হিল ভয়েস, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ (২৮ সেপ্টেম্বর) মারমা স্কুল ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং সকল ধর্ষণকারীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন। এইদিন সকাল থেকে বিকাল প্রায় ৪টা পর্যন্ত জেলার গুইমারা উপজেলায় অবরোধকারী জুম্মদের উপর এবং বাড়ি ও বসতিতে ভয়াবহ হামলা চালানো হয় বলে খবর পাওয়া যায়। এছাড়া খাগড়াছড়ি সদর এলাকার চারটি স্থানে সেনাবাহিনী লাঠিচার্জ চালায়।
গুইমারা উপজেলার রামসু বাজার ও এর আশেপাশের জুম্ম বসতিতে সেনাবাহিনী, বাঙালি সেটেলার ও বহিরাগত দুস্কৃতিকারীদের কর্তৃক সম্মিলিতভাবে উপর্যুপরি হামলায় ৩ জন হতে ৮ জন জুম্ম নিহত এবং অন্তত ১৫ জন আহত ও নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এছাড়া, স্থানীয় জুম্মদের অন্তত ১৫টি বাড়িঘর, ৬০টি দোকানপাট ও ১৩টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ এবং ৭টি দোকানপাট লুটপাট করা হয় বলে জানা যায়।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে জানা গেছে, আজ সকাল বেলায় গুইমারার রামসু বাজার সংলগ্ন উপজেলার খাদ্যগুদামের সামনে সড়কের উপর অবরোধকারী একদল জুম্ম ছাত্র-জনতা দাঁড়িয়ে কর্মসূচি পালন করার চেষ্টা করছিল।
এক পর্যায়ে সেখানে সেনাবাহিনীর একটি দল, সেটেলার বাঙালিদের একটি, এছাড়া সেনাবাহিনীর সাথে মুখোশ পরিহিত অস্ত্রধারী বহিরাগত কিছু লোকও সেখানে উপস্থিত হয়। এসময় প্রথমে সেনাবাহিনী অবরোধকারী ছাত্র-জনতাকে সড়ক থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে অবরোধকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। এরপর সেনাবাহিনী জোরপূর্বক ছাত্র-জনতার জমায়েত ভেঙে দেয়।
এসময় দুপুর প্রায় ১২টার দিকে সেনাবাহিনী ও বাঙালি সেটেলারদের সাথে অবরোধকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এর মধ্যেই সেটেলার বাঙালিরা রামেসু বাজারে দোকানপাটে এবং আশেপাশের জুম্মদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ শুরু করে, মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়, দোকানে লুটপাট চালায়। এতে উভয়পক্ষে মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে।
অপরদিকে, উভয় পক্ষের এই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময়েই দুপুর প্রায় ১টার দিকে সেনাবাহিনী ও মুখোশপড়া দুস্কৃতিকারীরা একসঙ্গে অবরোধ পালনকারী জুম্ম ছাত্র-জনতার উপর একের পর এক গুলি চালায় বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে জানা যায়। সেনাবাহিনী, বাঙালি সেটেলার ও মুখোশপড়া দুস্কৃতিকারীদের কর্তৃক এই হামলা বিকাল ৪টা পর্যন্ত স্থায়ী হয় বলে জানা যায়।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্র অনুযায়ী, হামলায় গুলিতে ৩ জন নিহত হয়েছে। এই রিপোর্ট লেখার সময় ওই তিন জনের লাশ খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে রাখা হয়েছে। তবে লাশগুলি সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, কিন্তু পুলিশ কাউকে লাশের চেহারা দেখতে দিচ্ছে না। এখনো পর্যন্ত ওই নিহত তিন জনের নাম নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
অপরদিকে, বাজারে পুড়ে যাওয়া এক দোকানের মালিক, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, গুলিতে ও সেটেলারদের হামলায় অন্তত ৭-৮ জন জুম্ম নিহত হয়েছে। তার মতে, কয়েকজনকে খুন করে দোকানের আগুনে ছুঁড়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে।
এপর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, আহত ব্যক্তি যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন- ১। চিংক্যউ মারমা (২৬), পীং-রেবেসা মারমা, গ্রাম-নতুনপাড়া; ২। অগ্য মারমা (২২), পীং-কেরবী মারমা, গ্রাম-বটতলা; ৩। বিকাশ ত্রিপুরা (২৬), পীং-লক্ষীপতি ত্রিপুরা, গুইমারা সদর; ৪। জুয়েল মারমা, গ্রাম-পথাছড়া; ৫। অংথোয়াই মারমা, গ্রাম-দেওয়ানপাড়া; ৬। কংজসাই মারমা, গ্রাম-আমতলী; ৭। উহ্লাম্যে মারমা, ঠিকানা-রামসু বাজার; ৮। মেলাপ্রু মারমা, ঠিকানা-রামসু বাজার; ৯। ক্যসে মারমা, ঠিকানা-রামসু বাজার; ১০। অংচিং মারমা, ঠিকানা-রামেসু বাজার ও ১১। সাচিংনু মারমা, গ্রাম-বটতলা।
তবে উক্ত তালিকার বাইরেও অনেকে আহত থাকতে পারেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা।
এছাড়া, অন্তত ৫ জন জুম্ম নিখোঁজ রয়েছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে তিন জনের নাম হল- থোয়াইচিং মারমা, চিংপ্রু মারমা ও আথুইপ্রু মারমা। একটি সূত্র অনুযায়ী, ৫ জন জুম্মকে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
গুইমারার রামসু বাজার এলাকায় জুম্মদের উপর হামলার সময় ইটপাটকেলের আঘাতে কয়েকজন সেনা সদস্যও আহত হয় বলে খবর পাওয়া যায়।
খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর লাঠিচার্জ: এক বৃদ্ধা আহত
একইদিন (২৮ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের সেনাবাহিনীর সদস্যরা খাগড়াছড়ি সদরের অন্তত চারটি স্থানে জুম্মদের উপর অতর্কিতে বেধরক লাঠিচার্জ চালায় বলে খবর পাওয়া যায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রথমে সকাল ৮টার দিকে স্বনির্ভর বাজার এলাকায় জুম্মদের উপর লাঠিচার্জ করে। এরপর গিরিফুল, মনিগ্রাম ও কুরদিয়াছড়া এলাকায় হঠাৎ উপস্থিত হয়ে সেনা সদস্যরা জুম্ম গ্রামবাসী যাকে পেয়েছে তাকে মারধর করে বলে জানা যায়। এসময় বিশেষ করে কুরদিয়াছড়া এলাকায় ৭০ বছরের এক বয়স্ক মহিলাকে লাঠিচার্জ করে রক্তাক্ত করে বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাত ৯টা হতে রাত ১১টার মধ্যে খাগড়াছড়ি পৌরসভার সিঙ্গিনালা ১নং ওয়ার্ডের শাসন রক্ষিত বৌদ্ধ বিহারের পূর্ব পাশে খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির এক মারমা ছাত্রীকে তিন সেটেলার বাঙালি কর্তৃক গণধর্ষণ করা হয়। তারই প্রতিবাদে এবং সকল ধর্ষণকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে খাগড়াছড়ি জেলায় ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে দ্বিতীয় দিনের মত সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
+ There are no comments
Add yours