পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারহীনতা সংস্কৃতি শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

হিল ভয়েস, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ঢাকা: আজ বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন-এর উদ্যোগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি’র শফিকুল কবির মিলনায়তনে ”পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারহীনতা সংস্কৃতি” শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন-এর সদস্য দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় এবং যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন-এর যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন হক, টিআইবি‘র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা এবং বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান প্রমুখ।

আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭৬-৯৭ পর্যন্ত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের উপর কমপক্ষে ১৬ টি গণহত্যা পরিচালিত হয়। এসব গণহত্যায় দুই দশকে কমপক্ষে ১ লক্ষ লোক ভারতের পার্শ্ববর্তী রাজ্য ত্রিপুরায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় এবং তাদের বহুলাংশেই নিজেদের বাস্তুভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (১৯৯৮-২০১১) ও কাপেং ফাউন্ডেশন (২০১২-২০২৪) এর তথ্যানুসারে বিগত ২৭ বছরে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন সর্বমোট ৯,১৬২ জন। এসবের মধ্যে নারী ও শিশুর উপর সহিসংসতা সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ৫১৩ টি, ২,৮১৪ টি আদিবাসী বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও মূল্যবান জিনিসপত্র তছনছ করা হয়েছে। ৩,৬২২ পরিবারকেদের হুমকি দেয়া হয়েছে। ভূমিদস্যুদের হামলায় ৬১৬ পরিবারের জীবনযাত্রা বিপন্ন হয়েছে, ৫,৯৬৬ একর ভূমি ভূমিদস্যুরা জবরদখল করেছে। এছাড়া ও ক্যাম্প স্থাপনের নামে ৩১৬ একর ভূমি এবং ২,২০৫ একর জায়গা দখলের জন্য ভূয়া দলিল তৈরি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, উক্ত ঘটনাগুলোর কোনটির সুষ্ঠু ও বস্তুনিষ্ঠ বিচার করা হয়নি। যার ফলে এ ধরণের ঘটনাগুলো বার বার সংগঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই ধরণের কাঠামোগত বিচারহীনতা দূর করতে হলে শুধু নীতি নয়; বরং আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। পার্বত্য চুক্তির ধারাগুলো পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমি কমিশনের পুনঃসক্রিয়করণ, ও একটি স্বাধীন মানবাধিকার তদন্ত কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেসামরিক প্রশাসনের পূর্ণ কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা বাহিনীর দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণমূলক ন্যায়বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। এভাবে বিচারহীনতার অবসান কেবল একটি রাজনৈতিক বা মানবিক প্রশ্ন নয়, এটি রাষ্ট্রের আইনি বৈধতা ও নাগরিক মর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা মানে বাংলাদেশের সংবিধান, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অধিকারসহ মৌলিক মানবাধিকারকে অস্বীকার করার যে খেলা পাকিস্তান আমলে শাসকরা শুরু করেছিলেন সেটি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়েও চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। তদুপরি ঐ অঞ্চলের গণমানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছিল সে চুক্তিটিরও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে যে নতুন বন্দোবস্তের কথা বলা হয়েছে সেখানেও সাধারণ মানুষ, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, অধিকার হারা, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষেরা অনুপস্থিত থেকে গিয়েছে। তাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়গুলো সবসময় উহ্য থেকে গিয়েছে। তিনি বলেন, মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনগুলো যতদিন না রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের চেতনা এবং আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হবে না। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিগত ৫০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের উপর সংগঠিত হত্যা, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে উক্ত ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচারের আহ্বান জানান।

বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, রাষ্ট্রের সকল মানুষের মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ দায়িত্ব যদি রাষ্ট্র সঠিকভাবে পালন করতো তাহলে আজকে আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের নিয়ে আলোচনা করতে হতো না। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনয়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছিল। এ চুক্তি বাস্তবায়নে চুক্তির অপর পক্ষ জনসংহতি সমিতি বা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের পক্ষ থেকে কোন বাধা দেওয়া হচ্ছে না, বরং রাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাবের কারণে এ চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চুক্তির মধ্যে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বশাসনের জন্য ক্ষমতায়ন করা হয়েছিলো সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আজ নির্বাচন হচ্ছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সেখানে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, ভূমি বেদখলসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে আইনের শাসনের পূর্ব শর্ত। তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে দেশের গণমানুষের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান।

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন হক বলেন, দেশের কোন জনগোষ্ঠীকে “সংখ্যালঘু” শব্দটি চাপিয়ে দেওয়ার মানে সেই জনগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার, মানবিক মর্যাদাকে অপমান করা, ছোট করা। অথচ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল মানুষের সমান অধিকার ও মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশেরই একটি অঞ্চল কিন্তু একদিকে সামরিকীকরণ এবং অন্যদিকে গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ে এ অঞ্চলকে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। সামরিকীকরণ আর সীমান্ত রক্ষা দুটি আলাদা জিনিস। সীমান্ত রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী বাহিনী রাখা দরকার কিন্তু সে বাহিনী যেন পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোন ধরণের ব্যাঘাত তৈরী না করে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতি হিসেবে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিইনি। সংখ্যাগরিষ্ঠতন্ত্র যে কতটা আত্মঘাতী তা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান বুঝতে পেরেছিলো। যারা সংখ্যাগরিষ্ট নয় তাদেরকে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ মনে করি। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিলো সে আশা আর এখন দেখতে পাচ্ছি না। তিনি আরো বলেন, এদেশের কোন সরকারের এখতিয়ার নাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করা। সামরিকীকরণ যারা করেছেন সেই সেনাবাহিনী-ই একমাত্র শক্তি যারা চাইলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষদের অধিকার এবং শান্তি আনতে পারেন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে প্রশ্ন করে বলেন, বিগত ৪০ বছরে আপনারা ১০ টি দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে সফলতার সাথে কাজ করেছেন। সারাবিশ্বে যদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে পারেন তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছেন না কেন? তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর যদি সদিচ্ছা থাকে তবে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না, সেনাবাহিনী-ই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন-এর যুগ্ম-সমন্বয়কারী এবং আলোচনা সভার সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, মানবাধিকার বিষয়ক যে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনুস্বাক্ষর করেছে সেগুলোর যে হালনাগাদ করা হয় সেগুলোতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতামত নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দেশের প্রগতিশীল প্রতিযশা মানুষদের আরো এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে আরো অধিক আকারে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তিনি উপস্থিত সকলের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে আরো অধিকতরভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে সভা সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

More From Author