হিল ভয়েস, ৮ নভেম্বর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: আগামী ১০ নভেম্বর ২০২৫ মহান বিপ্লবী নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য, জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অগ্রদূত এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস। পাহাড়ি-বাঙালি নাগরিক সমাজের অনেকের কাছে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, গণমানুষের প্রিয় নেতা ও বিপ্লবী, শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের বন্ধু এবং দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতা।
মহান এই নেতার স্মরণে এবং দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষে প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা: দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষে ঢাকায় ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি’র উদ্যোগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। ‘শোষিত মানুষের মুক্তির মিছিলে চিরকাল ধ্বনিত হবে তোমার নাম, বিপ্লবী লারমা, তোমায় লাল সালাম’-এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ওই দিন (১০ নভেম্বর), সোমবার, বিকাল ৩টায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় অনুষ্ঠানমালার প্রথম পর্বে রয়েছে শ্রদ্ধা নিবেদন, সূচনা সঙ্গীত ও স্মরণ সভা এবং দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে প্রতিবাদী গান ও প্রদীপ প্রজ্জালন।
চট্টগ্রাম: একই দিন বিকাল ৩টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব’র ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪২তম প্রয়াণ বর্ষ পালন কমিটি-চট্টগ্রাম’ এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা ও স্মরণ সঙ্গীত। ৪২তম প্রয়াণ বর্ষ পালন কমিটির আহ্বায়ক তাপস হোড় এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম এর সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম এর সভাপতি অশোক সাহা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশরেকা অদিতি হক, ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রাম এর সাধারণ সম্পাদক অজিত দাশ, সাংবাদিক অলিউর রহমান প্রমুখ। আলোচনা সভা শেষে স্মরণ সঙ্গীত পরিবেশন করবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রঁদেভূ শিল্পী গোষ্ঠী।
রাঙ্গামাটি জেলা: একই দিন রাঙ্গামাটি জেলা সদরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে এম এন লারমার ৪২তম মৃত্যবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস পালন করা হবে। ইতোমধ্যে উক্ত কমিটি ‘বিভেদপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী সকল ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হোন’ শ্লোগান নিয়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নেও উক্ত দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ঐ দিন রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সকাল ৭:৩০টায় জমায়েত ও কালোব্যাজ ধারণ, সকাল ৮:৩০টায় প্রভাতফেরী, সকাল ৯টায় পুষ্পমাল্য অর্পণ, সকাল ১০টায় শোক প্রস্তাব পাঠ ও স্মরণ সভা এবং বিকাল ৫টায় প্রদীপ প্রজ্জালন ও ফানুস উড়ানো অনুষ্ঠিত হবে।

বাঘাইছড়িতে আবক্ষ মূর্তি উদ্বোধন: দিবসটি উপলক্ষে আগামী ৯ নভেম্বর ২০২৫, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সার্বোয়াতলী ইউনিয়নে শিজক কলেজ সংলগ্ন কলেজ পাড়ায় মহান নেতা এম এন লারমার আবক্ষ মূর্তি (ভাস্কর্য) উদ্বোধন করা হবে। এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এই আবক্ষ মূর্তিটির নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। এই আবক্ষ মূর্তির শিল্পী জিংমুন লিয়ান বম এবং তার সহযোগী শিল্পী অমিত কোচ। আবক্ষ মূর্তি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও কাচালং ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ দেব প্রসাদ দেওয়ান, শিজক কলেজের অধ্যক্ষ সুভাষ দত্ত চাকমা ও শান্তনা চাকমা। আবক্ষ মূর্তিটি উন্মোচন করবেন এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্মারক সংকলন: এই দিন এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এই মহান নেতার স্মরণে ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্মারক সংকলন’ নামে একটি প্রকাশনাও বের করা হবে। স্মারক সংকলনটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতির কিছু কথা, এম এন লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী, বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবির আবেদনপত্র সহ পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মঙ্গল কুমার চাকমা, হিমাদ্রী উদয়ন চাকমা, জ্যোতিপ্রভা লারমা, পাভেল পার্থ ও মিতুল চাকমা বিশাল এর লেখা সংকলিত করা হয়েছে।
ঘাগড়ায় পিসিপি’র উদ্যোগে অনুষ্ঠান: রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নে ঘাগড়া কলেজ প্রাঙ্গণে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), কাউখালী থানা শাখার উদ্যোগে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে। এই উপলক্ষে ঐদিন বিকাল ৩টায় ঘাগড়া কলেজ প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা নিবেদন ও প্রদীপ প্রজ্জালন অনুষ্ঠিত হবে।
বান্দরবান: একই দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, বান্দরবান জেলা কমিটির উদ্যোগে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বান্দরবান জেলা সদর, জেলাধীন সকল উপজেলা ও ইউনিয়নে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি জেলা সদর সহ খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায়ও দিবসটি উপলক্ষে স্মরণসভা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, আজ থেকে ৪২ বছর আগে ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর গভীর রাতে জনসংহতি সমিতিরই মধ্যে থাকা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী, বিশ্বাসঘাতক, বিভেদপন্থী ও অপরিণামদর্শী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের অতর্কিত সশস্ত্র হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন জুম্ম জনগণের অত্যন্ত প্রিয়জন, নিপীড়িত মানুষের পরম বন্ধু, পাহাড়ি-বাঙালি সকল সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অবিসংবাদিত এই নেতা এম এন লারমা। তাঁর এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে সমগ্র জুম্ম জাতিসহ বিশ্বের অধিকারকামী জনগণের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়।
একই ঘটনায় এম এন লারমার সাথে আরও শহীদ হন তাঁরই বড় ভাই সহযোদ্ধা শুভেন্দু প্রবাস লারমা (তুফান), সহযোদ্ধা অপর্ণাচরণ চাকমা (সৈকত), অমর কান্তি চাকমা (মিশুক), পরিমল বিকাশ চাকমা (রিপন), মনিময় দেওয়ান (স্বাগত), কল্যাণময় খীসা (জুনি), সন্তোষময় চাকমা (সৌমিত্র) ও অর্জুন ত্রিপুরা (অর্জুন)।
এম এন লারমা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি শহরের অনতিদূরে মহাপূরম (মাওরুম) নামক এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে। তাঁর ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তাঁর অনুপস্থিতিতে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব ও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের হাল ধরেন। সন্তু লারমার নেতৃত্বেই ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতি বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তাঁদের একমাত্র ও সবার বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনুও এক পর্যায়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এম এন লারমা ছিলেন একজন মহান চিন্তাবিদ, আদর্শবান রাজনীতিক ও আপোষহীন সংগ্রামী। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পুরনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পথিকৃৎ, শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য দাবি জানান।
এম এন লারমা ১৯৬০ দশকে জুম্ম জনগণের মরণ ফাঁদ খ্যাত কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের হীন মুখোশ উন্মোচন করে এক বিবৃতি প্রদান করলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত করে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেফতার করে। তিনি দুই বছর জেল খাটার পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল হতে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে এই অঞ্চল থেকে পুনরায় জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
তাঁরই সুদক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভিন্ন ভাষাভাষি অধিকার বঞ্চিত আদিবাসী জুম্ম জনগণ জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন পরিচালনা করার সকল পথ রুদ্ধ হলে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ লাভ করে।
জুম্মদের জাতীয় জীবনে তাঁর অবদান অপরিমেয় ও অপরিসীম। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অসীম ধৈর্য, মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও কষ্টসহিষ্ণুতার অধিকারী এবং অসাধারণ আদর্শবান, সৃজনশীল রাজনীতিক ও আপোষহীন সংগ্রামী। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, আচার-ব্যবহারের অমায়িক, ভদ্র, নম্র, ক্ষমাশীল, সৎ, নিষ্ঠাবান ও সুশৃঙ্খল এবং সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত।