জেল হেফাজতে দুই বমের মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং নিরপরাধ বমদের মুক্তির দাবিতে ২৩৫ নাগরিকের বিবৃতি

হিল ভয়েস, ৪ জুন ২০২৫, ঢাকা: বান্দরবানে সন্ত্রাস দমনের নামে নির্বিচারে সাধারণ আদিবাসীদের আটক, বিশেষ করে বম জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশুসহ সাধারণ নাগরিকদের বছরের পর বছর কারাবন্দি রাখা বিষয়ে তীব্র নিন্দা ও ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছেন দেশের ২৩৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক।

গত পহেলা জুন চট্টগ্রামে বম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার লালসাংময় বমের মৃত্যুতে তীব্রভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লালসাংময় বম এবং লালত্লেং কিম বমের জেল হেফাজতে মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং সকল নিরাপরাধ বম নাগরিকদের মুক্তির দাবিতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, উন্নয়নকর্মী, কৃষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিবেশকর্মী, ছাত্রনেতা, সংস্কৃতিকর্মী, স্থপতি, শিল্পী, কবি, লেখক, আলোকচিত্রী, ডাক্তার, রাজনৈতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার ২৩৫ জন নাগরিক আজ ৩ জুন ২০২৫ এই বিবৃতি প্রদান করেন।

বিবৃতিতে বলা হয় “কুকি চীন ন্যাশনাল পার্টির সদস্য সন্দেহে বম জাতিগোষ্ঠীর যে কাউকে যখন তখন গ্রেপ্তার বা হয়রানির নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রীয় নীতির শিকার লালসাংময় বমকে ২০২৩ সালে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, মিথ্যে মামলায় কারাবন্দি নিরাপরাধ লালসাংময় বম প্রায় দুই মাস ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

তাঁর শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি হলেও যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ অবহেলার কারণে তার শারীরিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি ঘটলে, গত ২৯ মে তড়িঘড়ি করে তাঁকে জামিন দেয়া হয়। অবশেষে ৩১ মে চমেক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজ গ্রামে ফেরার আগেই মৃত্যুবরণ করেন কারাবন্দি লালসাংময় বম।

লালসাংময় বমের পরিবারের অভিযোগ অমূলক নয়। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আরো একজন বম তরুণ জেল হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেন। গত ১৫ মে, ২০২৫ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আদিবাসী তরুণ লালত্লেং কিম বম বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছেন। চমেকের তথ্যানুযায়ী হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই লালত্লেং কিম বমের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

পরিবারের অভিযোগ, বিনা বিচারে এক বছর ধরে লালত্লেং কিম বমকে বন্দী রাখা হয় এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেও যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।”

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, রাষ্ট্র কতিপয় “কেএনএফ সদস্যের সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনে”র অজুহাতে মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী অবস্থায় এই মৃত্যু রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ড।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে কেএনএফ-এর দুর্বৃত্ত কর্তৃক ব্যাংক ডাকাতির জের ধরে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ‘যৌথ অভিযানের নামে বম জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন শুরু করে। নির্বিচারে ধরপাকড়, নির্যাতন, শিশুদেরকে অভুক্ত রাখাসহ সর্বশেষ মিথ্যা মামলার শিকার হন নিরাপরাধ নারী, শিশু, শিক্ষার্থী ও বয়োজ্যেষ্ঠরাও। অবশেষে কারাবন্দী অবস্থাতেই ‘কাঠামোগত হত্যার শিকার হলেন লালত্লেং কিম বম ও লালসাংময় বম।

বিবৃতিতে লালসাংময় বম এবং লালত্লেং কিম বমের জেল হেফাজতে চিকিৎসা-অবহেলা এবং মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হয়। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা, নিপীড়নের প্রতিচ্ছবি, বাঙালি আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র এই হত্যার দায় এড়াতে পারে না।

রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষিতে নাগরিকদের পক্ষে থেকে সরকারের কাছে ৫টি দাবি জানানো হয়-

১) চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে লালসাংময় বম ও লালত্লেং কিম বমের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনুন।

২) অবিলম্বে বম জাতিগোষ্ঠীকে কালেক্টিভ পানিশমেন্ট প্রদানের কৌশলকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্বিচারে আটককৃত বম বাসিন্দাদের মুক্তি দিতে হবে।

৩) বম জাতিগোষ্ঠীর মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা, হাটবাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা কাজের উপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।

৪) সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার সাথে কেএনএফ-সহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের সনাক্ত করে তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে। কেএনএফ এর ইস্যুকে কেন্দ্র করে জাতিগত নিধন, হয়রানি, আটক বন্ধ করতে হবে।

৫) পাহাড় ও সমতলের সকল নাগরিকের সমান অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুন।

More From Author