আগ্রাসনের করাল গ্রাসের মুখে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী!

0
870
ছবি: সংগৃহীত

সজীব চাকমা

বর্তমান সরকারের আমলে শাসকগোষ্ঠী ও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসকল কর্মকান্ড একযোগে পরিচালিত হচ্ছে তা বোধ হয় ১৯৬০ দশকের কাপ্তাই বাঁধের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ববর্তী সামরিক শাসকদের তান্ডবতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এমনকি সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক পরিচালিত এসব কর্মকান্ড আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব নির্মূলীকরণ কার্যক্রম হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। স্পষ্টত বাংলাদেশে বর্তমানে ‘এক দেশে দুই বা ততোধিক নীতি’ চলমান রয়েছে। দেশের সমতল অঞ্চলে এক নীতি, অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক নীতি, সামরিক শাসনের নীতি, জুম্মদের দমন ও উচ্ছেদ নীতি। বহিরাগত বাঙালি বসতিস্থাপনকারীদের বেলায় এক নীতি, জুম্ম জনগণের বেলায় আরেক নীতি। তবে সমতল অঞ্চলেও আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে দমন, পীড়ন, লুন্ঠন ও উচ্ছেদনীতি থেমে নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মসহ দেশের সমতলের আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আজ পরিষ্কারভাবে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার। এজন্য বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না, পদে পদে দৈনন্দিন নানা ঘটনাই প্রতিনিয়ত এসবের প্রমাণ হাজির করছে। বস্তুত আদিবাসীদের ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কোনো দাবি-দাওয়া ও মতামতই সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র গ্রাহ্য, গ্রহণ ও সম্মান করতে রাজি নয়।

সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের এই আচরণ ও ভূমিকাকে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি, ভূমিকা, আচরণ, মনোভাব, ভাবভঙ্গী, ইশারা-ইঙ্গিত, অঙ্গ-ভঙ্গি, ভাষা, বক্তব্য, কাজের ধরণ, কার্যক্রম, কর্মসূচি ইত্যাদি সবকিছু উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি, পাকিস্তানী শাসকসহ চীন, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকা-আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক স্থানীয় মানুষের উপর অন্যায় আগ্রাসন, আধিপত্য, নির্মম শাসন-শোষণ, লুন্ঠন, উচ্ছেদ ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘৃণ্য কাহিনীকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু শক্তি প্রয়োগের পন্থা, পদ্ধতি ও কৌশলের কিছু পার্থক্য মাত্র। সেই সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের মতই বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ও রাষ্ট্রও আদিবাসী জুম্মদের অধিকার হরণ করে আধিপত্য নিশ্চিত করতে চায়, পদানত করতে চায়, শাসন-শোষণ করতে চায়, ধর্মান্তরিত করতে চায়, নিজভূমিতে পরবাসী করতে চায় এবং তাদের ভূ-সম্পত্তি, ভূখন্ড, প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্য্য, পাহাড়, ঝর্ণা, নদী-ছড়া, জীববৈচিত্র্য, নারী, বাড়ি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, আত্মপরিচয় ইত্যাদি সবকিছু হরণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর এসব করছে তারা দেশ, সরকার, রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্টতা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, (উগ্র) বাঙালি জাতীয়তাবাদ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইত্যাদির নামে এবং এলাকার ও জনগণের উন্নয়ন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সন্ত্রাস দমন, সম্প্রীতি ইত্যাদির দোহাই দিয়ে।

বলাবাহুল্য, সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নজিরবিহীন মিথ্যাচার, অপপ্রচার, প্রচার মাধ্যমের উপর হস্তক্ষেপ, নিয়ন্ত্রণ ও হুমকির কারণে সাদাসিধা চোখে, বাইরে থেকে ও ভাসাভাসাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সাম্প্রতিক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিকে সহজে অনুধাবন করা যায় না। এমনকি খোদ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করেও যারা কেবল ব্যক্তিগত ও নিজস্ব পারিবারিক গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ তাদের পক্ষেও এই নিবিড় আক্রমণাত্মক আগ্রাসনের গ্রাসকে বোঝা কঠিন। বাহ্যিকভাবে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারের প্রবল প্রচার, অপরদিকে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে যথেচ্ছ অপব্যবহার করে বিভিন্ন পেশার ও কর্মক্ষেত্রের জনগণকে ছলে বলে কুটকৌশলে, ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ, নিপীড়ন ও শাসন করা হচ্ছে। মোটকথা সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র যতই নির্যাতন, নিপীড়ন, দমন, মানুষের মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা এবং মানবিক মর্যাদা হরণ করুক, সে বিষয়ে বলার কোনো জায়গা বা মঞ্চ তারা রাখতে চায় না। বলতে গেলে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী যা করতে ও বলতে চায় তাই করতে দিতে হবে, তাই শুনতে হবে ও মানতে হবে। যেন তারা একপ্রকার মাৎস্যনীতি ও নাৎসীনীতিই কায়েম করতে বদ্ধ পরিকর।

সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র যে ঔপনিবেশিক কায়দায় জোরবরদস্তিমূলকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের অধিকার অস্বীকার ও হরণ করে তাদের শাসন, শোষণ, দমন, পীড়ন, নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুকরণ ও উচ্ছেদ এবং শেষ পর্যন্ত জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণ করতে চায় তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল।

আদিবাসী হিসেবে অস্বীকার

বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধিকারী ৫৪টির অধিক যে সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে দেখতে পাওয়া যায় তাদেরকে বহু আগে থেকেই অন্যান্য জাতিগত পরিচয়ের পাশাপাশি ‘আদিবাসী’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে আসছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেই ধরা যাক। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, উক্ত শাসনবিধির তফসিলে উল্লেখিত বিভিন্ন আইনসমূহের মধ্যে দি ইন্ডিয়ান ইনকাম ট্যাক্স এ্যাক্ট ১৯২২, দি ইন্ডিয়ান ফিনান্স এ্যাক্ট ১৯৪১, দ্য ফরেস্ট এ্যাক্ট ১৯৭২, ১৯৮৪ সালের আয়কর আইন প্রভৃতির ক্ষেত্রেও ‘আদিবাসী পাহাড়ি’ (indigenous hillmen) শব্দটি, ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইনে আদিবাসী (aborginal) উল্লেখ করা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে, এমনকী সাম্প্রতিক কালেও সরকারের পক্ষ থেকে এবং সরকারি বিভিন্ন দলিলে বাঙালি জনগোষ্ঠী ব্যতীত বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ‘আদিবাসী’ বলে অভিহিত করা হয়ে আসছিল। শুধু তাই নয়, এযাবৎ মূলধারার বাঙালি সুধীজন, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক, প্রগতিশীল মানুষ প্রায় সকলেই নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষকে আদিবাসী হিসেবেই অভিহিত করে আসছেন। আর বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবি করে বসেনি। জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৯৩ সালকে ‘বিশ্বের আদিবাসী জনগণের আন্তর্জাতিক বর্ষ’, ৯ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ এবং ১৯৯৫ সাল হতে ২০০৪ সাল সময়কে ‘বিশ্বের আদিবাসী জনগণের প্রথম আন্তর্জাতিক দশক’ হিসেবে ঘোষণার পর থেকে বিশ্বের ও দেশের অপরাপর আদিবাসীদের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণও এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে। সেই থেকেই এই পরিচয়টি আরও অধিকতর সামনে আসতে থাকে। বলাবাহুল্য, এদেশে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করা ছাড়াও, জাতিসংঘ নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যাবলী অনুযায়ী নিঃসন্দেহে তারাই আদিবাসী। আশির দশকের মাঝামাঝি জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক গবেষক মার্টিনেজ কোবোও বাংলাদেশে যাদেরকে সরকারি ভাষায় উপজাতি বা ট্রাইবাল বলা হয়ে থাকে তারা ‘আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত’ বলে উল্লেখ করেন।

