-কাঞ্চনা চাকমা
‘আজ মহান এই গণ-পরিষদে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। তাই যেসব নীতির উপর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে চলেছে সেসব নীতি যদি ঠিকভাবে সংযোজিত না হয় তাহলে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে’- কথাটি ব্যক্ত করেছিলেন মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এম লারমা) ১৯ অক্টোবর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে।
বর্তমানে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পদার্পণ করতে যাচ্ছে। দেশের শাসন ব্যবস্থায় অনেক শাসকের পালাবদল হয়েছে কিন্তু খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ তথা দেশের আদিবাসীদের ভাগ্য কি আদৌ পরিবর্তন হয়েছে?
১৯৪৭ সালের পর সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ এইদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্য যে কৃত্রিম স্বাধীনতা হয়েছিল, সেই কৃত্রিম স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল না হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান নামক মুসলিম ধর্মের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠা রাষ্ট্রের সাথে অন্তর্ভুক্তি করা হয়। সেই থেকে পাহাড়ের মানুষদের নতুন ইতিহাসের সূচনা হয় সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং ভুল বুঝাবুঝির মধ্য দিয়ে।
আধুনিক রাজনৈতিক বহুত্ববাদের পক্ষে যুক্তিটি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে পাওয়া গিয়েছিল। যেখানে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লেখকরা অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের প্রভাবে ব্যক্তিদের একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার বিরোধিতা করেছিলেন। ট্রেড গিল্ড, গ্রাম, মঠ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মতো বৈচিত্র্যময় অথচ সুসংহত মধ্যযুগীয় কাঠামোর সামাজিক গুণাবলীর উদ্ধৃতি দিয়ে তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে ‘বহুত্ববাদ’ তার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজের নেতিবাচক দিকগুলি কাটিয়ে উঠতে পারে।
অনুরূপ বর্তমান বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে কি বহুত্ববাদী চেতনার বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয় কি? যে চিন্তার কথা তখনকার গণ-পরিষদে দাঁড়িয়ে বারংবার উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক জাত্যাভিমানি বাঙালি শাসকরা তখন এম এন লারমা কথাসুর বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করার উচিত মনে করেননি। তিনি তখন জোরালো কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, পাকিস্তান সরকার তথা তৎকালীন মুসলিম সরকার ১৯৫৬ সালে যে সংবিধান রচনা করেছিলেন, সেই সংবিধানকে ১৯৫৮ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব পদাঘাত করে বাতিল করে দিয়ে নিজের ইচ্ছা মতো একটা সংবিধান ১৯৬২ সালে দিয়েছিল। সেই সংবিধানের যে কি অবস্থা হয়েছিল, তাও আমাদের জানা আছে। তাই আমার বিনীত আবেদন যে, আমরা সেই অতীত ইতিহাসের ফল ভাগী যেন না হই।
এম এন লারমা এবং বহুত্ববাদের চিন্তাধারা:
এম এন লারমাকে আমি কোনদিন চোখে দেখিনি। তবে তিনি যে একজন দূরদর্শী, বিরল ও প্রজ্ঞাবান নেতা ছিলেন, তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। তাঁর এককালের অনুসারীরা বহুধাবিভক্ত হলেও অন্তত তাঁর নাম উচ্চারিত হলে সবাইকে নতমস্তক হতে দেখি। সন্দেহ নেই, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণাবলী তাঁকে এক ভিন্ন আসনে উন্নীত করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনো তিনি বৈষম্য-বঞ্চনা-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অগণিত মানুষের রুখে দাঁড়ানোর ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অফুরান প্রেরণার উৎস।
রাঙ্গামাটি শহরের অনতিদূরে মহাপুরম একটি বর্ধিঞ্চু গ্রামের মধ্য দিয়েই ছোট নদী মহাপুরম প্রবাহিত। এই মহাপুরম গ্রামেই জুম্ম জাতির জাগরণের অগ্রদূত, মহান দেশপ্রমিক, নিপীড়িত মানুষের ঘনিষ্ট বন্ধু কঠোর সংগ্রামী, ক্ষমাশীল, চিন্তাবিদ, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু) ১৯৩৯ সালে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তারা পিতা চিত্তকিশোর চাকমা মহাপুরম জুনিয়র হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আর তার মাতা সুভাষিণী দেওয়ানও একজন ধর্মপ্রাণা সমাজ হিতৈষীনি ছিলেন। চার ভাইবোনের মধ্যে এম এন লারমা ছিলেন তৃতীয়।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই স্বীয় সমাজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় এক জনৈক শিক্ষক মহোদয় ইসলামি ইতিহাসের উপর পাঠদানের সময় জুম্ম জাতির জাতীয় ইতিহাসের সম্পর্কে পক্ষপাত দুষ্ট কথা বললে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড়িয়ে শিক্ষক মহোদয়ের প্রতিবাদ করেন এবং শেষ পর্যন্ত মাননীয় শিক্ষক তা সংশোধন করে নিতে বাধ্য হন। বলা যায়, তিনি সংগ্রামী মূখর ছিলেন সেই ছোট্ট বেলা থেকেই।
১৯৫৬ সালেই তিনি সর্বপ্রথম জুম্ম ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫৭ সালের পাহাড়ী ছাত্র সম্মেলনে তিনি এক বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তখন থেকেই অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে উঠতে থাকেন এম এন লারমা। এরপর ১৯৬০ সাল পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত জুম্মদের উপর ধ্বংস করার অন্যতম প্রক্রিয়া চালানো হয়। যেটি কাপ্তাই বাঁধ নামে পরিচিত। এই কাপ্তাই বাঁধ বিরোধিতা করতে গিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি।
কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করার পর ১৯৬৫ সালে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে এবং জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিক চেতনায় উদ্ভুদ্ধ করতে থাকেন আর অপরদিকে পাহাড়ি ছাত্র সমাজকে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। জুম্ম জাতির মুক্তি আন্দোলনে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়ে সহকারী স্কুল শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখনকার সময়ে এই সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা এবং শিক্ষকতার মাধ্যমে মানুষের কাছে যাওয়ার অনন্য সুযোগ কাজে লাগানো ছিল তার পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেছে নেয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য। তিনি শুধু চাকমাদের নিয়ে আন্দোলন করেননি। তিনি ভেবেছেন এই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিন্ন ভাষাভাষী চৌদ্দটি জাতি গোষ্ঠীর কথা। যাদেরকে উগ্র ইসলামিক ধর্মান্ধ স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার ধংস করার জন্য মেতে উঠেছিল। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মধ্যেও যুগ যুগ ধরে সামন্ততান্ত্রিক শাসন শোষণে নিষ্পেষিত হয়ে এসেছিল। এই সামন্ত শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণের জাতীয় বিকাশ ও স্বার্থের দিকে কোনদিন কেউ মনোযোগ দেয়নি।
একমাত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন এই সামন্তীয় গুণে ধরা রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়ে তোলা এবং অধিকার সচেতন ও সুসংগঠিত করা যেন অতি সহজে তারা নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সঠিক পথ খুঁজতে পারে। এমনকি জুম্ম নারী সমাজকেও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার অপরিহার্যতা তিনি গভীরভাবে অনুভব করতেন। জুম্ম নারী জাগরণসহ বাংলাদেশের নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত ব্যাপক নারী সমাজের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন নিরলস সংগ্রামেও ব্যাপৃত ছিলেন। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ অলিতে গলিতে গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিতা মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত নারীসহ বাংলাদেশের আপামর নির্যাতিত মানুষের মুক্তির কথা তিনি তৎকালীন গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদে বার বার তুলে ধরেছিলেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গণপরিষদে যে সংবিধান পাস হয়, তাতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না। উক্ত বাহাত্তরের সংবিধান জাতিবাদী পক্ষপাতিত্ব কারণে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে খর্ব করেছিল। এই জাতিবাদী সাম্প্রদায়িক সংবিধান গত পাঁচ দশকেও কখনই নাগরিকদের প্রতি নিরপেক্ষ আচরণ করতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশকে মুসলমান রাষ্ট্রে পরিণত করার সর্বাথক প্রচেষ্টা চালানো হয় এবং এখনো চলমান রয়েছে।
গণপরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই আগ্রাসী নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি সংবিধানে সব জাতিসত্তার স্বীকৃতির জোর দাবি জানান। কিন্তু একচেটিয়া উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপটের কাছে তা শূন্যে মিলিয়ে যায়। সেদিন বাংলাদেশের নাগরিকদের বাঙালি বলে আখ্যায়িত হওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেন, আমি একজন চাকমা। আমার বাপ দাদা, চৌদ্দ পুরুষ কেউ বলেন নাই, আমি বাঙালি। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদের বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।
তিনি সংবিধান প্রণয়নে উল্লেখ করেন, ‘সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে পড়া ও নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথনির্দেশ করবে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না’ তিনি দেশের শাসন ব্যবস্থায় বারংবার সকল নাগরিকের অধিকারের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের থাবায় বহুত্ববাদ বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল সেইদিন।
সংবিধানে জাতি-জনগণ নাগরিক প্রশ্নে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী। যার দ্বারা দ্বিস্তরের নাগরিকত্ব সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাংলাদেশে সংবিধানের এই দ্বিস্তরকে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। বাংলাদেশি বাঙালি, বাংলাদেশি চাকমা, বাংলাদেশি মান্দি, বাংলাদেশি সান্তাল, বাংলাদেশি মারমা ইত্যাদ-এমন যুগপৎ পরিচয়ে এ দেশের জনগণ পরিচিত হবেন। পাশাপাশি সব জাতিসত্তার ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রতি রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক এভাবেই বিকশিত হওয়ার রেওয়াজ তুলে ছিলেন তিনি বারংবার।
কিন্তু তার কথাকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। বরং সে সময়ে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য আলাদা শাসন ব্যবস্থা ও অধিকার চাইতে গিয়ে এক বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হুমকি দিয়ে বলেছিলেন- ‘লারমা তুমি কি মনে কর। তোমরা আছ ৫/৬ লাখ, বেশি বাড়াবাড়ি করো না। চুপচাপ করে থাক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোমাদেরকে অস্ত্র দিয়ে মারবো না (হাতের তুড়ি মেরে মেরে তিনি বলতে লাগলেন) প্রয়োজনে ১, ২, ৩, ৪, ৫ –দশ লাখ বাঙালি অনুপ্রবেশ করিয়ে তোমাদেরকে উৎখাত করবো, ধ্বংস করবো’।
এই সর্বনাশা ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা অগণতান্ত্রিক পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। যা দীর্ঘ দুই দশক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। এরই মধ্য দিয়ে সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির যুদ্ধের অবসান হয় । আদিবাসীরা তাদের পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি চুক্তির আলোকে সমাধান হওয়ার ওপর ছেড়ে দেন। দুঃখের বিষয় হলো, আজকে ২৮ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো ঊল্লেখযোগ্য কার্যকর অগ্রগতি ঘটেনি। বরং চুক্তির নীতির বিপরীতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ কেবল বাঙালির না, মুসলমানদের জন্য নয়। এই দেশ স্বাধীনতার পেছনে যেমনি বাঙালির অবদান রয়েছে তেমনি রয়েছে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর। সুতরাং এই দেশ সবার দেশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখানে বহুত্ববাদ চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা যে রয়েছে তা ৫৪ বছর হতে চললেও কোনো সরকার আমলে নেয়নি।
এমনকি ‘২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পরে অন্তবর্তী সরকার সংবিধানে অর্ন্তভুক্তি ও বহুত্ববাদী ধারণার চর্চা কথা বললেও কাগুজে কলমে তা সেখানেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে। যার ফলস্বরূপ এই ইউনুস সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শত শত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাম্প্রদায়িক ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। চলমান ২০২৫ জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর মাসে সেটেলার বাঙালি, বহিরাগত বাঙালি শ্রমিক ও ব্যক্তি কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, উত্যক্তকরণ ঘটনা রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষ কর্তৃক ২১টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ২৯ জন জুম্ম নারী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।
এর শেষ কোথায়? নিদারুণভাবে রাষ্ট্রের মনোজগত নিপীড়ন বারুদ বারংবার ঝলছে দিচ্ছে আদিবাসীদের। ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় আদিবাসীদের উপর জলবিদ্যুৎ এর নামে, বাণিজ্যিক বনায়নের নামে, উন্নয়নের নামে, পর্যটনের নামে, নিরাপত্তা অজুহাতে সেনাশাসন জারি রাখার নামে আদিবাসী জনপদ উচ্ছেদ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি প্রয়োগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে আরও কর্তৃত্ববাদী। রাষ্ট্রের দাপট বাড়ছে, সেবা কমছে। চলছে দুর্বৃত্তের আগ্রাসন। রাজনীতির আশ্রিত দুর্বৃত্তরা চড়াও হচ্ছে নিরীহ ও দুর্বল মানুষের ওপর। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা এই দুর্বৃত্তদের হামলার নির্মম শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও উপাসনালয়ে হামলা হচ্ছে। উচ্ছেদ হচ্ছে আদিবাসীরা। আর এম এন লারমার বহুত্ববাদী অসম্পূর্ণ বাংলাদেশ থেকে গেছে অন্ধকারে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের করণীয়:
বিশ্বজুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে চলার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় বিশ্বে টিকে থাকতে হলে তরুণ সমাজকে প্রস্তুতি নিতে হবে। তাদের মধ্যে যে অফুরন্ত সম্ভাবনা ও সুপ্ত সৃজনী শক্তি রয়েছে, তা জাগিয়ে তুলতে হবে। একটি স্ফুলিঙ্গ তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত শিখায় পরিণত করতে পারে, যা হয়ে উঠতে পারে নক্ষত্রের মতো সমুজ্জ্বল।
এর জন্য দরকার জ্ঞানভিত্তিক গুণগত শিক্ষা, যার আলো তাদের অন্তরকে আলোকিত করবে, সম্ভাবনা ও সুপ্তশক্তিকে উন্মোচিত করবে। কোনটা ভুল কোনটা সঠিক চিহ্নিত করতে পারবে। সমাজকে পরিবর্তন করার মূল শক্তি জ্ঞান। জ্ঞানান্বেষণের প্রবল ইচ্ছা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্ম দেয়।
যুগে যুগে শাসকরা তাদের শাসন ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য তরুণদের অধিকতর চিন্তা করা থেকে বিরোধিতা রাখার একটি প্রক্রিয়া চালিয়েছিল। ঠিক পাহাড়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। পাহাড়ে তরুণ প্রজন্মকে সস্তায় আমোদ-প্রমোদে মধ্যে দিয়ে ডুবিয়ে রাখা এবং নেশার মাধ্যমে জুম্ম জাতিকে ধ্বংস করা শাসকগোষ্ঠী নানাভাবে পায়তাঁরা চালাচ্ছে। সেই সাথে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির মাধ্যমে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ভূমি জবরদখল, প্রশাসনের সহায়তায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক সাম্প্রদায়িক হামলা সংগঠিতকরণ, ঘর-বাড়ি তল্লাশি ইত্যাদি ঘটনা চলমান রয়েছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক গভীর কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে বাধ্য করছে।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না করে পাহাড়কে আবারো সেনাশাসনের মাধ্যমে নানা ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে। যার কারণে পাহাড়ে তরুণদের মনে এক অসন্তোষ বিরাজ করছে।
বর্তমান জুম্ম তরুণ প্রজন্ম পূর্বের তুলনায় অনেকটা অধিকার নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। তাদের মনের মধ্যে নিপীড়নের যে তুষার আগুন জ্বলছে তা পাহাড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। যেটি এক বিস্ফোরণের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পরিশেষে, ছাত্র ও যুব সমাজকে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে হবে। মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেছিলেন, ‘যারা মরতে জানে পৃথিবীতে তারা অজেয়, যে জাতি বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে পারে না, সেই জাতির পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার থাকতে পারে না’।
তরুণ প্রজন্মকে পাহাড় অতিক্রমের দুঃসাহস রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্পে প্রয়োজনে আরো একবার পুনরুজ্জীবিত হোক সত্তর-আশির দশক। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত পথ ও নির্দেশিত নীতিকৌশল আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আদায়ের সংগ্রামে একমাত্র দিশারী হয়ে, তার আত্মত্যাগ তিতিক্ষা যুগে যুগে দেশের প্রতিটি মুক্তিকামীর এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণার উৎসস্থল হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে নারী পুরুষ সামিল হও এখানেই আমাদের জাতীয় মুক্তি। পাহাড়ের দেয়ালে দেয়ালে ভেসে উঠুক- আমরা ফিরবো তখনি, শাসকগোষ্ঠী মাথা নোয়াবে যখনি।
+ There are no comments
Add yours