আলিকদম মাতামুহুরী রিজার্ভে চলছে রমরমা পাথর উত্তোলন, প্রশাসন নীরব

0
496

হিল ভয়েস, ১৯ জানুয়ারি ২০২২, বান্দরবান: নিকট অতীতেও তীব্র স্রোতের জন্য বহুল পরিচিত মাতামুহুরীকে যারা চেনেন তাদের পক্ষে এই নদীতে নাব্য সঙ্কটের খবর হজম করা কঠিন। অথচ এটাই বাস্তবতা। মাত্র দেড়যুগ আগেও যে নদীর ভীতিকর অস্তিত্ব প্রকৃতির রুদ্ররূপের প্রতিফলন হিসেবে গণ্য হতো এখন সেখানে বর্ষা মৌসুম শেষ হতে না হতেই ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’।

মাতামুহুরী নদী বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে সমতলে নেমে এসে কক্সবাজার জেলার ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মাতামুহুরী একান্তভাবেই পার্বত্যাঞ্চালের নদী। স্থানীয় প্রবীন ব্যক্তিদের মতে, এ নদীর আজকের বিবর্ণ দশার জন্য স্থানীয়রাই দায়ী।

সরেজমিন দেখা গেছে, মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তিস্থলে রয়েছে অগুনিত ঝিরি, খাল ও পাহাড়। মাতামুহুরী নদীর দু’তীরে রয়েছে সংরক্ষিত মাতামুহুরী রিজার্ভ। যার আয়তন ১ লক্ষ প্রায় ৩ হাজার একর। আয়তনের দিক দিয়ে এ রিজার্ভ ফরেস্ট এশিয়া মহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃতত্তম রিজার্ভ ফরেস্ট।

বান্দরবানের আলীকদমের মাতামুহুরী রিজার্ভের বিভিন্ন ঝিরি-ঝর্ণা থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন যেন থামছেই না। আর এ কাজে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠেছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তারা আরো বলেন, মাতামূহুরি রিজার্ভ এলাকার ৭নং ওয়ার্ড ছোট বেতি, বড় বেতি, শিল ঝিরিতে রমরমা পাথর উত্তোলন করছে সাংবাদিকের ভাই নজরুল ইসলাম, ফরিদ আলম, মোঃ শাহীন, মোঃ ইউনুছ মিয়া, মোঃ ইউনুছসহ আরো অনেক বড় বিশাল পাথর খেকো সিন্ডিকেট। এই রিজার্ভ থেকে উত্তোলনকৃত পাথরগুলো সরকারি উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত হয়।

প্রতি বছর এভাবে রিজার্ভ এলাকা থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন চললেও প্রশাসনের কাছে নেই সেই পাথর উত্তোলকারীদের তথ্য। প্রশাসন ও বন বিভাগের কানে যায় না পাথর ভাঙ্গার মেশিনের শব্দ, ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের মূল হোতারা।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে অবাধে পাথর উত্তোলনের ফলে শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ঝিরি-ঝর্ণাগুলো। পানি সংকটের কারণে কমছে কৃষি আবাদ। দূর্গম পাহাড়ে বসবাসকারী স্থানীয় আদিবাসী ম্রো, ত্রিপুরা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পড়ছেন পানির সংকটে।

স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে গর্জন কারবারি পাড়ার পাশে শিল ঝিরি, বড় বেতি, ছোট বেতিসহ রিজার্ভ এলাকার বিভিন্ন ঝিরি-ঝর্ণা থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন চলছে। সেখানে উত্তোলন করে রাখা প্রায় ৩০ হাজার ঘনফুট বোল্ডার পাথর মজুত করে রাখা হয়েছে। দিনের পর দিন ও বছরের পর বছর পাহাড়ের বিভিন্ন ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন করলেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে কোনো অদৃশ্য শক্তির কারণে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, উপজেলার খুইল্ল্যা মিয়া চেয়ারম্যান পাড়া এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পাথর খেকো বিশাল সিন্ডিকেট পাথর উত্তোনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।

৪নং কুরুকপাতা ইউপি’র ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার জানান, পাথর উত্তোলনকারীদের বেশ কয়েকবার নিষেধও করেছি। তবুও উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়দের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছে। পাথর উত্তোলনকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় আমরা স্থানীয়রা তাদের কাছে অসহায়।

মাতামুহুরী রিজার্ভ এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন চলছে জানিয়ে কুরুকপাতা ইউপি চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো জানান, ‘আমি গত কয়েকদিন আগে পাথর উত্তোলনের খবর পেয়ে এলাকায় গিয়েছিলাম। পাথর উত্তোলন করছে ঠিক, কিন্তু কারা তুলছে তা জানতে পারিনি। তবে বিষয়টি আমি উপজেলা মাসিক সভায় উত্থাপন করেছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলিকদমের সচেতন নাগরিকরা বলেন, ‘মাতামুহুরী রিজার্ভের মতো এলাকা থেকে বছরের পর বছর পাথর উত্তোলন ও গাছ কর্তন করলেও এদেরকে কেন আইনে আওতায় আনা হচ্ছে না বুঝতে পারছি না। পাথর উত্তোলনকারীর মূলহোতাদের খুঁজে বের করে দ্রুত সময়ে আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।

সচেতন নাগরিক মেন চিং ম্রো বলেন, বন বিভাগ ও মাতামূহুরী রেঞ্জ শুধু নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করে। তারা যদি সঠিক আইন প্রয়োগ করতো তাহলে কেউ রিজার্ভ থেকে পাথর উত্তোলনের সাহস পেত না তারা। অভিযানে যাওয়ার আগে মাতামূহুরি রেঞ্জে কর্মকর্তারা পাথর ব্যবসায়ীদেরকে বলে দেন এবং পরে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানের পরে দেখা যায় সেখানে কোন পাথর খেকো ও শ্রমিক, পাথর ভাঙ্গার ক্রেশার মেশিন দেখেন না বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এইভাবে বার বার পার পেয়ে যান পাথর খেকোরা।

এ ব্যাপারে মাতামুহুরী বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল কাসেম জানান, ‘রিজার্ভ এলাকা থেকে পাথর উত্তোলনের ব্যাপারে তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে নির্বাহী কর্মকর্তা নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা খুব শিগগিরই ওই এলাকায় গিয়ে তদন্ত শুরু করব।’

উল্লেখ্য যে, গত ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ আলিকদম উপজেলায় কর্মরত বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিনিধিরা পাথর উত্তোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে পাথর খেকোরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের উপর হামলা করে মোবাইল ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়াসহ সাংবাদিকদের মারধর করার খবর পাওয়া গেছে পত্রিকার মাধ্যমে। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে এখনো কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি।