খাগড়াছড়িতে আদিবাসী কিশোরীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদে এবং ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাঙ্গামাটিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ

হিল ভয়েস, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, রাঙ্গামাটি: আজ ১৮ জুলাই ২০২৫ (বুধবার) সকাল ১১ ঘটিকায় খাগড়াছড়ি ভাইবোনছড়ায় আদিবাসী কিশোরী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাঙ্গামাটির কুমার সমিত রায় জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে এক বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

মিছিলটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গন থেকে শুরু হয়ে ডিসি অফিস হয়ে ঘুরে এসে আবার জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গনে এসে শেষ হয়।

বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক অন্তর চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি,রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, এইচডব্লিএফ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ম্রানুচিং মারমা ও বিএমএসসি রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ক্যচিংনু মারমা। সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুনীতি বিকাশ চাকমা।

পিসিপি নেতা অন্তর চাকমা বলেন, আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীদের কোথাও নিরাপত্তা নেই। খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় ধর্ষণের শিকার আদিবাসী মেয়েটি নিজের বাড়িতে ৬ জন সেটেলার বাঙালি কর্তৃক গণধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে হুমকি-ধমকি দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী মেয়েটি মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে এনং বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বিষয়টি জনসম্মুখে চলে আসে। ধর্ষণের ঘটনায় চারজন গ্রেফতার হলেও দুইজন এখনো পলাতক রয়েছে। গ্রেফতারকৃত ৪ আসামীকে যখন পুলিশ ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তাদের মুচকি হাসি অপরাধীরা দায়মুক্তি পাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। অপরাধীদের মুখে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ পরিলক্ষিত হয়নি। এতে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তির বিধান করা হবে কিনা তা নিয়ে সাধারণ মানুষ সন্দিহান। পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সারা বাংলাদেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশের সাধারণ মানুষ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এটা রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক আদিবাসী নারী ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর মধ্যে কোনটারই যথাযথ বিচার হয়নি। কয়েকমাস আগেও বান্দরবানের চিংমা খিয়াং নামে এক আদিবাসী নারীকে জুমে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। আমরা যথাযথ শাস্তির দাবি জানিয়েছি। কিন্তু সুবিচারের বিধান করতে পারেনি ব্যর্থ রাষ্ট্র। বিপরীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী অপরাধীদের সেল্টার প্রদান করে। গতকাল খাগড়াছড়িতে ধর্ষণকারীদের যথাযথ শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে সেনাবাহিনী হামলা চালায় এবং কয়েকজনকে আটক করে অমানুষিকভাবে মারধর করে। আমরা এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ একেবারে অবরুদ্ধ। চারিদিকে আতঙ্ক আর ভয়। দশকের পর দশক সেনাশাসনে পিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। নির্দোষ আদিবাসীদের খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, জেল-জুলুমের মাধ্যনমে নিপীড়নের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে রাষ্ট্র একেবারে উদাসীন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দীর্ঘ সময় পরও পার্বত্য সমস্যা নিয়ে দায়িত্বশীল কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
তিনি পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবি জানান।

যুবনেতা সুমিত্র চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ঘটছে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, খুন, গুমসহ নানা রকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি ধারাবাহিক দমন-পীড়নের অংশ।
বাংলাদেশে বহুবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে, রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা মোড় নিয়েছে । কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমরা আজও নিপীড়িত, আজও অনিরাপদ। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতিফলন। সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস, নিপীড়ন ও নির্যাতনের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে।
আমরা দেখেছি—বান্দরবানে ম্রো শিশুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা, বম জনগোষ্ঠীর ওপর কথিত ‘কেএনএফ’ অভিযানের নামে শিশু ও নিরীহ গ্রামবাসীদের আটক, ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভূমিপুত্র আদিবাসীদের স্ব-ভূমি থেকে উচ্ছেদ। এই সকল ঘটনা প্রমাণ করে, শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য একটাই—জুম্ম জনগণকে অস্তিত্বহীন করে দেওয়া, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিসত্তাকে মুছে ফেলা। এটা শুধুমাত্র একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নয়—এটি একটি জাতিসত্তা ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র।
তিনি আরে বলেন, আমরা আজ স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই—এই অন্যায় আর বরদাশত করা হবে না। সরকার যদি ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করে, যদি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় চলমান নিপীড়ন থামানো না হয়, তাহলে জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজ আর চুপ থাকবে না।আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবো— গ্রামে গ্রামে, শহরে বন্দরে, বনে-জঙ্গলে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হবে সর্বত্র চলবে।

ম্রানুচিং মারমা বলেন, বাংলাদেশের অপরাপর জায়গায় নারীর ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় কিছুটা হলেও বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সেই বিচারপ্রক্রিয়া একেবারে অনুপস্থিত। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এখানে অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। একইসাথে আগুনে গি ঢালছে জাতিগত নিধনযজ্ঞের রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী ও পুরুষ – কেউই নিরাপদ নয়। আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের অধিকার ভূলন্ঠিত। এই পরিস্থিতি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, জুম্ম জনগণকে এখনই রাষ্ট্রীয় সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন তথা অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে আরও সুসংগঠিত ও বলিষ্ঠ করে তুলতে হবে। ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

বিএমএসসির ক্যচিংনু মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলমান। যার ফলে একের পর এক ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ ঘটলেও এর কোনো বিচার হয় না। অপরাধীরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আমাদের ধারণা, খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ার ঘটনাটিও এর ব্যতিক্রম হবে না।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন খাগড়াছড়িতে গতকাল ছাত্র-ছাত্রীরা শান্তিপূর্ণ মিছিল করে প্রতিবাদ জানায়, তখন সামরিক বাহিনী তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়—এইসব অপরাধ কারা করছে এবং কারা তাদের ইন্ধন দিচ্ছে।
আমরা স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, এসব অপরাধের বিচার করুন, এসব জঘন্য ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ তৈরি করে দেবেন না। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ করুন। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ছাত্র সমাজ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

পিসিপি, রাঙ্গামাটি জেলার শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক মিলন চাকমার সঞ্চালনায় উক্ত মিছিল ও সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এইচডব্লিউএফ, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক কবিতা চাকমা।

More From Author

+ There are no comments

Add yours