হিল ভয়েস, ২৭ আগস্ট ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা ও পানছড়ি উপজেলায় একদিকে সময়ে সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হয়রানিমূলক ও ভীতিকর সেনা অভিযান এবং অপরদিকে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) এর সন্ত্রাসীদের জুম্মদের গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা, গ্রামবাসীদের মারধর, জরিমানা সহ নানা নিপীড়ন চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এতে উভয়পক্ষের চাপে পড়ে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় ব্যাপক ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এবং গ্রামবাসীরা অতীষ্ট হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট হতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সেনা জোন ও জারুলছড়ি সেনা জোনের ৮০-৯০ জনের একটি যৌথ সেনাদল গাড়িযোগে বাবুছড়া ইউনিয়নের ধনপাদা গ্রামে অভিযানে যায়। এরপর তারা সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পাকুজ্জেছড়িতে গিয়ে অবস্থান করে। এরপর ২৬ আগস্ট, সকালে আরও নতুন ৫ গাড়ি সেনা সদস্য পাকুজ্জেছড়ি সেনাদলের সাথে যোগ দেয়। এসব সেনাদলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দীঘিনালা সেনা জোনের লে: মো. রাসেল ও জারুলছড়ি সাব-জোনের ওয়ারেন্ট অফিসার মো. মহিদুল ইসলাম।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সেনাবাহিনী বাবুছড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ধনপাদা, পাকুজ্জেছড়ি, উগুদোছড়ি, বোরগো পাড়া, ডিরেন পাড়া, দুলুছড়ি, নাড়াইছড়ি এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। সেনাবাহিনীর এই অভিযানের ফলে এলাকার জুম্মদের ব্যাপক ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।
অপরদিকে, গ্রামবাসীদের সূত্র জানায়, অনেক দিন থেকে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সন্ত্রাসীদের নানা হয়রানি ও নিপীড়নের কারণে ওই এলাকার, বিশেষ করে ধনপাদা, পাকুজ্জেছড়ি, বোরগো পাড়া, দেড়েঙ্গে আদাম, উগুদোছড়ি, দুলুছড়ি, নাড়াইছড়ি ইত্যাদি এলাকার জুম্মরা অতীষ্ট। এলাকায় জুমচাষীরা জুমের উৎপাদিত ফসল মামড়া, বেগুন, মরিচ, শাক ইত্যাদি বাজারে ঠিকমতো বিক্রয় করতে পারেনি। বোট চলাচল সীমিত থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় করতে পারেনি এলাকাবাসী।
ইউপিডিএফ ওই এলাকার জুম্মদের দোকানের জন্য মালামাল এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়বিক্রয়ের উপর নিধেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং ইচ্ছেমত তা নিয়ন্ত্রণ করছে। ইউপিডিএফের জারিকৃত নিয়ম বা বিধিনিষেধ অমান্য করলে গ্রামবাসীরা মারধর, অর্থ জরিমানা বা বিভিন্ন প্রকার শাস্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছে।
উক্ত এলাকায় সেনাবাহিনী অভিযান চালালেও ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা তাদের আস্তানায় নির্বিঘ্নে অবস্থান করছে, অথচ সাধারণ গ্রামবাসীরা ভয়ে চলাফেরা এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারছে না। বিশেষ করে নারাইছড়ি এলাকার জুম্মরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তারা তাদের জুমের বা খেতের বিভিন্ন ফসল ও শাকশবজি ঠিকমত বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারেননি। বাজারে গিয়েও কোনো কিছু কিনে আনতে গেলে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা বাধা দিচ্ছে। আধা কেজির বেশি নাপ্পি, দুই কেজির চাল কিনে আনতে পারছেন না। ঐ এলাকার স্কুলগুলোতেও শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ প্রায়ই ইউপিডিএফ সদস্যরা সেখানে সশস্ত্রভাবে অবস্থান করে থাকে।
সেনাবাহিনীও অভিযানে গেলে স্কুলগুলোতে অবস্থান করে থাকে। ছাত্র-শিক্ষকরা স্কুলে আসতে ভয় পাচ্ছে। সেনাবাহিনী যেভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ে বাধা-নিষেধ আরোপ করতো, ইউপিডিএফ এখন সেনাবাহিনীর মতো সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। ইউপিডিএফের নিপীড়নের কারণে নাড়াইছড়ি অনেক পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে নাড়াইছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আজ সেনাবাহিনী এসে সেসব জুম্ম পরিবারসমূহকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
অপরদিকে, গত ২৫ আগস্ট হতে ১০০ হতে ১৫০ জনের একদল সেনা সদস্য পানছড়ি উপজেলার চেঙি ইউনিয়ন ও লোগাং ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায়ও অভিযান শুরু করেছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে চেঙি ইউনিয়নের আওতাধীন জগপাড়া, তারাবন্যে, হরোল্যেছড়ি, উগুদোছড়ি, নাপিড পাড়া এবং লোগাং ইউনিয়নের আওতাধীন হারুবিল, বাবুরো পাড়া, ধুধুকছড়া, রূপসেন পাড়া, হাতিমারা সহ বহু জায়গায় সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে খবর পাওয়া গেছে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর সেনা জোনের জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. খাদেমুল ইসলাম (২৪ বীর) এই অভিযানের নেতৃত্বে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
ওইসব এলাকার জনগণের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, ওইসব এলাকার জনগণ দীর্ঘদিন ধরে ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) এর সন্ত্রাসীদের ব্যাপক হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন। ওই এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা অবস্থান করায় বহু গ্রামবাসী তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। বস্তুত ঐ এলাকায় মোবাইল অপারেটর ভেঙে দেওয়া, নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, গুম, হত্যা ও চাঁদাবাজির কারণে এসব এলাকায় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
বর্তমানে সেনাবাহিনী অভিযান চালালেও ইউপিডিএফ (প্রসীত) সন্ত্রাসীরা ওই এলাকার জনগণকে জিম্মি করে রাখায় তারা সেনাবাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তবে সাধারণ জনগণ গভীর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে।
সাম্প্রতিককালে ওইসব এলাকাসমূহে জনগণের মধ্যে চুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতির প্রতি ব্যাপক সমর্থন লক্ষ্য করা গেলে ইউপিডিএফ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং জনগণকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন শুরু করে বলে জানা গেছে। এলাকাবাসীর একটি সূত্র জানায়, চুক্তির পক্ষের লোকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ইউপিডিএফ (প্রসীত) সন্ত্রাসীদের সমর্থন প্রদর্শনের জন্যই সেনাবাহিনী সেখানে কৌশলে অভিযান পরিচালনা করছে।