলেই কিছ্ইু নেননি। ব্রিটিশ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা নিয়ে কেবল দিয়ে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। স্নেহ কুমার চাকমা, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান বলেন সবাই কেবল দিয়েই গেছেন। তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ কিছুতেই বৃথা যায়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, আমরা এক মহান ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করছি। আমাদের কাছে তিনি এক কিংবদন্তী তুল্য। তাঁকে দেখার সৌভাগ্য না হলেও তাকে নিয়ে অনেক কিছুই জেনেছি। আমরা এমন সময়ে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করছি যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমরা বলি, আমাদের অধিকার আন্দোলনের জন্য যে মূল্যবোধ ও দৃঢ়তা থাকা দরকার সেটাতে আমরা শৈথিল্য দেখতে পাচ্ছি। ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান জনসংহতি সমিতির আন্তর্জাতিক মুখপাত্র কেবল নয়, তিনি আমাদের পাহাড়ের দূত ছিলেন। আমাদের সমস্যাগুলোকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলে ধরার কাজটি তিনি করে গেছেন। এখন অনেকেই এই কাজটি করছেন, কিন্তু এই পথ দেখানোর কাজটিই করে গেছেন ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান। তাঁকে সম্মান জানাতে হলে তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো করে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হবে এবং আন্দোলনকে চালিয়ে নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

সঞ্জীব দ্রং বলেন, ড. দেওয়ানের সাথে আমার দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। অনেকের থেকে জানলাম যে তিনি অদ্ভুত মেধাবী ছিলেন। অনেকের মধ্যে দেশপ্রেম থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁর মত মেধা অনেকের নেই। কাজেই তিনি সেই মেধাকে তাঁর জনগণের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। পাহাড়ের জীবন সংগ্রামের কথাগুলো লিখে যাওয়ার জন্য তিনি তরুণ ও প্রবীণ নেতাদেরও লেখার আহ্বানও জানান তিনি। যারা দেশে-বিদেশে পাহাড়ের মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন, কাজ করছেন তাদেরকে যুক্ত করতে হবে। ড. আর এস দেওয়ানকে নিয়ে আরো অনেক বেশি লেখালেখি হওয়া প্রয়োজন যা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন বলেও মনে করেন তিনি।

ঢাবি শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরিন বলেন, সেই খবংপয্যে থেকে সালফোর্ড। এই জীবনকে যদি দেখতে চাই তাহলে আমরা কিছু শাণিত দিক দেখতে পাই। জনইতিহাসে আমরা দেখেতে পাই অনেক মানুষ নিজেকে লাইম লাইটে রাখতে চান না। কিন্তু আসলে তারাই ইতিহাসে স্থান করে নিয়ে থাকেন। পাহাড়ে যারা শিক্ষা বিস্তারে অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাঙ্গামাটির মাওরুম গ্রামের ‘লারমা পরিবারের’ একটা অবদান আমরা দেখতে পাই। পাহাড়ের বিভিন্ন অজপাড়াগায়ে যারা পড়ছিলেন তাদেরকেও তারা অনুপ্রাণিত করেছিলেন। চিত্তকিশোর চাকমাই এই ড. দেওয়ানকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। কাজেই মাওরুম গ্রামের যে অবদান সেটাও লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন।

তিনি আরো বলেন, তিনি যে দেশের বাইরে গিয়েছিলেন তাঁর একটা গুঢ় উদ্দেশ্য ছিল। সেটা হলো পাহাড়ের পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলে ধরা। যেটা সে সময়ে খুবই প্রয়োজন ছিল। জুম্ম জনগণের স¦াধিকারের জন্য তিনি আজীবন প্রচার চালিয়ে ছিলেন। রামেন্দু শেখর দেওয়ান যে জীবনযাপন করেছিলেন তা পুরো লড়াইয়ে তিনি প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিলেন।

লন্ডনে পিএইচডি থিসিসের কাজে গিয়ে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাথে দেখা হওয়ার স্মৃতি তুলে ধরে ড. জোবাইদা নাসরিন আরো বলেন, মানুষ তার জীবনে অনেক কিছু চায়। ঐশ্বর্য, ক্ষমতা, সম্পদসহ অনেক কিছু চায়। কিন্তু এসবকে পেছনে ফেলে রাজনৈতিক দর্শনকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সাদা-মাটা জীবন গ্রহণ করা এই ক্ষণজন্মা পাহাড়ের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা বলেন, জনসংহতি সমিতির আদর্শকে ধারণ করে তিনি যে আজীবন আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার কার্য চালিয়ে গেছেন সেটাকে আমরা তরুণরা সম্মান ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। পাকিস্তান জমানায় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. খুদরত-ই-খুদার অধীনে চাকরি করার সময় তিনি যে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এবং ডিবি কর্তৃক যে হেনস্তা এবং জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন তার একই চিত্র এখনো পাহাড়ে বিরাজ করছে। এখনো পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠী আমাদের ন্যূনতম রাজনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়নি। করোনা মহামারীর মধ্যেও জুম্ম জনগণ, নিরীহ কৃষক ও ছাত্র সমাজের উপর শাসকগোষ্ঠীর নানা ধরনের নিপীড়ন আমরা লক্ষ করেছি। এমনি বাস্তবতায় আমরা তরুণ ছাত্র-যুব সমাজ ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। ছাত্র জীবন থেকে তিনি যে আদর্শকে ধারণ করে আজীবন জুম্ম জনমানুষের জন্য লড়ে গেছেন তার জন্য আমরা তাঁকে পাঠ করতে পারি।

সভাপতির বক্তব্যে জনসংহতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, ড. দেওয়ানের ডাকনাম কুলকুসুম। কুল হল গোষ্ঠী, কুসুম মানে প্রস্ফুটিত পুষ্প। এই পুষ্পের সুবাস তিনি সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছেন। পাশ্চাত্য জীবনের হাতছানি থেকে ছাড়িয়ে কেবল কৃচ্ছ্বতা সাধন করে, সরকারের ভাতা নিয়েই জীবনকে ধারণ করেছেন। তিনি যে দৃঢ়চেতা এবং আজীবন অবিচল ও সংকল্পবদ্ধ, একাগ্রচিত্রে মনেপ্রাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর আত্মত্যাগ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

শ্রী তালুকদার আরো বলেন, একটা কথা আছে ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড’। কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান তাঁর স্বজাতিকে ভুলেন নাই। তাঁর স্বজাতির মানুষরা যেন স্বাধিকার পায় তার জন্য সারা জীবন কাজ করে গেছেন এই নিভৃতচারী প্রচার সৈনিক ড. দেওয়ান। তাঁর রেখে যাওয়া ডকুমেন্টগুলো পার্টির তরফ থেকে দায়িত্ব নিয়ে সংগ্রহ করা হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি। তাঁর পান্ডুলিপিগুলো সংরক্ষণ করে আগামীর গবেষকদের জন্য কাজে লাগবে বলেও মনে করেন তিনি। পার্বত্য চুক্তি হয়েছে, কিন্তু এখনো সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে হলে এই চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করতে হবে এবং ড. আর এস দেওয়ানের মত নি:স্বার্থভাবে আমরণ কাজ করে যেতে হবে এবং এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে রামেন্দু শেখর দেওয়ানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।

এছাড়া উক্ত আয়োজনে আরো বক্তব্য রাখেন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য চঞ্চনা চাকমা, জাতিসংঘের এমরিপ কাউন্সিলের সহ-সভাপতি বিনোতাময় ধামাই ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক পল্লব চাকমা প্রমুখ।

ড. আর এস দেওয়ান ১৭ জানুয়ারি ১৯৩২ সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলা সদরে খবংপয্যা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়থেকে কেমিষ্ট্রিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করার পর উচ্চতর পড়াশুনার জন্য ১৯৬৭ সালে ৩রা নভেম্বর যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন। এরপর লন্ডনস্থ কুইন্স এলিজাবেথ কলেজ থেকে এমফিল এবং ১৯৮০ সালে সালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি ১৯৭০ দশক থেকে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের স্বপক্ষে প্রচার কার্যে আত্মনিয়োগ করেন যা ক্লান্তিহীনভাবে আমরণ চালিয়ে যান।

সূত্র: প্রেস বিজ্ঞপ্তি