খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলা ও হত্যাকান্ডের এক বছর: গ্রেপ্তার হয়নি কেউ, তদন্ত কমিটিরও খবর নেই

হিল ভয়েস, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলা ও খাগড়াছড়ি সদরে পরপর সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক আদিবাসী জুম্মদের উপর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার এক বছর পূর্ণ হলো। উক্ত হামলায় সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক দীঘিনালায় ১ জুম্ম নিহত, ৪ জুম্ম আহত, অর্ধশতাধিক দোকান, ২৪টি মোটরবাইক ও অটোরিক্সা ভস্মীভূত হয় এবং খাগড়াছড়ি সদরে সেনা সদস্যদের গুলিতে আরও ২ জুম্ম নিহত, অনেকেই আহত হয়।

হামলা শুধু খাগড়াছড়িতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীঘিনালা ও খাগড়াছড়িতে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে পরের দিন রাঙ্গামাটি শহরে ছাত্র-যুব সমাজ শান্তিপূর্ণ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করলে, সেখানেও সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক জুম্মদের উপর কয়েক দফায় সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট হয়। এতে এক জুম্ম ছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা, আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক, নাগরিক ও ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে, ড. ইউনুস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন)-কে আহ্বায়ক এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে সদস্য করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

উক্ত কমিটিকে ‘সংঘটিত সহিংস ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যতে একই জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে যথাযথ সুপারিশ প্রণয়ন করা’র দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তৎসময় হতে আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের নিকট প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু বিগত এক বছরেও উক্ত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা জানা যায়নি। অপরদিকে বিগত এক বছরেও দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ি সদরে সংঘটিত উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি এবং কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি বলে জানা গেছে।

এখন অনেকের প্রশ্ন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ের মতই কি জুলাই-আগস্ট এর বৈষম্য বিরোধী অভ্যূত্থানের ফলে ক্ষমতাসীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা বিচারহীন থেকে যাবে? অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে?

উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ মোঃ মামুন (৪০) নামে এক সেটেলার বাঙালি খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর থেকে একটি মোটর বাইক চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতার ধাওয়া খেয়ে বাইক থেকে পড়ে গিয়ে, পরে জনতার পিটুনিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর মারা যায়। জানা গেছে, এই সময়ে ওই মামুনের বিরুদ্ধে চুরি ও মাদক সংক্রান্ত অন্তত ১৭টি মামলা চলমান ছিল। পরে ঐ দিনই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে সেটেলার বাঙালিদের একটি দল মধুপুর সহ খাগড়াছড়ি সদরের একাধিক এলাকায় জুম্মদের উপর হামলার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে জুম্মরা প্রতিরোধে এগিয়ে আসলে সেটেলাররা পিছু হটে।

কিন্তু এর পরের দিন (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪টার দিকে বাঙালি ছাত্র পরিষদের ব্যানানের সেটেলার বাঙালিরা দীঘিনালা উপজেলা সদরে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সমাবেশ ও মিছিল করে এবং এক পর্যায়ে দফায় দফায় আশেপাশের এলাকায় ও দীঘিনালা সদরের লারমা স্কোয়ার স্টেশন বাজারে সেনাবাহিনীর চোখের সামনেই জুম্মদের উপর হামলা ও দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত হামলা ও অগ্নিসংযোগ চলে। এতে ধন রঞ্জন চাকমা (৫২) নামে এক জুম্ম গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া ৪ জন গুরুতর আহত হন। দোকানে ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ফলে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানা যায়।

একই দিন (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতে উক্ত হামলার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি সদরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-যুব সমাজের একটি অংশ সড়কে নেমে আসলে, এক পর্যায়ে সেখানে সেনাবাহিনীর একটি দল উপস্থিত হয়। এতে উভয়পক্ষের বাকবিতন্ডা ও উত্তেজনার এক পর্যায়ে সেনা সদস্যরা গুলি করলে, এতে জুনান চাকমা (২০) ও রুবেল ত্রিপুরা (৩০) নামে দুই যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এসময় আরও অন্তত ২০ জন ছাত্র-যুবক আহত হয় বলে জানা যায়।

More From Author

+ There are no comments

Add yours