আন্দোলনের ইতিহাসে বিপ্লবী এম এন লারমার ঐক্য তত্ত্ব এখনও প্রাসঙ্গিক

বাচ্চু চাকমা

বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আমাদের জুম্ম জনগণের একতার প্রতীক। ঐক্যের যদি অনন্য উদাহরণ দিতে হয় তাহলে মহান বিপ্লবী এম এন লারমাকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪টি জাতিসমূহের মতপার্থক্যের ভিন্নতা, ভাষা, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বহু কিছু অমিল সেখানে ঐক্যের চেতনা নিয়ে জুম্ম জাতীয়তাবাদকে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহকে একত্রিত করে আন্দোলন সংগ্রাম সূচনা করেন। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নিজ হাতে গড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্দোলন শুরু হয় জুম্ম জাতীয় ঐক্যের চেতনাকে উন্মোচিত করে। তার অর্থ এই, মহান মুক্তির মহান চেতনার বিকাশের পূর্বশর্ত হল জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। এই মহান বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত মহান আদর্শের আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পদযাত্রা। সূচনালগ্নেও ব্যাপক জুম্ম তরুণদের ঐক্যের ভাব-মানস হিসেবে রক্তের শিরা-উপশিরায় প্রগতিশীল আদর্শ চর্চা ও মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলা হয়।

বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত আদর্শের ভিত্তিতে তাঁর সৃষ্টির প্রগতিশীল জুম্ম জাতীয়তাবাদকে বিচার-বিশ্লেষণ করি তাহলে এখানেও জাতীয় ঐক্যের শক্ত ভিত্তি দেখতে পাই। এই জুম্ম জাতীয়তাবাদের চেতনার মধ্যে ঐক্যের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহকে এই প্রগতিশীল জুম্ম জাতীয়তাবাদের সুশীতল ছায়ায় ন্যায় একটা ছাতার নিচে একত্রিত করেছেন। পাংখোয়া, খুমি, লুসাই, ম্রো, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, চাক, ত্রিপুরা, চাকমা, সাঁওতাল, গুর্খা, অহমিয়া- এই ১৪টি জাতির জাতীয় ঐক্যের ভাব-মানস, ঐক্যের চেতনা হল প্রগতিশীল জুম্ম জাতীয়তাবাদ। এই জুম্ম জাতীয়তাবাদ সমগ্র জুম্ম জাতিসমূহের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের অধিকার স্বীকৃতি রয়েছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ সাধন ও সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এই জুম্ম জাতীয়তাবাদের মধ্যে আমাদের সবার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা স্বীকার করা হয়েছে এবং আমাদের সকল জাতিগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও সচেতন। জুম্ম জাতিসমূহের জাতিগত শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য দূরীকরণের কথা সুস্পষ্ট এবং নারীর সম-অধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচারের কথা উল্লেখ রয়েছে। কাজেই জুম্ম জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সত্যিকার প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ। জুম্ম জাতীয়তাবাদ প্রকৃত অর্থে একটা বিপ্লবী চেতনা ও বিপ্লবী চিন্তাধারা যা মানুষের কল্যাণেই সৃষ্ট একটা অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি। এই বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে জুম্ম জনগণের ঘরে ঘরে বিশেষ করে তারুণ্যের মনে জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। এই জাগরণ সৃষ্টি করে ব্যাপক জুম্ম তরুণদের মনের গভীরে ঐক্যের সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজটাই করবে বিপ্লবী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ ব্যাপক জুম্ম তরুণরাই।

উল্লেখ্য যে, বিভেদের ষড়যন্ত্রকে গোগ্রাসে গিলে খেয়ে নয়া যুগের নয়া পার্টি নামধারী সন্ত্রাসী সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ- এর পদযাত্রার সূচনা হয়। বিভাজনের রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে ইউপিডিএফ প্রসিত চক্র পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যা, গুম, অপহরণ, মুক্তিপণ, চাঁদাবাজি, হুমকি, মারধর, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী বাহিনীর কায়দায় চুক্তি বিরোধী ও জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিভেদের জন্মদাতা এই ইউপিডিএফ প্রসিত চক্র নতুন সংস্করণ হিসেবে ‘এগত্তর’ (ঐক্য)- এর নয়া থিওরি জনগণের কাছে হাজির করেন। জুম্ম জনগণকে বোকা বানিয়ে কিংবা ছেলেভুলানো গল্প শুনিয়ে অতি বিপ্লবী রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেন। মুখে মুখে এগত্তরের বলি আওড়ানো হয়, বাস্তবে তাদের চিন্তাধারায় অন্তরালে বিভেদের সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র লুকিয়ে রাখে। ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইউপিডিএফ-এর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্দয় সেনাশাসন বৈধতা পেয়েছে। ইউপিডিএফ প্রসিত চক্র মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীকে প্রোমোট করেছে- তাদের জুম্ম স্বার্থ বিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে সেনাবাহিনী নতুন করে অপারেশন উত্তরণের নামে এক ধরনের সেনাশাসন জিইয়ে রাখার সুযোগ পেয়েছে।

দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে একদিকে জুম্ম জাতিকে বিভাজন করে বিপ্লবীদের প্রাণরস শুষে খেয়েছে, অপরদিকে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে হুমকি, মারধর, হত্যা, গুম, অপহরণ, মুক্তিপণ, ব্যাপক চাঁদাবাজি চালিয়ে যাওয়াতেই মূলত সন্ত্রাসী দমনের নামে সেনাশাসনকে বৈধতা দিয়েছে। ইউপিডিএফ- এর এধরনের অপরিনামদর্শী, সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, বিভেদপন্থী, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, ক্ষমতালিপ্সু ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমের জন্য কার লাভ হলো আর কার ক্ষতি হলো? ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ইউপিডিএফ- এর জুম্ম বিধ্বংসী কার্যক্রম কখনো মেনে নেওয়া যায় না। যে দলের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নেই, আদর্শেরও কোনো বালাই নেই- সেই দল থেকে মানুষ কি আশা করবে? ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টির জন্য দায়ী হলো ইউপিডিএফ। ইউপিডিএফ- এর মধ্যে আদর্শের কোন বালাই না থাকাতে জুম্ম জনগণের সাথে একতা সম্ভব নয়। এই আদর্শগত পার্থক্যের কারণে জনসংহতি সমিতির সাথে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা টানা হয়েছে। প্রসিত বিকাশ খীসা তার পদলেহনকারী নেতা-কর্মীরা প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদের ভাব-মানসই লালন করে। ফলে জুম্ম জনগণের সাথে ইউপিডিএফ- এর একতার পরিবর্তে যোজন যোজন দূরত্ব রয়ে গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে প্রসিত বিকাশ খীসার দুষ্টচক্রের পার্থক্য রয়েছে বিশাল। পার্থক্য মানে হল দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বকে জাতিগত আবেগ দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝানোর হয়। জাতিগত আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বকে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত হিসেবে তুলে ধরা হয়। রাজনীতির গোড়ার কথা ভুলে গিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়। এই দ্বন্দ্ব হল প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল তথা গভীরভাবে বিচার করলে দুই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। কাজেই এটা ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব নয়, প্রকৃত অর্থে এটা একটা আদর্শগত দ্বন্দ্ব। এটা ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, সত্য ও মিথ্যার সাথে দ্বন্দ্ব, ভাল ও মন্দের সাথে দ্বন্দ্ব। ইউপিডিএফ প্রসিত চক্র এযাবৎ ধরে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি, হানাহানি ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত প্রচার করে গলা ফাটিয়েছে। এটা কেবল সস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জনের উদ্দেশ্যে জাতিগত আবেগকে কাজে লাগিয়েছে।

এই দ্বন্দ্বকে জাতিগত আবেগ দিয়ে বিচার করা যায় না। জাতিগত আবেগ দিয়ে বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এই জাতিগত আবেগ এক পর্যায়ে আপোষ করে। সেজন্য জাতিগত আবেগকে যদি প্রগতিশীল আদর্শের আলোকে চালিত করতে না পারেন তাহলে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল করা সম্ভব নয়। ইউপিডিএফ ও পিসিজেএসএস এর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিরসনে দ্বন্দ্বের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে আমাদের পার্টি বহুবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আদর্শের পরিমাণ গুণগত দিক থেকে বেশি দূরে হওয়াতে ঐক্যের টেবিল বারবার ভেঙে গেছে। ইউপিডিএফ নিজেরাই ঐক্যের টেবিল থেকে সরে গিয়ে নিজেকে বরাবরই মীরজাফর হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। মনগড়া ও বাস্তব বিবর্জিত যুক্তি উপস্থাপন করে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করে আসছে এযাবৎ ধরে। ঐক্যের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের পার্টি ও জুম্ম জনগণ বহুবার প্রতারিত হয়েছে যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল সাক্ষী রয়েছে। তারপরও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আশা-ভরসা নিয়ে ঐক্যের টেবিলে বসতে চেষ্টার কোন কমতি রাখেনি পিসিজেএসএস। প্রকৃত অর্থে ইউপিডিএফ- এর এগত্তরের নমুনা হল বিভেদের ষড়যন্ত্রকে আরও জোরদার করে জুম্ম জনগণের কাছ থেকে সস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জন করা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

অতীতে বিভেদপন্থী চক্র পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনকে শক্তিশালী একটা জাতিগত আবেগ হিসেবে ধরে নিয়ে নীতিগতভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি লড়াই সংগ্রামের আওয়াজ তুলে ছিলেন। তারা মনে করতেন, ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক বন্ধু শক্তির বা বাইরে শক্তির মাধ্যমে যতদ্রুত সম্ভব যুদ্ধের ইতি টানা যায়। ইউপিডিএফ প্রসিত চক্রকেও একই নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করতে আমাদের চোখে পড়ছে। এইসব গোঁয়ারগোবিন্দরা মানব সমাজের শ্রেণি-সংগ্রামকে বিচার করতেন আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার পরের সংগ্রাম হিসেবে। অথচ আমাদের আদর্শ সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন, শ্রেণি-সংগ্রাম হল একটা চলমান প্রক্রিয়া যা শেষ হবে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে। একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত পার্টির কঠোর তত্ত্বাবধান ও চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এটা অর্জন করা সম্ভব। দৃষ্টিভঙ্গি, মতপার্থক্য ও আদর্শিক ভিন্নতার কারণে বিভেদের উৎপত্তি হয়। গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র যেমনি, প্রসিত-সঞ্চয়-রবি শংকরদের রাজনৈতিক চরিত্রও তেমনি।

এই প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোর চরিত্র আসলেই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আজ এই বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ, বিপদগামীতা ও ক্ষমতালিপ্সুর কারণে বিভক্তিকে আরও বড় করে তুলেছে। বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে রঙিন চশমা পড়ে বিভেদের নাটকীয় খেলাটা উপভোগ করছে। এই বিভক্তি বার বার আমাদের জুম্ম জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বিপ্লবী গেরিলাদের যুদ্ধের সক্ষমতা প্রাণরস শুষে নিচ্ছে। একজন জাতীয় বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতক প্রসিত বিকাশ খীসার কারণে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সমগ্র জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার স্বার্থে এই উপলদ্ধিটুকু যেন ইউপিডিএফ- এর নেতা ও কর্মীদের মনে উদয় হয় যে- ঐক্যবদ্ধ শক্তিতেই জুম্ম জাতির মুক্তি আসবে। কার নেতৃত্বে ঐক্য হবে, কোন আদর্শ ও ইস্যুর ভিত্তিতে ঐক্য হবে এবং ঐক্যের ফর্মূলা কি হবে? কাজেই আপনার, আমার কিংবা সবার বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত মতামত, সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সৎ সাহস থাকতে হবে। জুম্ম তরুণরাই ঐক্যের অনন্য উদাহরণ হয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের মূলধারাকে অবশ্যই বেছে নেবেন- এটাই আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।

তৎকালীন সময়ে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্ররা পার্টির মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমত হতে পারেনি। পার্টির মৌলিক বিষয়ে যদি একমত হতে পারতো তবেই ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব হতো। আমার বিচারে প্রথমতঃ দলীয় আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দলের ঐক্যবদ্ধ বিষয়ে সম্মত হতে পারেনি তারা, দ্বিতীয়তঃ দলের নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে পারেনি এবং সর্বশেষ দলের আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য থাকতে পারেনি। ঐক্যের টেবিলে লোকদেখানো ঐক্যমত পোষণ করলেও বৈঠকের ৫০ দিনের মাথায় গভীর রাতে কাপুরুষোচিত সশস্ত্র আক্রমণ করে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সর্বশেষ পর্যন্ত বিপ্লবী এম এন লারমার প্রদর্শিত জুম্ম জাতীয় ঐক্যের ফর্মূলা অনুসরণ করে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র আপন হতে পারেনি। এজন্যই প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থীরা জুম্ম জনগণের কখনো আপন হয় না- এটাই ইতিহাসের বাস্তব ঘটনা। পিসিজেএসএস-  এর ঐক্য বিষয়ে কোনো দুর্বলতা নেই। বরঞ্চ ঐক্যের ফর্মূলা যারা অনুসরণ করে না, পদ্ধতি বহির্ভূত মনগড়া ও বাস্তব বিবর্জিত যুক্তি উপস্থাপন করে এবং নতুন সংস্করণ নিয়ে ঐক্যের ফর্মূলা বাজারে হাজির করেন, তারাই মূলত ঐক্যের নামে অনৈক্যের চোরাবালিতে ডুব দেন। জুম্ম জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে তাদেরই দুর্বলতা প্রকাশ পায়। মনে রাখবেন, এতো বড় একটা আন্দোলনে ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহকে যেখানে একটা লড়াইয়ের প্লাটফর্মে একত্রিত করতে সাহস রাখেন, সেখানে ঐক্যের বিষয়ে পার্টির কোনো দুর্বলতা থাকতে পারে না। তাই, আসুন ঐক্যের বিষয়ে আহ্বান কেবল পিসিজেএসএসের একার নয়, এটা সমগ্র জুম্ম জনগণেরই আহ্বান।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে জুম্ম জনগণের এই স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরি ধূলিসাৎ করে দিলেন ইউপিডিএফ প্রসিত বিকাশ খীসা। সুদীর্ঘ ২৭ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইউপিডিএফ প্রসিত চক্র আরও নৈরাশ্যময় ও বিপদজনক অবস্থার মধ্যে টেনে নিয়ে গেলেন। প্রসিত চক্রের বিভেদের থিওরিকে লুপে নিয়ে শাসকগোষ্ঠী জনসংহতি সমিতির শত শত সদস্য ও সাধারণ জুম্ম জনগণকে অস্ত্র দিয়ে হুমকি, অপহরণ, মুক্তিপণ, চাঁদাবাজি, হত্যা, চুক্তি বিরোধী ও জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী কাজ করতে ইউপিডিএফকে সাহায্য করল। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত চুক্তি অসম্পূর্ণ ও আপোষ চুক্তি অপআখ্যা দিয়ে ইউপিডিএফ পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেছিল। সেই সঙ্গে ঘোষণা করা হলো ইউপিডিএফ হবে পাহাড়ের ‘নয়া যুগের নয়া পার্টি।’ কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যতই দিন গড়িয়েছে ততই লক্ষ্য করা গেছে ইউপিডিএফ- এর চটকদারী কথাবার্তায় মনে প্রাণে বিশ্বাস করে জীবনপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন যারা, তারা অচিরেই বুঝা গেল যে এটা শুধুমাত্র নিছক ছেলেভুলানো গল্প। এসবই ছিল নিছক প্রতারণা, মিথ্যার ফুলঝুড়ি। প্রকৃতপক্ষে ইউপিডিএফ হচ্ছে একটি ষড়যন্ত্রের কারখানা এবং জুম্ম জাতির ধ্বংসের নীল নকশা বাস্তবায়নের একটি আখড়া মাত্র। ইউপিডিএফ- জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত থাকায় ধীরে ধীরে তাদের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর এমদাদ- এর কাছে ৮৭ দফা সম্বলিত চুক্তিপত্র জমাদান ও নতুন সংস্করণ হিসেবে লোকদেখানো এগত্তরের ফর্মূলা- সবই এখন জুম্ম জনগণের চোখে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ইউপিডিএফ- এর যে সকল নেতা-কর্মী ভুল পথে চালিত হয়েছিলেন, তারা অনেকের মৃত্যু হয়েছে, অনেকের দু-চোখ খুলে গিয়ে তাদের ধ্যান-ধারণা পাল্টিয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল ইউপিডিএফ- এর বিপদগামী পথ থেকে সরে এসে নিজেকে দ্রুত পরিবর্তন করে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে সামিল হয়ে একমুখী আন্দোলন জোরদার করতে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

জুম্ম জাতিকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে সংঘটিত ডজনখানেক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, জুম্ম নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ, জেল-জুলুম, হুলিয়া জারি, অমানবিক নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনার স্টিমরোলার- সবকিছুই আজ আমাদের জুম্ম জাতীয় অস্তিত্বকে চিরতরে নির্মূল করতে এই নীল-নক্সা তৈরি করেছে। মনে রাখবেন, আমাদের জুম্ম জনগণ এখনও হার মানেনি। আমরা প্রমাণ করতে চাই, জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা জন্য জুম্ম জাতীয় ঐক্যই একমাত্র শক্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি কেবল একটা কাগজের দলিল নয়, এটা অর্জিত হয়েছে রক্তের বিনিময়ে। এই চুক্তির জন্যে সমগ্র জুম্ম জনতা গ্রাম-গঞ্জে, পাহাড়ে-জঙ্গলে, লেংটি পড়া অসংখ্য জুমিয়ার খেটে-খাওয়া ভিন্ন ভাষাভাষী গরীব-দুঃখী মানুষ জুম্ম জাতীয়তাবাদের চেতনাকে বুকে নিয়ে নারী-পুরুষ, বয়োবৃদ্ধ ও তরুণ-তরুণী সবাই মিলে লড়েছে। অতীতের ন্যায় আজও লড়ছে একই কায়দা-কৌশলে। প্রত্যেকে নিজ অবস্থান থেকে সকলেই একই স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা করতে লড়াই করে যাচ্ছেন সমানতালে। এটাই তো লড়াই করার একমাত্র মূলমন্ত্র জুম্ম জাতীয় ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ।

বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জুম্ম জনগণের এই লড়াই সংগ্রাম ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনী, আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র ও বোমা-কোনকিছুই আমাদের জুম্ম জনতার শক্তিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আমাদের পার্টিকে অসংখ্য শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনী, গুপ্তচর, স্পাই বাহিনী, আঙ্গুল বাহিনী, মুখোশ বাহিনী, গুগকুরুক বাহিনী, বামায়াতা, ট্রাইবেল পিপল’স পার্টি, যুব সংঘ, সর্বহারা পার্টি, পাকিস্তানপন্থী রাজাকার-মুজাহিদ ও বিভিন্ন ডাকাত দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমাদের আন্দোলনকে দমাতে শাসকগোষ্ঠী এসব বাহিনীকে জেএসএস- এর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল। অসংখ্য ষড়যন্ত্রের পরেও শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত, বঞ্চিত জুম্ম জাতি ও মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এরই পাশাপাশি আমাদের পার্টির ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিভেদপন্থী চক্রদের দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করা হয়েছে। আমাদের মধ্যেকার বিভেদের খেলা উপভোগ করে শাসকগোষ্ঠী বহু বিনোদন নিয়েছে। তবে আমাদের জুম্ম জনগণ জানে, আমরা মরে গেলেও আমাদের জাতিগত পরিচয় বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে।

আমাদের জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, “আজকে জুম্ম জনগণ সংখ্যায় কম হতে পারে। কিন্তু আমরা আমাদের অধিকারের জন্য মৃত্যুকে আমরা জয় করেছি। মৃত্যুকে আমরা ভয় করি না। আমরা আমাদের অধিকারের জন্য জীবিত অবস্থায় মৃত থাকতে চাই না।” নেতার নিখাট দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ থেকে উচ্চারিত হয়েছে এই কথা। তাইতো জুম্ম জনগণের একমাত্র আশা-ভরসার জায়গা দখল করে নিয়ে এককালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা “শান্তিবাহিনী” হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। পার্টির নীতি ও আদর্শের আলোকে নিয়ম-শৃঙ্খলায় এতোটাই উঁচুতে যা জুম্ম জনগণের বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। এই শান্তিবাহিনীর সদস্যরা যেদিকে মার্চ করবে সেদিকের মানুষ নিরাপদে থাকতে পারতো। তাদের চলনে-বলনে, আচার-আচরণে, কথা-বার্তায়, কাজে-কর্মে এবং সবকিছুতে আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন দেখাতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনায়নের লক্ষ্যে কাজ করতেন বলে জুম্ম জনগণ মনে-প্রাণে ভালবেসে এই বাহিনীর নাম দেন “শান্তিবাহিনী”। জুম্ম জনগণের এই বিশ্বাসই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পথ তৈরি করেছে এবং একই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য এখনও লড়ছে নিরন্তর গতিতে।

ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহের নিজস্ব ভূমি, ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় আজ ভূলুণ্ঠিত। আমরা আজও বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ইসলামি সম্প্রসারণবাদের শোষণ ও বৈষম্যের শিকার। আমাদের জুম্ম জাতীয় অস্তিত্বকে যারা স্বীকার করে না, যারা দ্বিধা-বিভক্তির সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র তৈরি করে আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে বার বার, তারা হয়তো ভাবছে জুম্ম জনগণ কখনো ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। অতীতের ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষ যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়, সেদিন দুনিয়ার কোনো অপশক্তিই তাদের থামিয়ে রাখতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের অতীতের গৌরবময় সংগ্রামের সাক্ষী, বিভক্তির পর একটা সময়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হতে পেরেছি। তবে এটাও সত্য যে ততক্ষণে বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক ও বিভেদপন্থী চক্র আমাদের জুম্ম জাতির একমাত্র পথপ্রদর্শক, আলোর দিশারী মহান বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর পরবর্তী ইতিহাস পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে মীরজাফরি জাতীয় বেঈমানদের চিরতরে নির্মূল করা হয়। সমগ্র জুম্ম জনগণের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে আমাদের আন্দোলন তীব্র গতি লাভ করে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জুম্ম তরুণদের কাঁধে ভর করেই এক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে অধিকারের দলিল পেয়েছি। কত শত জুম্ম তরুণের জীবন উৎসর্গ করা হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মরতেও দ্বিধা করেনি এই তরুণ বিপ্লবীরা। তাইতো পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস বার বার প্রমাণ করে যেকোনো জাতির ভবিষ্যৎ বির্নিমাণে তরুণ সমাজের বিকল্প নেই। জুম্ম জাতীয় ঐক্যের আরেক নাম হোক জুম পাহাড়ের বুকে আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ একঝাঁক জুম্ম তারুণ্যের ঐক্য, যারা চলছে অবিরাম, নিরন্তর গতিতে মহান পার্টির নেতৃত্বকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে।

ঐক্যের যথাযথ ফর্মূলা অনুসরণ করে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শক্তিশালী করা সম্ভব। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিভেদের সূচনা হয়- বিভেদের ফর্মূলায় আমাদের জুম্ম জাতির ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে দুর্বল করেছে। এই বিভেদ আমাদের জুম্ম জাতিকে ধ্বংস ছাড়া ভাল কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি। ব্রিটিশদের “ভাগ কর-শাসন কর”, এই অন্যের ধার করা বশংবদ নীতি কার্যকরভাবে এখনও পাহাড়ের নিপীড়িত ও বঞ্চিত জাতিসমূহের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই বিভক্তির ফর্মূলা আমাদের জুম্ম সমাজের চিন্তা জগতে অতি সূক্ষ্মভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমরা সকলেই জানি, এই বিভক্তির অপর নাম হল ধ্বংস ও বিলুপ্তি। এইটুকু জানা সত্ত্বেও প্রসিত চক্র জুম্ম জাতি বিভাজন করে ইউপিডিএফ কেন প্রতিষ্ঠা করলেন? পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বিরোধিতা করে কেন সংগঠন প্রয়োজন হবে? কার স্বার্থে এই সংগঠন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জুম্ম জনগণের হৃদয়কে বিদ্ধ করে তা স্বাভাবিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জাতির একটা অধিকারের সনদ, বিজাতীয় শোষণ ও বঞ্চনা হতে মুক্তির দলিল এবং জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার একমাত্র ভিত্তি-ভূমি এই পার্বত্য চুক্তি। এইটুকু সাধারণ একটা উপলদ্ধি কেন হলো না প্রসিত চক্রের মধ্যে, জানার পরেও শাসকগোষ্ঠীর জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়নের জন্য প্রসিত চক্র কেন বিভক্তির ফর্মূলাকে গোগ্রাসে গিলে ফেললেন? পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিসমূহের নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে কেন ধূলিসাৎ করে দিলেন?

ইউপিডিএফ- এর কারণে জুম্ম জাতিসমূহ কত বছর পিছিয়ে পড়ে রইলেন, কত দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন, কত হিংসা, বিদ্বেষ, ক্ষোভ ও ঘৃণার ঝর্ণাধারা ছড়ালেন জুম্ম জনগণের মধ্যে। জুম্ম জাতির আবেগ এবং বিবেকের সাথে কেন এই প্রতারণা? কেন এধরনের বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতা? রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতা লোভের অন্ধ হয়ে জুম্ম জাতিকে অপূরণীয় ক্ষতি করার অধিকার কারোরই নেই। মানবতাবোধ, বিবেকবোধ ও অনুশোচনাবোধ বলতে কি একবিন্দুও উদয় হয়নি? এটাই কি পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের রূপরেখা ও নমুনা? বিভক্তির অপর নাম কি পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন? বিভক্তির অপর নাম কি ইউপিডিএফ প্রসিত চক্র? গুলি করে কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছেন, বাবা-মাকে করেছেন সন্তানহারা, কত অসংখ্য পুত্রকে করেছেন বাবা-হারা, কত স্ত্রীকে করেছেন স্বামী হারা-এইটুকু কি পুর্ণ স্বায়ত্তশাসন? আমি ইউপিডিএফ- এর প্রত্যেকটি নেতা ও কর্মীদের বিবেকের কাছে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলতে চাই- দীর্ঘ ২৭ বছরে জুম্ম জাতির জন্য কি অর্জন নিয়ে আসতে পেরেছেন? এই সফলতা ও ব্যর্থতার মাপার যন্ত্র হলো প্রগতিশীল আদর্শের আলোকে প্রকৃত রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করা। প্রকৃত রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবেই মূলতঃ বিপদগামীর রাস্তা বেছে নিয়েছেন।

মহান বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মহান উক্তিগুলো ইউপিডিএফ- এর নেতা-কর্মীদের হৃদয়ে স্পর্শ করতে পারেনি, হৃদয়ে স্পর্শ করতে পারেনি বলে শিক্ষা গ্রহণের গুণ নেই, ক্ষমাগুণ নেই ও পরিবর্তিত হওয়ার গুণ নেই। এই তিন গুণের অধিকারী না হলে একজন প্রকৃত বিপ্লবী হওয়া যায় না। প্রকৃত রাজনৈতিক জ্ঞান নেই বলে আজ শিশুসুলভ রাজনীতিকে গ্রহণ করে জুম্ম জাতিকে বিলুপ্তির নরক যন্ত্রণায় নিক্ষেপ করেছেন। আমি অকপটে বলি, দীর্ঘ ২৭ বছরে ইউপিডিএফ- এর অর্জন জিরো! জিরো বললেও বাড়িয়ে বলা হবে মনে হচ্ছে- কেননা, জিরো থেকেও নিচে মাইনাস দিয়ে শুরু করতে হবে! ইউপিডিএফ প্রসিত চক্রের অর্জনের খাতায় শূণ্যস্থান পূরণ করতে হলে অসংখ্য মাইনাস পূরণ করে আগে জিরোতে অবতীর্ণ হতে হবে। এই ব্যর্থতার পাল্লা এতো ভারী করে অতি বিপ্লবের লাল গালিচায় সাত সাগর তেরো নদী কিভাবে পাড়ি দেবেন? জুম্ম জাতির মধ্যে কত বড় ক্ষতি করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। আর নয় বিভেদের ষড়যন্ত্র, এবারে ক্ষমাগুণ, শিক্ষা গ্রহণের গুণ ও পরিবর্তিত হওয়ার গুণ নিয়ে জুম্ম জাতীয় ঐক্যের সুশীতল ছায়ায় চলে আসুন। এটাই আপনাদের ও সমগ্র জুম্ম জাতির জন্য কল্যাণ হবে!

More From Author