কিন্তু আদিবাসীদের অধিকার হরণ, পদদলিত ও অস্বীকার করার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি হাস্যকর ও দূরভিসন্ধিমূলক কৌশল বা পন্থা হল আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে অস্বীকার করা। অর্থাৎ সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ভাবখানা এমনÑ দেশে যদি আদিবাসীই না থাকে তাহলে আদিবাসীদের অধিকারের প্রশ্নই ওঠে না, জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ও অনুসরণ করার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের জন্য যে সকল অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, তাতে এদেশে আদিবাসী আছে স্বীকার করলে বর্তমানে যেভাবে চলছে সেভাবে আদিবাসীদের আগ্রাসন চালানো যাবে না, আদিবাসীদের ভূমি, ভূখন্ড, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আত্মপরিচয়, স্বশাসন ইত্যাদির উপর যত্রতত্র, সকাল-বিকাল হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর এ এক অভিনব অস্বীকারের সংস্কৃতি। এটা হচ্ছে- দেখেও না দেখা, জেনেও না জানা, জেগে থেকেও ঘুমিয়ে থাকার ভান করার মত। মরুঝড়ের উটপাখির মত সামান্য আদিবাসী স্বীকৃতির ঝরের মুখ লুকোবার চেষ্টা। কিন্তু আমরা জানি, সেই মরুভূমির উটপাখি শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারে না। বর্তমান সরকারের এজন্য বিচার না হলেও আদিবাসীদের অস্বীকার করার ভূমিকা নিয়ে শেষ পর্যন্ত যে তাকে সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, বঞ্চনাকারী ও নিপীড়কের কলঙ্ক তিলক পড়ে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে তা নিশ্চিত। কারণ এই অস্বীকারের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ এদেশের আদিবাসীদের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অধিকারসমূহ হরণ ও পদদলিত করার প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ডকেই উৎসাহিত করবে। এককথায় আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে অস্বীকৃতি সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের আধিপত্যবাদী নীতি এবং আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার ষড়যন্ত্র বৈ কিছু নয়।

পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন বন্ধ

পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, সেই চুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। এই চুক্তি সম্পাদন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার দেশে-বিদেশে প্রায়ই কৃতিত্বের দাবি করেন। অবশ্যই চুক্তি সম্পাদনের জন্য তাদের এই দাবি প্রাপ্য। কিন্তু দীর্ঘ ২৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির অধিকাংশ বিষয় এখনো অবাস্তবায়িতই রয়ে গেছে। একটি মৌলিক বিষয়ও বাস্তবায়িত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি (জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা হয়নি, নির্বাচন বিধিমালা ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন পূর্বক আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হয়নি, ‘অপারেশ উত্তরণ’ নামক সেনাশাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি, ভূমি কমিশনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেদখল হওয়া জায়গা-জমি জুম্মদের নিকট ফেরত দেওয়া হয়নি, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি, অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিল করা হয়নি, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ প্রদান নিশ্চিত করা হয়নি, চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন করা হয়নি, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বাঙালি সেটেলারদের সম্মানজনক পুনর্বাসন করা হয়নি ইত্যাদি।

বিশেষ করে চুক্তি স্বাক্ষরকারী এই আওয়ামী লীগ সরকার গত ২০০৯ সালে থেকে একনাগাড়ে ১৩ বছরের অধিক সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ রেখেছে এবং মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এমনকি চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক এবং জুম্মদের স্বার্থ পরিপন্থী অহরহ প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে চলেছে। ২০০৯ সালের পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ সালে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধন করা হয় বটে কিন্তু এই আইনের বিধিমালা এখনো প্রণীত হয়নি। যার ফলে ভূমি কমিশন কোনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। আর এই সময়ের মধ্যে দুই একটি সভা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপই দেখা যায়নি। ফলে আদিবাসী জুম্মরা প্রায় আড়াই দশক ধরে গণতান্ত্রিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের পর সরকারের সাথে চুক্তিতে উপনীত হওয়ার পরও সেই চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় তারা তাদের অধিকার ফিরে পায়নি এবং তাদেরকে আবারও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্রকে অবাধে চালিয়ে যাওয়া এবং আবার সংঘাতের পথকে উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পার্বত্য চুক্তি লংঘন

সরকার পক্ষ প্রথম চুক্তির শর্ত লংঘন করে ‘স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র’ প্রদানের এখতিয়ার সার্কেল চীফের পাশাপাশি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মনগড়াভাবে ডেপুটি কমিশনারদেরও সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা দেয়ার মাধ্যমে। ২১ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক চুক্তির শর্ত লংঘন করে এ সংক্রান্ত একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। ঐ সনদপত্র ব্যবহার করে পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা নয় এমন অনেক ব্যক্তি স্থানীয়দের অধিকার খর্ব করে বিশেষত চাকরি, জমি বন্দোবস্ত, ঋণগ্রহণ, ভোটার তালিকাভুক্তি, কোটা ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে চলেছেন। বারবার দাবি করা সত্ত্বেও সরকার এখনো পর্যন্ত তা প্রত্যাহার বা সংশোধন করেনি।

এরপর সরকার কর্তৃক পার্বত্য চুক্তি লংঘনের চেষ্টা দেখা যায় ২০০১ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন’ প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে। এই সময় সরকার আইনটিতে চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক ধারা অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে চুক্তির অন্যতম পক্ষ জনসংহতি সমিতি চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে আইনটি প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলন করতে বাধ্য হয়। প্রায় ১৫ বছর পর বহু সময় নষ্ট করে সরকার ২০১৬ সালে আইনটি সংশোধন এবং চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে প্রণয়ন করে। কিন্তু এরপর বিগত প্রায় ৬ বছরেও সরকার ভূমি কমিশন আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করেনি। সেই ২০১৭ সালে ১ জানুয়ারিতে আঞ্চলিক পরিষদ ভূমি কমিশনের বিধিমালা খসড়া তৈরি করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। অথচ সরকার এখনো তা চূড়ান্ত করেনি। এই হচ্ছে সরকারের চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার হাল। তাহলে কীভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি হবে, সমস্যার সমাধান হবে?

এছাড়াও সরকার চুক্তির বিধান লংঘন করে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শকে উপেক্ষা করে একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০১৪, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ইত্যাদি প্রণয়ন করে। চুক্তি অনুযায়ী ২০০৯ সালে অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু পরে আবার চুক্তি লংঘন করে অধিকাংশ পুনর্বহাল করা হয়। জানা যায়, কিছু প্লট কাগজেকলমে বাতিল করা হলেও এখনো সেসব প্লট লীজ গ্রহীতাদের দখলে রয়েছে। সম্প্রতি বান্দরবানের লামা, আলীকদমসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে এইসব লীজ গ্রহীতাদের প্রায়ই ভূমি নিয়ে বিরোধের খবর পাওয়া যায়। এইসব লীজ গ্রহীতা ভূমিদস্যুদের কর্তৃক আদিবাসীদের ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ করার কথা জানা যায়।

চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং সেনাশাসন প্রত্যাহার হওয়া কথা। জনসংহতি সমিতির তথ্য মোতাবেক ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচশত অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে মোট ১০৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এরপর আর প্রত্যাহার করা হয়নি। উপরন্তু চুক্তি লংঘন করে আরো ২০টির অধিক ক্যাম্প পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। সর্বশেষ সরকার একতরফাভাবে ও চুক্তি লংঘন করে প্রত্যাহারকৃত ক্যাম্পসমূহে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

সেনাশাসন জোরদারকরণ

পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের ন্যায় সামরিক উপায়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের নীতিই গ্রহণ করেছে। জোরদার করা হয়েছে সেনা কর্তৃত্ব, সেনাশাসন, সেনা অভিযান, সেনা হস্তক্ষেপ, দমন, পীড়ন, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, জেল-জুলুমসহ হত্যা পর্যন্ত। সেনাবাহিনীরই ষড়যন্ত্রে জনসংহতি সমিতির অধিকাংশ কেন্দ্রীয় সদস্যসহ জেলা, থানা পর্যায়ের বহু নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় জড়িত করে হয়রানি করা হচ্ছে। রাতে-বিরাতে সন্ত্রাস বিরোধী ও টহল অভিযানের নামে গ্রামে গ্রামে নিরীহ জনগণের বাড়িতে তল্লাসী চালানো হচ্ছে, জিনিসপত্র তছনছ করা হচ্ছে, বাড়ির লোকদের নানাভাবে হয়রানি, হুমকি প্রদানসহ মারধর ও আটক করা হচ্ছে। কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রামকে আবার সেনাকর্তৃত্ব ও সেনাশাসনের হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। বর্তমানে ৪০ জন জুম্ম-এর পেছনে নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সেনা সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। গত ২৫ মে ২০২২ রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা সভায় ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোঃ সাইফুল আবেদীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে ও জুম্মদের বিরুদ্ধে উস্কানি ও হুমকিমূলক এবং উদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, যা ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এসময় তিনি জুম্মদেরকে সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধেরও আহ্বান করেন। তিনি মনগড়াভাবে বলেন, জনসংহতি সমিতি তার পালনীয় চুক্তির মাত্র ২টি ধারাও বাস্তবায়ন করেনি এবং পাহাড়িদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আসো যুদ্ধ করি। তোমরা কয় হাজার আসবে? এক, দুই, তিন হাজার! তোমরা ২০/৩০ মিনিটও টিকতে পারবে না।

গত ৭ জানুয়ারি ২০১৫ নিরাপত্তা বাহিনীর রিপোর্টের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর ১১টি বর্ণবাদী নির্দেশনা জারি করা হয়, যেখানে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী অথবা বিজিবির উপস্থিতিতেই দেশি-বিদেশি ব্যক্তি কিংবা সংস্থা পার্বত্য অঞ্চলে জুম্মদের সাথে সাক্ষাৎ কিংবা বৈঠক করতে পারবে। গত ১৯ জুলাই ২০২২ ‘সদর দপ্তর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিচালকের ০৪.০৭.২০২২ তারিখের ২২ সংখ্যকপত্র’ বরাত দিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক আদিবাসী দিবসের টকশো-তে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এধরনের বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেখানে সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে থাকে। সম্প্রতি সেনাবাহিনী আবার আদিবাসীদের সামাজিক ব্যবস্থায় নগ্ন হস্তক্ষেপস্বরূপ হেডম্যান-কার্বারি সম্মেলন, মুরং সম্মেলন নিয়মিতভাবে আয়োজন করে চলেছে। বিভিন্ন এলাকায় বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের ক্ষেত্রেও নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা ও হয়রানি করে চলেছে।

এছাড়া সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে অনলাইন মিডিয়াসহ সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সংবাদকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা প্রায় সর্বজনবিদিত। বহু অভিযোগ আছে, সেনাবাহিনী ও তাদের মদদপুষ্ঠ কোনো গোষ্ঠী কর্তৃক কোনো মানবাধিকার লংঘন বা গণবিরোধী কোনো ঘটনা সংঘটিত হলে সেসব খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রায়ই সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা বাহিনীর পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ বা সেন্সর করা হয়ে থাকে। এমনকি কোনো কোনো সময় কোনো কোনো সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদকর্মীকে সেনা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে নানা হুমকিসহ নানা নির্দেশনা দেয়া হয়। অভিযোগ পাওয়া যায়, ২০১৭/১৮ সালের দিকে রাঙ্গামাটির সেনা জোনের জনৈক কর্মকর্তা একাধিকবার সাংবাদিকদের তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে যান এবং সাংবাদিকদের সকল মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়ে বলেন, যাই হোক না কেন সেনাবাহিনী ও সেটেলারদের বিরোধী কোনো সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না। এমনকি এজন্য তিনি সাংবাদিকদের ক্ষতি করারও হুমকি প্রদান করেন।

উল্লেখ্য, পার্বত্য চুক্তির পরও সেনাবাহিনী ‘শান্তকরণ প্রকল্প’ নামে কাউন্টার ইনসার্জেন্সী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। এই প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দকৃত ১০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মুসলিম সেটেলারদের সংগঠিতকরণ, গুচ্ছগ্রাম সম্প্রাসারণ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতে ব্যয় করে থাকে।

সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্র

আদিবাসীদের অধিকারের আন্দোলনকে ও তাদের জাতিগতভাবে দূর্বল করার লক্ষে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দাবাহিনী কর্তৃক ‘ভাগ করো, শাসন করো’ কৌশল হিসেবে ইউপিডিএফ, জেএসএস (এম এন লারমা) সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগপার্টি, কুকি-চিন পার্টি, আরএসও, আরসা ইত্যাদি সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টি ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ এক অরাজক পরিস্থিতি ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক এসব গোষ্ঠীকে লালন-পালন ও মদদ দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে, সেই রাষ্ট্রীয় বাহিনীই আবার পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলসমূহ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি করছে বলে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। সেই অজুহাতে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনধারার সকল ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপ করে চলেছে। তাদের এইসব কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপের এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করা এবং চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতি, তার সহযোগী সংগঠন এর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের দমন-পীড়ন করা। সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের মদদেই চুক্তির পরেও বাঙালি সেটেলারদের কর্তৃক জুম্মদের উপর ২০টির অধিক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এসব হামলায়ও বহু জুম্ম নরনারী হতাহত, শত শত বাড়িঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত, ধ্বংসপ্রাপ্ত ও লুটপাটের শিকার হয়। এসব ঘটনার কোনোটিরই যথাযথ বিচার হয়নি।

উন্নয়ন আগ্রাসন

সরকার একদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন বন্ধ রেখে চুক্তি বিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেনাশাসন ও সেনাকর্তৃত্ব জোরদার করেছে, চুক্তির অপর পক্ষ জনসংহতি সমিতির উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে এবং চুক্তির পূর্বের সকল আগ্রাসনকে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে তথাকথিত উন্নয়নের নামে জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। বলাবাহুল্য, চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ নিয়ে স্থাপিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকরকরণ ব্যতীত জুম্মসহ স্থানীয় জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হতে পারে না। তাই স্থানীয় জনগণের যথাযথ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হলে সরকারের কোনো উন্নয়নই আদিবাসীসহ স্থানীয়দের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে না। আদিবাসী বা স্থানীয়দের নামে হওয়া এসব উন্নয়ন শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন আগ্রাসনেই পর্যবসিত হতে বাধ্য।

তেমনিভাবে স্থানীয় জুম্ম জনগণের অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে পদদলিত করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ জনমতকে উপেক্ষা করে, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে লংঘন করে সরকার ও প্রশাসন একতরফাভাবে সাজেক-কমলাক সীমান্ত সড়ক ও থেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সীমান্ত সড়ক (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা) নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে এই রাস্তাটি নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পের নথি অনুসারে উক্ত সীমান্ত সড়কটি ৩১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য হবে। তারই অংশ হিসেবে গত ১০ মার্চ ২০২০ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ আসাদুজ্জামান খান কামাল সাজেকে গিয়ে এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শন করেন। উক্ত প্রকল্পের অধীনে ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন কর্তৃক রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের সিজকছড়া থেকে সাজেক-শিলদা-বেতলিং পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার ও সাজেক-দোকানঘাট-ঠেগামুখ পর্যন্ত ৯৫ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। তার মধ্যে সিজকছড়া থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার কাজ শেষ হয়েছে। উক্ত সড়ক নির্মাণের ফলে জুম্মদের ২১১ পরিবারের ঘরবাড়ি, বাগান-বাগিচা ও ঐতিহ্যগত জুমভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলায় নির্মাণাধীন ঠেগা স্থল বন্দরের সাথে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সংযোগের জন্য রাজস্থলী থেকে ঠেগামুখ পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সড়ক নির্মাণ কাজের ফলে ইতোমধ্যে উক্ত দুই উপজেলায় অন্তত ১২৯ পরিবার জুম্ম ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা-পানছড়ি-দীঘিনালা সীমান্ত সড়ক নির্মাণ ও এলক্ষ্যে পানছড়ির শনখোলা পাড়ায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই সড়কের ফলে অনেক পাহাড়ির জমি ও বাগান বাগিচার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৩০ মে ২০২২ এক স্মারকলিপির মাধ্যমে ১৮৪ জন বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান ও কার্বারী এই সড়ক ও সেনা ক্যাম্প নির্মানের কাজ বাতিল করার দাবির কথা জানান। এসকল উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ ও নেতৃবৃন্দের কোনো মতামতকে যেমনি আমলে নেয়া হয়নি, তেমনি ভুক্তভোগী জনগণের উপর প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি সেই বিষয়টিও উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করা হয়েছে।

উন্নয়ন আগ্রাসনের আরো একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল- স্থানীয় ম্রো জনগোষ্ঠীসহ দেশে-বিদেশে নানা জনের ও সংগঠনের ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝর বয়ে গেলেও সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ কর্তৃক বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুক পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ চালিয়ে যাওয়া। যে ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মিত হলে আদিবাসীদের আনুমানিক ১০০০ একর ভোগদখলীয় ও চাষের ভূমি বেদখল, ৬টি পাড়া সরাসরি উচ্ছেদ এবং ১১৬টি পাড়ার আনুমানিক ১০ হাজার বাসিন্দার ঐতিহ্যবাহী জীবিকা, চাষের ভূমি, ফলজ বাগান, সংরক্ষিত পাড়াবন ও জীববৈচিত্র্য, পবিত্র জায়গা, শশ্মান ঘাট ও পানির উৎসগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে অভিযোগ রয়েছে। এ পর্যন্ত জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও ব্যক্তিত্ব চিম্বুক পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ সরকারের নিকট চিঠি প্রেরণ করেন। প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উন্নয়ন সংস্থা, আদিবাসী সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন নেতা, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এই ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ বাতিল করার দাবি ও আহ্বান জানান। কিন্তু এরপরও সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ তাদের কাজ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

বস্তুত আদিবাসীদের বসতভূমি, জুমভূমি, জমি-জমা, পাহাড়, বাগান-বাগিচা, ঐতিহ্যগত ভূমি ও ভূখন্ড আজ সরকার, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের উন্নয়ন আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আদিবাসীরা অচিরেই নিজেদের ভূমিতে নিজেরাই সংখ্যালঘুতে ও পরবাসীতে পরিণত হবে এবং ক্রমে তাদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়াই জোরদার হবে।

ইসলামীকরণ

পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্টপোষকতায় ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান আমলে। কিন্তু সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশেও ইসলামীকরণের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্টপোষকতা ও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহাযোগিতায় একদিকে অনুপ্রবেশ এবং অন্যদিকে এই ইসলামীকরণ আরো নীরব ও নিবিড়ভাবে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এমনকি ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পরও তা থেমে থাকেনি। সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলিম নয় এমন আদিবাসী কর্মকর্তা কর্মচারী বা জনগণকে জনাব, বেগম পরিচিতি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি রাঙ্গামাটির লংগদুতে সম্প্রতি এক পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক প্রেরিত এক অফিশিয়াল চিঠিতে মামলার এক বাদী আদিবাসীর নামের পূর্বে মোঃ (মোহাম্মদ) ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি পরে তা প্রত্যাহার করেন বলে ফেসবুকে জানান। এছাড়া বিভিন্ন স্থানের নামকরণ এবং এমনকি আগে থেকে প্রচলিত কোন স্থান বা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে বা মুছে দিয়ে এই এলাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত নয় এমন ইসলামী নাম প্রচলন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার বা শাসকগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক আইনে ও বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত আদিবাসী মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার লংঘন বা খর্ব করে চলেছে। যেমন রাঙ্গামাটি শহরের ‘সুখীনীলগঞ্জ’, ‘আমানতবাগ’, ‘মোহাম্মদপুর’ ইত্যাদিসহ আরও বহু স্থানে মুসলিম ব্লক, ‘ইসলামাবাদ’, ‘পাকিস্তান টিলা’ ধরনের নানা স্থানের নাম পাওয়া যাবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌলবাদী ও জুম্ম বিদ্বেষী কিছু ইসলামী গোষ্ঠী কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে আদিবাসীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে। এধরনের পরিকল্পনা বা কার্যক্রম অনেক আগে থেকে শুরু হলেও সাম্প্রতিককালে এর তৎপরতা অনেক জোরদার হয়েছে বলে জানা গেছে। ধর্মান্তরিতকরণের এই প্রক্রিয়া স্থানীয়ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় যেমন চলছে, তেমনি ভালো শিক্ষার প্রলোভন দেখিয়ে আদিবাসী জুম্ম শিশুদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা ত্রিবিউন, ইউএনপিও, বুড্ডিস্টডোর.নেট, হেরাল্ডমালয়েশিয়া.কমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০১০ হতে জানুয়ারি ২০১৭ সালের মধ্যে সাত বছরে কেবল পুলিশ কর্তৃক ধর্মান্তরে জড়িত ইসলামী চক্রের হাত থেকে ৭২ জন আদিবাসী জুম্ম শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে।

১ জানুয়ারি ২০১৮ সালে বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলার থানচি সড়ক ১১ কিমি এলাকায় ১৪টি অসহায় ও গরিব পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার নাম করে গোপনে উপজাতীয় মুসলিম আর্দশ সংঘ ও দাওয়াতে তাবলীগের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে। জানা গেছে, বান্দরবান জেলায় ‘উপজাতীয় মুসলিম আর্দশ সংঘ’, ‘উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংস্থা’ ও ‘উপজাতীয় আর্দশ সংঘ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি সংগঠনের নাম দিয়ে জনবসতিও গড়ে তোলা হয়েছে এবং এসব সংগঠনের মাধ্যমে জুম্মদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের কাজ চালানো হচ্ছে। একটি সূত্রের মতে, বান্দরবান পৌরসভা, আলিকদম, রোয়াংছড়ি, লামাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০টির অধিক জুম্ম মুসলিম পাড়া বা বসতি রয়েছে। এইসব ধর্মান্তরিত জুম্ম মুসলিমদের বলা হচ্ছে ‘নও মুসলিম’ বা ‘উপজাতি মুসলিম’। এই ধর্মান্তরিত মুসলিম বসতিগুলোকে ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করে এবং কিছু বাছাইকৃত নও মুসলিমকে সুবিধা দিয়ে তাদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ধর্মান্তরের কার্যক্রম সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে। আলিকদম উপজেলার থানচি সড়ক সংলগ্ন ১১ কিলোমিটার নামক এলাকায় ধর্মান্তরিত মুসলিমদের নিয়ে ‘ইসলামপুর’ নামে একটি পল্লী গড়ে তোলা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে ‘মুসলিম পাড়া মডেল একাডেমি’। আর এইসব কর্মকান্ড যারা চালাচ্ছেন তাদেরকে স্থানীয় সেনাক্যাম্পের সেনাবাহিনী সহযোগিতা করে থাকে বলে তথ্য রয়েছে।

অস্বীকার, মিথ্যাচার ও অপপ্রচার

সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক আদিবাসীদের অধিকার বঞ্চিত করবার, দমন-পীড়ন করবার, মানবাধিকার হরণ ও লংঘনকে ধামাচাপা দেয়ার, জনগণকে প্রতারিত করবার, চুক্তি বাস্তবায়নের দায়বোধ এড়িয়ে যাবার, দেশের ও বিশ্বের মানুষকে বিভ্রান্ত করবার একটি বৃথা চেষ্টা ও অপকৌশল হচ্ছে অস্বীকার করা এবং গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করা। তাই আদিবাসীদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় এবং আদিবাসীদের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়। তাই সংবিধানে বাংলাদেশের জনগণকে কেবল ‘বাঙালি’ বলে উল্লেখ করে বাঙালি ভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে অস্বীকার করা হয়। এজন্য নানা মিথ্যা যুক্তি খাঁড়া করা হয়। কিন্তু বাস্তবে যেহেতু তাদের অস্তিত্বহীন করা সম্ভব হয় না, তাই যত পারা যায় নিম্নস্বরে অবজ্ঞায় তুচ্ছজ্ঞানে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, ‘সম্প্রদায়’ ইত্যাদি বলে পরিচয়ের ধাঁধা সৃষ্টি করা হয়। সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক প্রতিনিয়ত উন্নয়নের কাহিনী প্রচার করা হয়। কিন্তু সেই উন্নয়ন করতে গিয়ে আদিবাসীদের ক্ষতি হচ্ছে কিনা, অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা, তাদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে কিনা, পাহাড়ের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা, পাহাড়ের আদিবাসীদের জাতীয় অস্তিত্ব হুমকীর মুখে পড়ছে কিনা, সেসব উন্নয়ন পার্বত্য চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে কিনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো সবসময় ক্ষমতার জোরে ধামাচাপা দেয়া হয়। ২৪ বছরেও যে চুক্তির একটি মৌলিক বিষয়ও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না, দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে একনাগাড়ে ক্ষমতায় থেকেও যে চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না সে কথাগুলো স্বীকার করা হয় না। উপরন্তু প্রতিনিয়ত চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে, অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক, ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে বলে নির্জলা মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করা হয়।

শেষ কথা

সরকারের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী এবং পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের সম্পূর্ণ বিপরীত এসব কর্মকান্ড সরকারের ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিরই প্রত্যক্ষ ফল। এটা কোনোভাবে গঠনমূলক এবং এতদঞ্চলের মানুষের ও দেশের সামগ্রিক স্বার্থে সহায়ক বলে বিবেচনা করা যায় না। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের সাথে প্রতারণার সামিল। বলাবাহুল্য, এভাবে আদিবাসীদের অধিকারকে অস্বীকার করে কখনো দেশে সংহতি ও সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। অপরদিকে পার্বত্য সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নেরও বিকল্প নেই। পার্বত্য চুক্তিকে লংঘন করে এবং পার্বত্য চুক্তিতে স্বীকৃত আদিবাসী জুম্মদের অধিকারকে পদদলিত করে কোনোভাবে পার্বত্য সমস্যার সমাধান যেমন সম্ভব নয়, তেমনি যেকোনো উন্নয়ন কর্মকান্ডকেও সুষম ও টেকসই বলে বিবেচনা করা যায় না। সরকারের এই বাস্তবতাটি উপলব্ধি করা জরুরি যে, ষড়যন্ত্র করে কখনো উত্তম সমাধানে পৌঁছা সম্ভব নয়। চুক্তি বাস্তবায়ন ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে আজ যে ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হচ্ছে, তা একদিন নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্রকারীরে জন্য বুমেরাং হয়েই দেখা দেবে। আদিবাসীরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও জাতীয় অস্তিত্বের জন্য লড়াই করেই যাবে। স্বাধীন দেশে এই নির্মম ঔপনিবেশিক আগ্রাসন কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।