কাপ্তাই ও দীঘিনালায় আশ্রায়ন প্রকল্প, জুম্মদের ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের নতুন ষড়যন্ত্র?

0
1414
ছবি: সংগৃহীত

হিল ভয়েস, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই এলাকায়ও জুম্মদের ভোগদখলীয় ভূমি বেদখল করে একতরফাভাবে আশ্রায়ন প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে সেখানে কয়েকটি বাঙালি পরিবারকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার মেরুং এলাকায়ও জুম্মদের ভূমি বেদখল করে এধরনের আশ্রায়ন প্রকল্প গড়ে তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে, এখন প্রশ্ন উঠছে, এই আশ্রায়ন প্রকল্প পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের ভূমি বেদখল ও স্বভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ এবং বহিরাগত বাঙালি পুনর্বাসনের নতুন ষড়যন্ত্র কিনা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসন ওয়াগ্গা ইউনিয়নের শিলছড়ি পাড়া গ্রামে আশ্রায়ন প্রকল্প গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। গত ১৮ জানুয়ারি ২০২১ উপজেলা প্রশাসন বিনা নোটিশে একতরফাভাবে উক্ত গ্রামের উলামং মারমার মালিকানাধীন ২০ শতক পরিমাণ জায়গায় এই আশ্রায়ন প্রকল্প গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। সম্প্রতি সেখানে তিনটি ঘর নির্মাণ শুরু করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বিকাল ৩:৩০ টার দিকে শিলছড়ি বনফুল মহিলা ক্লাব চত্বরে শিলছড়ি এলাকাবাসী উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক এভাবে জোরপূর্বক বিনা নোটিশে ভূমি বেদখলের প্রতিবাদে এক মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। এতে এলাকার শতাধিক নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করে। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা উপজেলা কর্তৃক উক্ত জায়গায় আশ্রায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার দাবি জানান।

মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী ও ভূমির মালিক উলামং মারমা বলেন, ‘শিলছড়ি বনফুল ক্লাব সংলগ্ন ২০ শতক জায়গাটি গত ৫০ বছর ধরে আমি ভোগদখল করে আসছি। আমি ১৯৯৮ সালের ২১ অক্টোবর রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক বরাবর বন্দোবস্তির আবেদন করি। কিন্তু পার্বত্যাঞ্চলে বন্দোবস্তি কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে এখনো এটা কার্যকর হয় নাই। এমতাবস্থায় স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন গত জানুয়ারি আমার দখলে থাকা ভূমিতে বালু ভরাটের কাজ শুরু করেছে।’

উলামং মারমা আরও জানান, তিনি গত ১৯ জানুয়ারি এ নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেছেন। তার আইনজীবী আদনান রফিকের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। এই সব কিছু তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রশাসন ঘর নির্মাণের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনতাসির জাহান বলেছেন, সরকারের খাসজমিতে ভূমিহীন এবং গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণের অংশ হিসেবে ওখানে এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। ওই জমিটি সরকারের খাস জায়গা। জমিটি এখনো কারো নামে বন্দোবস্তি দেওয়া হয়নি, একটা খাস জমির জন্য যে কেউ আবেদন করতে পারেন, যদি সরকার বন্দোবস্তি না দেয় তাহলে সেটা কারো নামে হতে পারে না। (সূত্র: দৈনিক সমকাল, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১)

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বন্দোবস্তি বন্ধ রয়েছে। কাজেই কোনো প্রকল্পের নামে কাউকে ব্যক্তিগত বন্দোবস্ত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কেবল স্কুল-কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন ২০১৬ সালে গঠিত হলেও বিধিমালা তৈরি না হওয়ায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। (সূত্র: ঐ)

অপরদিকে, সম্প্রতি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দিঘীনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নেও জুম্মদের জমি দখল করে সরকারি অর্থায়নে আশ্রায়ন প্রকল্পের কাজ চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উক্ত প্রকল্পটি ১ নং মেরুং ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম বাচামরং গ্রামে গত ৬ জানুয়ারি ২০২১ থেকে চলমান রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ জানুয়ারি ২০২১ কোনো ধরনের পূর্ব নোটিশ ছাড়া দীঘিনালা উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ উল্লাহ, স্থানীয় ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, এসি ল্যান্ড (ম্যাজিস্ট্রেট), ইউপি চেয়ারম্যান মো: রহমান কবির রতন, সাবেক ইউপি সদস্য মো: আব্দুর রহমান সহ একদল লোক গিয়ে উক্ত জায়গায় পরিমাপ করে চলে আসে। এরপর ৬ জানুয়ারি ২০২১ পরিমাপকৃত জায়গায় বুলডোজার নিয়ে গিয়ে মাটি কাটার কাজ শুরু করা হয়। জানা গেছে, উক্ত আশ্রায়ন প্রকল্পে সরকারি অর্থায়নে প্রাথমিকভাবে ৫০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। উক্ত ৫০ পরিবারের মাধ্যে ৩৫ টি বাঙালি পরিবার এবং ১৫ টি জুম্ম পরিবার রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানতে পেরেছেন।

জানা গেছে, উক্ত প্রকল্পের জায়গাগুলোতে ১৯৮৬ সালের আগে জুম্ম গ্রাম ছিল। তৎসময়ের চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সেটলার বাঙালি এবং সেনাবাহিনীর উৎপাত ও আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য স্থানীয়রা ভারতে ও বিভিন্ন জায়গায় শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তাদেরকে আর নিজ জায়গায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

কাপ্তাই ও দীঘিনালার উভয় জায়গায় আশ্রায়ন প্রকল্পের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙ্গামাটির এক অধিকারকর্মী বলেন, এখন সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক, পাঁচতারা হোটেল, পর্যটন কেন্দ্র, রাবার বাগান ইত্যাদি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সরকারি ও বেসরকারি মহল কর্তৃক জুম্মদের ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের মহোৎসব চলছে। এই আশ্রায়ন প্রকল্পও জুম্মদের ভূমি বেদখল, স্বভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ এবং বহিরাগত বাঙালি পুনর্বাসনের নতুন ষড়যন্ত্র বলেই মনে হচ্ছে।