হিল ভয়েস, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদন: দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহত শহীদদের স্মরণে গতকাল ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ (শুক্রবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, বান্দরবানে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে স্মরণসভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত স্মরণসভা সমূহ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার নিশ্চিতে বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠনের দাবি জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহতদের স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শহীদ বেদীতে জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের আয়োজনে স্মরণ সভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণ সভায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় ও আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যার সভাপতিত্বে বক্তব্য প্র্রদান করেন আইপিনিউজ এর সম্পাদক ও সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী সতেজ চাকমা, জুলাই অভ্যূত্থানের নেত্রী রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা, জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক প্রথম বিশ্বাস প্রমূখ।
স্মরণসভায় বক্তারা বিগত ১ বছরেও এই সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর অসংখ্যবার সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এসব হামলা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদে সংঘঠিত হয়। কিন্তু এসকল ঘটনার আজও কোন সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করা হয় নি। স্মরণসভা থেকে বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল সাম্প্রদায়িক হামলার বিচারের দাবি সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহতদের স্মরণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বশান্তি প্যাগোডায় সন্ধ্যা ৬:০০ ঘটিকায় আদিবাসী শিক্ষার্থীবৃন্দের আয়োজনে স্মরণ সভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণসভায় ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের পালি বিভাগের শিক্ষার্থী রিবেক চাকমার সভাপতিত্বে এবং ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী বিপুল চাকমার সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের পালি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রেনঙি ম্রো। স্মরণসভায় এছাড়াও বক্তব্য প্রদান করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন চাকমা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ এর চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ধনরঞ্জন ত্রিপুরা প্রমুখ। স্মরণসভার শুরুতে সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহত শহীদসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সভায় বক্তারা বলেন, ঐতিহাসিকভাবে শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার জুম্মদের ভাগ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র বদলাতে পারেনি। স্বাধীনতার আগে যেমন ছিল আমাদের বাস্তবতা, এখনো সেই একই বাস্তবতা বিরাজমান। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে এদেশে অনেক কিছুর পরিবর্তন ও সংস্কার হয়েছে কিন্তু জুম্ম আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। আমরা বলতে পারি আদিবাসীদের ওপর শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির এখনো একই অবস্থায় রয়েছে। যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমরা গতবছরের দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে জুম্মদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা।
বক্তারা আরও বলেন, জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে অনেক আত্মত্যাগী তরুণরা এগিয়ে গিয়েছে, জুম্ম তরুণরা এখনও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় এবং নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে সপে দিতে প্রস্তুত। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলে জুম্মদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই আমরা পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহতদের স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্ত্বরে সন্ধ্যা ৬:০০ ঘটিকায় রাবি ও রুয়েট জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের আয়োজনে স্মরণ সভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণ সভায় বক্তব্য প্রদান করেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি বিজয় চাকমার, তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক প্রাচুর্য চাকমা প্রমূখ।
স্মরণ সভায় বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে রাষ্ট্রীয় মদদে এ সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটানো হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করার জন্য অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল সাম্প্রদায়িক হামলার বিচারের দাবি জানান।
বান্দরবান: সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহতদের স্মরণে বান্দরবান সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে বান্দরবানস্থ আদিবাসী শিক্ষার্থীবৃন্দের আয়োজনে স্মরণ সভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণ সভায় বক্তব্য প্রদান করেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বান্দরবান জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জামাধন তঞ্চঙ্গ্যা, বান্দরবান সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি হ্লাপ্রুসিং মারমা, থানচি থানা শাখার সভাপতি সিং ওয়াই মং মারমা প্রমূখ।
উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ মোঃ মামুন (৪০) নামে এক সেটেলার বাঙালি খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর থেকে একটি মোটর বাইক চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতার ধাওয়া খেয়ে বাইক থেকে পড়ে গিয়ে, পরে জনতার পিটুনিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর মারা যায়। জানা গেছে, এই সময়ে ওই মামুনের বিরুদ্ধে চুরি ও মাদক সংক্রান্ত অন্তত ১৭টি মামলা চলমান ছিল।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটেলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ি জেলা ও দিঘীনালা উপজেলায় সাম্প্রতিক হামলা চালায়। এতে দীঘিনালায় ১ জুম্ম নিহত, ৪ জুম্ম আহত, অর্ধশতাধিক দোকান, ২৪টি মোটরবাইক ও অটোরিক্সা ভস্মীভূত হয় এবং খাগড়াছড়ি সদরে সেনা সদস্যদের গুলিতে আরও ২ জুম্ম নিহত, অনেকেই আহত হয়। এছাড়াও রাঙ্গামাটিতে সেটেলার বাঙালিদের আক্রমণে ১ জুম্ম নিহত, আহত হয় অনেকেই।