হিল ভয়েস, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, রাঙ্গামাটি: ‘সকল প্রকার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে জুম্ম ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হউন’ স্লোগানকে কেন্দ্র করে আজ রোজ শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) রাঙ্গামাটি সদরস্থ উদ্যোগ রিসোর্স সেন্টার হল রুমে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি শহর শাখার ২৭তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত সম্মেলন ও কাউন্সিলে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক উ উইন মং জলি, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সবিনা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি অমিতাভ তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক অন্তর চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সভাপতি কবিতা চাকমা ও পিসিপি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ম্যাগলিন চাকমা প্রমুখ।
এছাড়াও জনসংহতি সমিতি, মহিলা সমিতি, যুব সমিতি, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পিসিপির বিভিন্ন শাখার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
পিসিপি রাঙ্গামাটি শহর শাখার বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত চাকমার সঞ্চালনায় এবং বিদায়ী কমিটির সভাপতি সুরেশ চাকমার সভাপতিত্বে সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপি রাঙ্গামাটি শহর শাখার বিদায়ী কমিটির অর্থ সম্পাদক সুব্রত তঞ্চঙ্গ্যা এবং ২৬তম বিদায়ী কমিটির বিগত এক বছরের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিদায়ী কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সনেট চাকমা।
সম্মেলনে উ উইন মং জলি বলেন, বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদী চিন্তাধারার উত্থান ঘটাতে একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সুপরিকল্পিত ও সূক্ষ্ম কৌশলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য কেবল আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করা নয় বরং আদিবাসীদের বাঙালি মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বিলীন করে দেওয়া।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটি বড় রাজনৈতিক বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। তবে সেই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের আরও বৃহত্তর, সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে জোরালো চাপ সৃষ্টি করতে হবে। মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শ ধারণ করে বর্তমান তরুণদের একেকজন স্ফুলিঙ্গে পরিণত হতে হবে। তাঁর চেতনার বাস্তব রূপ দিতে হলে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের এক অপরাজেয় গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।
তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও জুম্ম জনগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক পরিসরে পরিকল্পিতভাবে ইসলামিক চিন্তাধারা প্রবেশ করাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে একটি ধারাবাহিক ইসলামিকরণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে।
অমিতাভ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ তার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্য অটুট রেখে এগিয়ে চলেছে। তবে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ নানা বাস্তবতায় হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। আন্দোলনের অন্যতম অগ্রপথিক জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা শৈশবকাল থেকে আজীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। তাঁর ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান ছাত্র ও যুবসমাজকে সেই সংগ্রামী চেতনা ধারণ করে আগামীর ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।
সবিনা চাকমা বলেন, পাহাড়ে যাতায়াতের সময় জুম্ম জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারীরা, রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর প্রতিনিয়ত জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানির শিকার হচ্ছে-যা পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সামরিকীকরণের নগ্ন বাস্তবতা তুলে ধরে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছত্রছায়ায় বসতি স্থাপনকারী সেটেলারদের দ্বারা জুম্ম নারী ও শিশুরা প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হলেও এসব ঘটনায় অপরাধীদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সত্তর দশকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে জুম্ম নারীসমাজ যেভাবে মহান পার্টির পাশে থেকে সাহসী ভূমিকা রেখেছিল, বর্তমান সময়েও সেই ঐতিহাসিক ধারাকে অবিচলভাবে এগিয়ে নিতে হবে। জুম্ম নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে নারীসমাজকে আবারও সংগঠিত হতে হবে এবং জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে সম্মুখসারিতে দাঁড়াতে হবে।
অন্তর চাকমা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিরাজমান অরাজক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই গণতান্ত্রিক শূন্যতা পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে নতুন নয়; বরং দীর্ঘদিন ধরেই এটি একটি কাঠামোগত বাস্তবতা হিসেবে জারি রয়েছে। এই দমবন্ধ করা অরাজকতা থেকে মুক্তির পথ রচনার জন্য ছাত্রসমাজের সামনে আর অপেক্ষার সুযোগ নেই-যুগোপযোগী করণীয় নির্ধারণ করে সংগ্রামের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার সময় এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তিনি আরও বলেন, জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ হিসেবে স্বীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আন্দোলনকে সীমিত পরিসর থেকে বের করে এনে বৃহত্তর গণআন্দোলনে রূপ দেওয়ার ঐতিহাসিক মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে। জাতির এই ক্রান্তিকালীন সন্ধিক্ষণে আন্দোলনের কাণ্ডারী হিসেবে তারুণ্যের অদম্য শক্তিকে জাগ্রত করতেই হবে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া সচেতনতা, দৃঢ় প্রত্যয় ও সংগ্রামী ঐক্যের মাধ্যমেই এই আন্দোলন নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। এই বাস্তবতায় তারুণ্যের শক্তিকে সংগঠিত ও দিশানির্দেশিত করে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
ম্যাগলিন চাকমা বলেন, পিসিপির প্রসঙ্গ উঠলেই চোখের সামনে ভেসে আসে অধিকারহীন, নিপীড়িত ও শোষিত জুম্ম জনগণের দীর্ঘ যন্ত্রণার ইতিহাস। সমগ্র পৃথিবীতে যত বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, তার অগ্রভাগে সর্বদা ছিল তরুণ্যর অদম্য শক্তি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের তরুণদেরই সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। ৭০-এর দশকের তরুণ প্রজন্ম যেমন তাদের দায়িত্ব পালন করেছে, ঠিক তেমনি বর্তমান প্রজন্মকেও তাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে।
কবিতা চাকমা বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ তাদের লক্ষ্য ও সংগ্রামে অবিচল রয়েছে। জুম্ম ছাত্রসমাজের কাণ্ডারি হিসেবে এই সংগঠন তরুণ প্রজন্মকে নিরন্তর উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তবে বর্তমানে তরুণ ও যুবসমাজের একটি অংশ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে শামিল না হয়ে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার আশায় জাতীয় রাজনীতিতে ভিড়ছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের জন্য একটি বড় অন্তরায়।
সম্মেলন অধিবেশন শেষে অনন্ত চাকমাকে সভাপতি, ইমন চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক এবং সুব্রত তঞ্চঙ্গ্যাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি শহর শাখার ২৭তম কমিটি গঠন করা হয়।
নবগঠিত কমিটির শপথবাক্য পাঠ করান পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক রনেল চাকমা।