হিল ভয়েস, ১০ আগস্ট ২০২৫, চট্টগ্রাম: গতকাল ৯ আগস্ট ২০২৫ (শনিবার) আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে চট্টগ্রামে আয়োজিত অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. রাহমান নাসির উদ্দিন উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রামস্থ প্রেস ক্লাব ভবনের জুলাই স্মৃতি হলে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, চট্টগ্রাম অঞ্চল কর্তৃক “আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে উক্ত আলোচনা সভা এবং র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়।
চট্টগ্রাম বৌদ্ধ মন্দির চত্বরে বিকাল ৩:০০ ঘটিকায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। উক্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আবুল মোমেন লেখক, কবি ও সাংবাদিক । আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন।
পরে বৌদ্ধমন্দির চত্বর থেকে প্রেস ক্লাব ভবন পর্যন্ত এক র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা এর সভাপতি তাপস হোড়, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার নেতা নুরুচ্ছফা ভূঁইয়া, ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রাম এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পাহাড়ী ভট্টাচার্য, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন মাহিম, নৃবিজ্ঞান, বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশরেকা অদিতি হক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল চাকমা, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর চট্টগ্রাম ইনচার্জ আল কাদেরি জয় প্রমুখ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সহ-সভাপতি সৌরভ চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদস্য অনিল বিকাশ চাকমা।
উদ্বোধনী বক্তব্যে আবুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষজন স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। এই দেশটা তাদেরও, তারাও এই ভূমির সন্তান। আমরা আওয়াজ তুলি এই দেশে বৈষম্যের অবসান চাই। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই না। আদিবাসী স্বীকৃতি ও অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত-এটা করুণা নয়।
তিনি আরও বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করে বসবাস করে আসছে। তারা পাহাড়, বনভূমি, প্রকৃতির সাথে বসবাস করতে জানেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও দর্শন মর্যাদার সাথে মূল্যায়ন ও সংরক্ষণে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে। প্রাণ, প্রকৃতি, বনভূমি ও পাহাড়ের সাথে বসবাস করার সংস্কৃতিকে বুঝতে হবে, স্বীকৃতি দিতে হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সংবিধানে মর্যাদার সহিত অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়েই দেশটা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন বলেন, আদিবাসী জনগণ এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে শাসন ও আইনী কাঠামোয় অংশগ্রহণের স্বীকৃতি চেয়ে আসছে। আজও তারা রাষ্ট্রের মধ্যে অধিকার ও মর্যাদার সহিত অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘ সংগ্রাম পরিচালনা করে যাচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রই তাদের কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়। কাজেই আদিবাসী জনগোষ্ঠী যেখানে অন্তর্ভুক্তিবাদী, রাষ্ট্রই সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদ পোষণ করছে।
তিনি আরও বলেন, শাসকগোষ্ঠী সুকৌশলে ভিন্ন চিন্তাধারা, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ওপর দমন পীড়ন জারি রাখতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদের আবরণ আরোপ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষজন চুক্তি করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে নিজেদের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য। কাজেই যে সরকারই আসুক সেই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দায়বদ্ধ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে এই রাষ্ট্রের অগ্রগতি কখনো সম্ভব নয়।
হাফিজ রশিদ খান বলেন, একবিংশ শতকে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক প্রয়োজনীয়তা রক্ষা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সেটার প্রতিফলন আমরা মূলধারার জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বিভিন্ন আদিবাসীদের জীবনযাপনে অধিকতরভাবে দেখি। বাংলাদেশে বসবাসরত যে সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে তারা প্রতিনিয়ত তাদের আত্মপরিচয়ের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে, তারা নিজ ভূমির অধিকারের জন্য আওয়াজ তুলছে। কিন্তু রাষ্ট তাদের যথাযথ মান-মর্যাদা দেওয়া থেকে কোন এক অজানা কারণে বিরত থেকেছে এপর্যন্ত।
তাপস হোড় বলেন, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে পালন করা হয়ে থাকে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার ও তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজকের এই দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের আদিবাসীদের বঞ্চনার শেষ নেই, এর দায় আমাদের রাষ্ট্রের। যে সরকারই আসুক তারা কেউই আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এভাবে চলতে থাকলে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে।
নুরুচ্ছফা ভূঁইয়া বলেন, আদিবাসীদের বাস্তবতা নিয়ে আমরা অনেকেই অবগত আছি। তারা কেমন নিপীড়ন-নির্যাতন-বঞ্চনার মধ্যে বাংলাদেশে টিকে আছে তা আমরাও দেখছি। কিন্তু এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কিংবা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কয়জনে কথা বলছি! আমাদের আদিবাসীদের পক্ষে হয়ে আওয়াজ বাড়াতে হবে। এ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আদিবাসীরা তাদের অধিকার নিয়ে নিরাপত্তার সাথে যেন বসবাস করতে পারে তার জন্য অধিকতর আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া বিকল্প পথ নেই।
ড. মহিউদ্দিন মাহিম বলেন, ইতিহাস আপন গতিতে চলে। ইতিহাস থেকে সত্যকে বাদ দেওয়া যায় না। এ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র বসবাসকৃত ৫০ এর অধিক আদিবাসীদের স্বীকৃতি না দেওয়া এটি ঐতিহাসিক ভূল। তাদের বাদ দিয়ে একটি দেশের সমতা ও নায্যতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আজকের আদিবাসী দিবসের যে বিষয় এআই তা এ দেশে কতটুকু ফলপ্রসু হবে সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। মৌলিক কাঠামোর মধ্যে আমাদের সমস্যা থেকে গেছে সেটি হলো সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি।
অদিতি মোশরেকা অদিতি হক বলেন, একটি দেশ কেমন আছে সেটি আমরা বুঝতে পারি যে সে দেশের প্রান্তিক জনগণ বিশেষ করে আদিবাসীরা কেমন আছে। আমরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলি সেটি নিশ্চিত হবে যদি প্রান্তিক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান সবখানে আদিবাসীদের অংশীদারিত্ব ছিল কিন্তু অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি।
জুয়েল চাকমা বলেন, আমরা আজকে আদিবাসী দিবস পালন করছি আক্ষেপ ও ক্ষোভ নিয়ে। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অনেক দাগী আসামী জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমার বম আদিবাসী ভাইবোনেরা এখনো বিনা বিচারে আটক। এমনকি ৩ জনের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। আমরা পার্বত্য চুক্তির অন্যতম বিষয় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, কিন্তু চুক্তির ২৭ বছর পরেও এই কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন হয়নি।
আল কাদেরী জয় বলেন, আজকের আদিবাসী দিবস যেমন খুশির তেমনি বেদনার, কারণ সারা পৃথিবীতে আদিবাসীদের জীবন বিকাশ ও তাদের অস্বীকৃতির ধারা হিসেবে চলছে এই বিশ্ব। এই বেদনা একদিন শক্তিতে পরিণত হবে। এই দেশ যদি আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিত তাহলে তারা আজ সংকট না হয়ে সম্পদে পরিণত হতো।
আলোচনা সভা শেষে রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী, বম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, বাংলাদেশ রাখাইন স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীবৃন্দদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
+ There are no comments
Add yours