শিক্ষা দিবস উপলক্ষে রাঙ্গামাটিতে ৪ দফা দাবিতে পিসিপি ও এইচডাব্লিউএফ’র বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ

হিল ভয়েস, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রাঙ্গামাটি: ৬৩ তম শিক্ষা দিবস-২০২৫ উপলক্ষে আজ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সকাল ১০ ঘটিকায় রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে পার্বত্য পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিএফ), রাঙ্গামাটি জেলা শাখার উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

উক্ত সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন রুমেন চাকমা, সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি; চন্দ্রিকা চাকমা, তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটি; মেরিন বিকাশ ত্রিপুরা, শিক্ষার্থী, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ প্রমুখ।

রুমেন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা-ব্যবস্থা মানসম্মত তো নয়ই, বরং নানামূখী সমস্যায় জর্জরিত। ভঙ্গুর এক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি চলে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়। এটা পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতকে বিক্রি করে দেয়ার সামিল। এতে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করে শিক্ষার্থীদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

কিছুদিন পূর্বে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। বর্তমানেও যদি পূর্বের ন্যায় তদবির ও টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় তাহলে পাহাড়ের ছাত্র সমাজ সেটা মেনে নেবে না, জেলা পরিষদসমূহের গদিতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো কলেজ রয়েছে সবকটাতে মারাত্মক শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বিরাজমান। কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার বেহাল দশার প্রভাবের প্রতিবছর এসএসসি ও এইচএসসির পরীক্ষায় পাশের হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির আরো বেশি বেহাল দশা। বর্গা শিক্ষক পদ্ধতি, ভৌগোলিকগত বাস্তবতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। আমরা এইসব সমস্যার অতিসত্বর সমাধান দেখতে চাই, আমরা দুর্নীতিমুক্ত জেলা পরিষদ দেখতে চাই, আমরা টাকার জোরে নয়, মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেখতে চাই।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা ১০০ টি প্রাথমিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠদানের কথা বলেছেন। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত নেই। কোনও কোনও জায়গায় থাকলেও দক্ষ শিক্ষক নেই, অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। এসব মূল সমস্যাসমূহ সমাধান না করে ই-লার্নিং ব্যবস্থা পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের উপকারে আসবে না, এটি অনেকটা গাছের গোড়ায় পানি না ঢেলে আগায় পানি ঢালার মতো অবস্থা হবে। পাহাড়ের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে সমভাবে লড়তে পারেনা। এজন্য আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ৫% শিক্ষা কোটার দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক ও ন্যায্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে মাধ্যমিক শিক্ষাকে জেলা পরিষদে হস্তান্তরের কথা বলা হলেও এখনও সেটি করা হয় নি, ফলশ্রুতিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা নয়, এমন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ায় এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমরা ছাত্র সমাজ শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই, গণমুখী ও গরীব মানুষদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা দেখতে চাই। শিক্ষিত আদিবাসী সমাজ যাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় এজন্য সকল সরকারি চাকরিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ৫% চাকরি কোটার পুনর্বহাল চাই। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন তথা পাহাড়ীরা যাতে নিজেদের উন্নয়ন নিজেরা করতে পারে এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামর যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই।

চন্দ্রিকা চাকমা বলেন, শিক্ষা একটি জাতিকে আলোকিত করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার প্রতিবছর বাড়ছে। সাজেকসহ বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় আমরা বড় বড় হোটেল, রিসোর্ট দেখতে পাই কিন্তু সেখানে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। গণঅভ্যুত্থান মধ্য দিয়ে অর্ন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থায় মোৗলিক কোনো পরিবর্তন আমরা দেখতে পাইনা। বরং এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের মানুষ মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানান।

মেরিন বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই শিশুরা ঝরে পড়ছে, কেননা এখানে শিক্ষা নীতিকে পশ্চাৎপদ অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধুমাত্র লোক দেখানো উন্নয়ন করা হয়। কিন্তু আদতেই এখানে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোও নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্র। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় পাহাড়ের মানুষদের অনেক বঞ্চিত করা হচ্ছে। একই সাথে অসৎ ও দূর্নীতিগ্রস্থ শিক্ষক, দন্ডপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলির মাধ্যমে পানিশমেন্ট জোন হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্যবহার করা হয়।

এই সময় হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সভাপতি কবিতা চাকমা নিম্ন দাবীনামা উত্থাপন করেন:

১) দেশের সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারি চাকরিতে আদিবাসী জাতিসমূহের জন্য ৫% কোটা চালু করাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বর্গা শিক্ষক নিয়োগ বাতিল,
২) শিক্ষক নিয়োগ বানিজ্য বন্ধ,
৩) সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ,
৪) অবকাঠামো নির্মাণসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।

পিসিপি’র রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ম্যাগলিন চাকমার সঞ্চালনায় উক্ত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সভাপতি কবিতা চাকমা।
এতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপি জেলা শাখা সাংগঠনিক সম্পাদক সুনীতি বিকাশ চাকমা।

More From Author

+ There are no comments

Add yours