হিল ভয়েস, ৫ অক্টোবর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: গত ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সংঘটিত জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙালি ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)।
২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা,নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারের তরফ থেকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা প্রদান করা, খাগড়াছড়ি-গুইমারায় সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা-উক্ত সুপারিশমালা ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়,খাগড়াছড়ি সদরস্থ সিঙ্গিনালা এলাকায় ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক জুম্ম কিশোরীকে তিনজন সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক গণধর্ষণের ঘটনায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র সাথে সেটেলার বাঙালিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ফলে অন্তত ৩ তিন জুম্ম গুরুতর আহত এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা রামসু বাজার ও এর আশেপাশের জুম্ম বসতিতে সেনাবাহিনী, বাঙালি সেটেলার ও বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীদের কতৃর্ক সম্মিলিভাবে উপযুর্পরি হামলায় ৩ জন জুম্ম নিহত এবং অন্তত ২০ জনের অধিক আহত হয়েছে। এছাড়া রামসু বাজারে জুম্মদের ৫৪টি দোকান, ২৬টি ঘরবাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়। এতে জুম্মদের প্রায় ২৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চলমান ২০২৫ সনের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর মাসে সেটেলার বাঙালি, বহিরাগত বাঙালি শ্রমিক ও ব্যক্তি কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, উত্যক্তকরণ ইত্যাদি ২১টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে এই পর্যন্ত ২৯ জন জুম্ম নারী ও শিশু মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। দশকের পর দশক ধরে চলা এইসব সহিংসতার ঘটনার শিকার নারী ও শিশুর সংখ্যা অগণিত হলেও পাহাড়ের মানুষ এই সব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার আজও পেয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। এই যাবত কালে সংঘটিত নারী সহিংসতার ঘটনা বিশেষত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণের মতন বর্বর পৈশাচিক ঘটনাবলীর বিচার তো দূরে থাক সঠিক তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি।
খাগড়াছড়ি সাম্প্রদায়িক ঘটনায় ইউপিডিএফের উস্কানি রয়েছে মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ উক্ত গণধর্ষণের প্রতিবাদ ও পাহাড়ে সকল নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি সদরস্থ ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ ব্যানারে এক মহাসমাবেশ আয়োজন করা হয়। কিন্তু উক্ত সমাবেশে ইউপিডিএফের কতিপয় লোক সমাবেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শুরু হতে নানাভাবে সমাবেশটিতে বিশৃংঙ্খলা ও বিভিন্ন উস্কানি প্রদান করে।
অনুরূপভাবে গুইমারা ঘটনায়ও ইউপিডিএফের উস্কানীতে সহিংস রূপ ধারণ করেছে বলে দোষারোপ করা হয়।
সেখানে আরো বলা হয়, খাগড়াছড়ির এক জুম্ম নারীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল (বিএমএসসি), খাগড়াছড়ি জেলার সাধারণ সম্পাদক, উক্যনু মারমা প্রারম্ভে আন্দোলনের নেতৃত্ব পরিচালনা করেন ঠিকই কিন্তু পরবতীর্তে ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ অবরোধ কর্মসূচিগুলোতে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল (বিএমএসসি) সাংগঠনিকভাবে সংযুক্ত নয় বলে একটি বিবৃতি প্রদান করে।
ফলে এই থেকে বোঝা যায়, সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক জুম্ম নারীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা জন্য প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ কতৃর্ক ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনকে নানাভাবে উস্কানি দিয়েছিল। এছাড়া দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী ইউপিডিএফ-এর সমর্থক, পরামর্শক ও সহযোগী হিসেবে পরিচিত দুয়েকজন ব্লগার ও ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমেও বিভিন্ন বিভেদমূলক, উস্কানিমূলক ও হঠকারী বক্তব্য দিতে দেখা যায় বলে উল্লেখ করা হয়।
পিসিজেএসএস প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তত ২২টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে জুম্মদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, জুম্মদের ভূমি জবরদখল করা, তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা, জুম্ম নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, সর্বোপরি জুম্মদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করা।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের পথ নিহিত রয়েছে বলে উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
+ There are no comments
Add yours