হিল ভয়েস, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: আগামীকাল (১৫ সেপ্টেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত মহান নেতা, জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক সংসদ সদস্য, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (যিনি এম এন লারমা নামে সমধিক পরিচিত) ৮৬তম জন্মদিবস।
দিবসটি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, আগামীকাল সকাল ১০টায় রাঙ্গামাটি সদরের কালিন্দীপুর এলাকার নিউ মার্কেটস্থ আশিকা কনভেনশন হলে দিবসটি উপলক্ষে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিশির চাকমা এবং প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার। এছাড়া সভায় বিভিন্ন প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ছাত্র-যুব সমাজ ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন বলেও জানা গেছে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি গঙ্গা মাণিক চাকমা।
একই দিন, বিকাল ৩টায় ঢাকার বাংলামটর এলাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে একটি আলোচনা সভা। ‘বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটি’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিতব্য উক্ত আলোচনা সভায় অতিথি আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, সাংবাদিক এহসান আহমেদ, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথেইন প্রমীলা প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক জাকির হোসেন।
একই দিন, বিকাল ৩টায় চট্টগ্রামের স্টেশন রোডের হোটেল এশিয়ান-এ অনুষ্ঠিত হবে ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার চিন্তাধারা ও সমকালীন ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬তম জন্মবর্ষ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিতব্য উক্ত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম এর আহ্বায়ক তাপস হোড়। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম এর সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর; ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রাম এর সাধারণ সম্পাদক অজিত দাশ; বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী; বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), চট্টগ্রাম এর ইনচার্জ আল কাদেরি জয়; বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা এর সাংগঠনিক সম্পাদক কাঞ্চন ত্রিপুরা; পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম এর সভাপতি জগত জ্যোতি চাকমা; পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর এর সভাপতি হ্লামিউ মারমা প্রমুখ।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে সকাল ১০টায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘এম এন লারমা ও জুম্ম জাতীয়তাবাদ এর প্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে’ শীর্ষক এক উন্মুক্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশ, রাঙ্গামাটি কলেজ শাখার উদ্যোগে আয়োজিত উক্ত আলোচনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দুই সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা ও নিপন ত্রিপুরা।
এম এন লারমার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত
এম এন লারমার জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট মৌজার স্বনামখ্যাত মহাপুরম বা মাওরুম গ্রামে। ১৯৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদের নীচে অন্যান্য বহু গ্রামের সাথে এই গ্রামটিও ডুবে যায়। তাঁর পিতা চিত্ত কিশোর চাকমা ছিলেন একজন গুণী শিক্ষক, সমাজহিতৈষী ও দেশপ্রেমী এবং মাতা সুভাষিণী দেওয়ান ছিলেন ধৈর্য্যশীলা ও ধর্মপ্রাণা এক নারী। তাঁর আপন জ্যেঠা কৃষ্ণ কিশোর চাকমা ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারের আন্দোলনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তিত্ব। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষার প্রসার, জুম্ম জাতীয় চেতনা বিকাশ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এম এন লারমাদের পরিবারটির বৈপ্লবিক ও নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত।
তাঁর দুই ভাই ও সবার বড় একমাত্র বোন, সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং অতুলনীয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর বড় ভাই শুভেন্দু প্রভাস লারমা ১৯৮৩ সালে তাঁরই সাথে একই ঘটনায় শহীদ হন। অপরদিকে তাঁর ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তাঁর মৃত্যুর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আবির্ভূত হন। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর একমাত্র বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনু জনসংহতি সমিতির নারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই এ এবং ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে বিএড এবং ১৯৬৯ সালে এলএলবি সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৬৬ সাল হতে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত হাই স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।
এছাড়া তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৩ সালের শুরু পর্যন্ত পাহাড়ি ছাত্রদের সম্মেলনে ও সংগঠনে এবং বিভিন্ন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের উদ্যোগ নেন। ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিবর্তনমূলক আইনে পুলিশ কর্তৃক চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পাহাড়ি ছাত্রাবাস হতে গ্রেপ্তার হন। দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে থাকার পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ চট্টগ্রাম কারাগার থেকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি লাভ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরই নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ৪ দফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জুম্মদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে তিনি গণপরিষদ অধিবেশন বর্জন করেন। ১৯৭২ সালে তাঁরই নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় এবং তিনি এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছর জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগদান করেন।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তাঁর ও তাঁর ভাই সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৭৭ সালে জনসংহতি সমিতির প্রথম জাতীয় সম্মেলনে এবং ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে পরপর সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভোর রাতে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত এক আক্রমণে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার খেদারছড়া থুমে আট সহযোদ্ধাসহ নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।
+ There are no comments
Add yours