অতীতের কিছু স্মৃতি

প্রভাত কুমার চাকমা

ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু এক দশক পূর্ণ না হতেই বৃটিশের প্রদত্ত হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল লংঘন করে পাকিস্তান সরকার বেআইনী অনুপ্রবেশসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিবাসীদের মতামত ব্যতিরেকে কর্ণফুলী নদীর কাপ্তাই নামক স্থানে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে। বাঁধের পানিতে তলিয়ে যাওয়া সেই সব বসতিগুলো পুনর্বাসনের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে কাচালং উপত্যকা নির্ধারণ করা হয়।

আমার বয়স তখন ৯-১০ বছর। দাদু-দাদিরা বলতেন, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও তাঁরা কাচালং রিজার্ভে গাছ, বাঁশ, বেত, করুকপাতা, লতা-গুল্ম ইত্যাদি কাটতেন। মাইনীমুখ পর্যন্ত ছিল বসতি, আর মাইনীমুখ ছিল একটি ফরেস্ট বিট অফিস। সেখান থেকে তাঁরা দাখিলা সংগ্রহ করতেন। সেই সময় রিজার্ভ জঙ্গলে বাঘ, ভালুক, হাতি, অজগর, গুইসাপ, কচ্ছপ, রংরাং কেটকেত্যা, ছড়ার মাছ, কাঁকড়া- এসবের কোনো অভাব ছিল না। দাদুরা এসব গল্প করতেন আমাদের সঙ্গে, আর তখনো বুঝিনি এই গল্পগুলো একদিন বাস্তবে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠবে।

১৯৫৯ সাল থেকে বাব-দাদার চৌদ্দ পুরুষের বাস্তুভিটা ছেড়ে আমাদের পরিবারসহ অনেকে কাচালং উপত্যকার দুই ধার ধরে নতুন বসতি গড়ে তোলে আমতলী থেকে করেঙ্গাতলী, বঙ্গলতলী হয়ে হাগলাছড়া পর্যন্ত। পুনর্বাসন কার্যক্রম ব্লক ও ব্লক লিডারের মাধ্যমে পরিচালিত হতো (তখনকার সময়ে আমতলী সিলেট হতে বিএফআইডিসি গাছ আরহণের জন্য সিলেটি হাতির মাহতের কয়েকটি বাসা ছিল)। তখনকার সময়ে ব্লক লিডার ছিলেন- লাল বিহারী, করুনাময়, গান্ধী লাল, থ্রোলক্ষ, সূর্য খীসা, রেজ্জাক মাষ্টার, ডুলু মিঞা, সতীশ তালুকদার, শরৎ বৈদ্য, আব্দুল হামিদ, মুক্তল হোসেন, হর কিশোর, চিত্ত রঞ্জন দেবেন্দ্র নাথ, গৌবিন্দ, কৃপাধন, গিরীশ চন্দ্র, দ্রোন কুমার, সোনারাম তালুকদার, কালী চরন, ধীরসেন, সুশান্ত প্রমুখ।

আলী হায়দার খান (এআরও) পুনর্বাসন কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু কাচালং উপত্যকায় সঠিক পুনর্বাসন সম্ভব না হওয়ায় ১৯৬৩-৬৪ সালে অনেকে ভারতে শরণার্থী হয়ে যায়, আবার কেউ ফিরে আসে ফেনী, চেঙ্গী, মাইনী, শংখ, মাতামুহুরী বা তাদের পূর্বপুরুষের ফেলে আসা জমিতে। কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশাপাশি কাচালং এলাকায় আর একটি শ্রেণি ছিল। তারা হলো ফরেস্ট ভিলেজার। বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীনে তারা গুলশাখালী, মাহিল্যা, চুরাখালী, রাঙ্গাপাহাড় প্লান্টেশনের জুম চাষ শুরু করে। তখন মাইনীমুখ ফরেস্ট বিট থেকেই সব নিয়ন্ত্রিত হতো।

পরবর্তীতে পাবলাখালী, শিজক, বাঘাইহাট, শিজকদজর ফরেস্ট বিট স্থাপিত হয়। প্রতিটি এলাকায় ২৫, ৫০ বা ১০০ একর করে সেকশন ভাগ করা হয়েছিল। ফরেস্টার, গার্ড, রেঞ্জাররা সেগুলোর তত্ত্বাবধান করতেন। সেসময়ের সেকশন লিডার ছিলেন মুক্তধন চাকমা, নিকুঞ্জ বিহারী (জুতা কার্বারী), বিজয় কার্বারী প্রমুখ। ৮০ দশকের প্রথমার্ধে প্লান্টেশন বন্ধ হলে পূর্ণ পুনর্বাসন ছাড়াই অনেকে শিজক শিলছড়ি, শিজক খাগড়াছড়ি, তাংগুম, চুরাখালী, মাহিল্যার বসতি স্থাপন করে। তাদের নিত্যদিনে জীবন-যাপনও ছিল খুবই হতাশাজনক। কালের পরিক্রমায় কাচালং এলাকা ব্লক থেকে মৌজা, ইউনিয়ন, পরে উপজেলা পর্যন্ত উন্নীত হয়। কাচালং উপত্যকা থেকে মারিশ্যা, বাঘাইছড়ি উপজেলা, কাচালং হাইস্কুল, কাচালং কলেজ নামকরণ হয়ে গেলো।

পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। তবে দুই দেশের ব্যবধান হাজার মাইলের অধিক যেমনি ছিল তেমনি জাতিগত বৈষম্য, ভাষাগত বৈষম্য, শাসনতান্ত্রিক বৈষম্য ইত্যাদির কারণে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত থেকেই ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। অনুরূপ কাপ্তাই বাঁধের ইস্যূ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র আন্দোলন এবং তার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে যুবক ছাত্র নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ‘কাপ্তাই বাঁধ মরনফাঁদ’ শ্লোগানে ছাত্রদের সংগঠিত করেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এবং মৃত্যু ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের ষড়যন্ত্রে। এম এন লারমার রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে ৪৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু, সংসদ সদস্য ২ বছর, আন্ডার গ্রাউন্ড জীবন ৮ বছর। সুতরাং তিনি আজীবন জুম্ম জনগণের জন্য কাজ করে গেছেন। এই যে স্বল্প সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্যাতিত, নিপীড়িত জুম্ম জনগণের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন সত্যি জুম্ম জনগণ আজীবন ভুলতে পারবো না। তিনি একজন সফল শিক্ষক, সফল আইনজীবী, সফল সাংসদ, সফল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, পার্বত্য চট্টগ্রামের অগ্রদূত আলোকবর্তিকা, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষীর ১১ জাতিগোষ্ঠীর ঐক্যের নিদর্শন।

এম এন লারমার মৃত্যুর পর দেড় বছরে গৃহযুদ্ধ শেষ করে তাঁর ছোট ভাই শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) কর্মী ও জুম্ম জনগণকে সংগঠিত করে পূনরায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তৎকালীন সামরিক শাসক এরশাদ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধানের পথ খোঁজেন। এক পর্যায়ে ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর বৈঠকে বসতে বাধ্য হন। এভাবে তার সময়ে ৬ বার বৈঠক হয়। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের সাথে ১৩ বার এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ৭ বার বৈঠক শেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে বিএনপি এবং প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ নামে একটি ভূঁইফোড় সংগঠন পার্বত্য চুক্তি বিরোধিতা করে। অদ্যবধি চুক্তি বাস্তবায়নে বিরোধিতা করে আসছে। জেএসএস প্রত্যাগত সদস্য এবং সমর্থকদের গুম, হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে।

অন্যদিকে যাদের ভরসায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সক্রিয় সহযোগিতা আশা করে ছিল- সেই কল্পরঞ্জন চাকমা, এমপি, পার্বত্য মন্ত্রী; দীপংকর তালুকদার, এমপি ও টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান; পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি, চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য মন্ত্রী পার্টি সমর্থনে নির্বাচিত হয়েছিল। মন্ত্রী-চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়ে কল্পরঞ্জন চাকমা পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে চুক্তির সার্কেল চীফের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকরাও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান, দীপংকর তালুকদার উপজাতীয় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু তালিকায় ২৬ হাজার সেটেলার বাঙালি পরিবার তালিকাভুক্তকরণ, বীর বাহাদুর উশৈসিং বান্দরবানে হাজার হাজার বহিরাগত বাঙালিদের আদিবাসী জুম্মদের জায়গা দখল ও বসতি উচ্ছেদ করেন।
পার্বত্য চুক্তির আলোকে পার্বত্য মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে। পরিষদে হন্তান্তরিত বিভাগগুলো যথাযথ বাস্তবায়নের দায়িত্ব হচ্ছে জেলা পরিষদসমূহের। কিন্তু ২৭/২৮ বছরে তারা কি করলো? তারা একটুও বিবেক নিয়ে চিন্তা করলো না যে, কাদের অবদানে, রক্তে এ পার্বত্য জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়েছে? পার্বত্য চুক্তির আওতায় ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এবং উপজাতীয় অভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পরবর্তী তিনজন টাকফোর্স চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন তারা কি করলো? বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন ৮০ দশকে পরিস্থিতির কারণে কাচালং, মাচালং, গঙ্গারাম, শিজক, গবছড়ি, তাংগুম, চুরাখালী ইত্যাদি রিজার্ভ এলাকায় এবং সাজেক এলাকায় জীবন বাঁচানোর জন্য হাজার হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তারা শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান থেকে বঞ্চিত। তারা অপেক্ষা করে আসে কবে রেশন পাবে, পুনর্বাসন পাবে, তাদের বাব-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ফেলে আসা বাস্তুভিটায় পুনর্বাসিত হয়েছে।

হাজার হাজার উদ্বাস্তু পরিবারের বসতির কারণে কাচালং রিজার্ভ উজার হয়েছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে গেছে। আর কাচালং উপত্যাকার নীচু অংশ সব ভরে গেছে। এ ব্যাপারে কাচালং এলাকাবাসী উদ্বেগে রয়েছে। বাস্তব সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই, ‘৭০ দশক থেকে বর্তমান অবধি যারা বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন- একমাত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং উষাতন তালুকদার ব্যতীত কোন সাংসদই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলেননি। ২০১৪ সালে উষাতন তালুকদার সাংসদ নির্বাচিত হয়ে সংসদ অধিবেশনে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল।

‘৭০ দশকের প্রথমার্ধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠনের পর জুম্ম জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। তিনি শুধু যে জুম্ম জনগণের নেতা নয় তিনি একজন আন্তর্জাতিক নেতাও। কিন্তু মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এম এন লারমাকে হত্যা করে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-প্রকাশ চক্র তাঁর গড়ে তোলা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে গলাটিপে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। তাই আমরা বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রত্যাগত অস্ত্র জমাদানকারী সদস্য এবং সচেতন জুম্ম জনগণের উদ্যোগে ও সার্বিক সহযোগীতায় শিজক কলেজ প্রাঙ্গণে, শিজক মুখ, বাঘাইছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ভাস্কর্য/আবক্ষ মূর্তি নির্মাণে অনেক দিনের প্রচেষ্টায় সফল হয়েছি। নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় নির্মাণ কমিটি ৯ নভেম্বর ২০২৫ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মকে নেতার গুণাবলী উন্মোষণ হবে। নির্মাণ কাজে যারা শারীরিক, মানসিক, মেধা-শ্রম, অর্থ সহযোগিতা দিয়েছেন সর্বোপরি ভূমিদাতা কনক বরণ চাকমা ও তার পরিবারকে এম এন লারমা ভাস্কর্য নির্মাণ কমিটি বাঘাইছড়ির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

More From Author