১৭ আগস্ট: চাকমা জনগোষ্ঠীর কালো দিবস–২

0
1590

নিরঞ্জন চাকমা

ব্রিটিশ র্তৃ চাকমা রাজ্যে অধিকার বিস্তার:

ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমনের অনেককাল আগে থেকেই চাকমা জনগোষ্ঠীর লোকেরা দক্ষিণপূর্ব ভারতের বার্মা সীমান্তবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় তারা চট্টগ্রামের মোগল শাসকদের সঙ্গে মৈত্রী-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মাত্র এগার মন কার্পাস কর প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীকার ও সার্বভোমত্ব রক্ষা করে চলছিল। তৎসঙ্গে তারা মৈত্রীর প্রতীকিস্বরূপ মোঙ্গলীয় রাজকীয় উপাধী খাঁ (খান বাগান) শব্দটি চাকমা রাজপুরুষেরা নামের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশদের আগমনের প্রাক্কালে চাকমাদের অধিকারভুক্ত ভূ-ভাগটি ছিল নিম্নরূপ ঃ পূর্বে কুকি রাজ্য (বর্তমান মিজোরাম) ও বার্মার আরাকান প্রদেশ, পশ্চিমে সমতল চট্টগ্রামের নিজামপুর রোড, উত্তরে পার্বত্য ত্রিপুরার ফেনী নদী এবং দক্ষিণে চট্টগ্রাম জেলা ও বঙ্গোপসাগরের তটভূমি (বর্তমানে কক্সবাজার ও নাফনদীর মোহনা অঞ্চল) তৎকালে চাকমা রাজ্যের অধিকারভুক্ত ছিল।

ব্রিটিশরা তথা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধে জয়লাভের পর ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে সুবা-চট্টগ্রাম  অঞ্চলের দেওয়ানি অধিকার লাভের ঘটনা সূত্রে চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন পার্বত্য অঞ্চল তথা চাকমা রাজ্যটিও দখল করতে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে শুরু হয়ে যায় চাকমাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরোধ। তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের আকার নেয়। ১৭৭৭ খেবে ১৭৮৬ খিস্টাব্দ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পরও ব্রিটিশরা চাকমা রাজ্যটি দখল করতে পারেনি। নিরূপায় হয়ে ব্রিটিশরা তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সমতল অঞ্চলের বাজারসমূহ অবরোধের কৌশল অবলম্বন করে। এই জটিল পরিস্থিতিতে তৎকালীন চাকমারাজা জনবক্স খাঁ ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে স্বয়ং পৌঁছে যান কোলকাতায়। সেখানে ফোর্ট উইলিয়ামে ব্রিটিশের মহামান্য গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস এর সঙ্গে দেখা করে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন, যা কার্পাস চুক্তি (Cotton Treaty) নাম দেওয়া হয়। এই চুক্তির পরবর্তীকালে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা এক ঘোষণা বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজ্যটির আয়তন ছিল ৭০০০ বর্গমাইল। প্রশাসনিক সুবিধার কারণে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশ কিছু এলাকা চট্টগ্রাম জেলার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ফলে এই পার্বত্য জেলার আয়তন কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৬০০০ বর্গমাইল। ব্রিটিশদের দ্বারা চাকমা রাজ্য অধিকৃত হওয়ার পর চাকমা রাজ্য বিভক্ত করে দক্ষিণাঞ্চলকে নিয়ে ১৮৭১ সালে বোমাং সার্কেল এবং উত্তরাঞ্চল নিয়ে ১৮৮৪ সালে মং সার্কেল গঠন করে এই পার্বত্য রাজ্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত করা হয়। প্রতি সার্কেলের জন্য একজন রাজা বা সার্কেল চীফ নাম দিয়ে আভ্যন্তরীণ শাসনভার তাঁদের অর্পণ করা হয়। সময়ে সময়ে জারিকৃত কয়েকটি আইন দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসিত হতে থাকে। তার মধ্যে ১৮৬০ সালের ২২নং আইন (ACT XXII of 1860), ১৮৬৩ সালের ৪নং আইন (বিধি), ১৮৭৩ সালের ৩নং বিধি এবং ১৮৮১ সালের ৩নং বিধি অন্যতম ছিল। ১৮৮৪ সালের আঞ্চলিক সার্কেল বিধি সংশোধন ও পরিবর্তন করে ১৮৯২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্কেলগুলোকে পুনর্গঠন করা হয়। পরে ১৮৯২ সালের শাসনবিধিকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে ১৯০০ সালের ১৭ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি নামে একটি আইন জারি করা হয়। তাতে বলা হয়-

১) এই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার জন্য ব্রিটিশ সরকারের একজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হবেন, যিনি প্রশাসনের বিষয়ে উল্লিখিত তিন সার্কেল চীফ বা রাজাদের সঙ্গে পরার্মশ করবেন।

২) এই পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী প্রজাদের সার্বিক সুরক্ষার জন্য বহিরাগত কাউকে ভূমি ক্রয় বা ভূমি অধিগ্রহণ এবং জেলায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার দেওয়া হবে না।

৩) এই জেলার তিন রাজা নিজ নিজ সার্কেলে পূর্বের মতো তাদের সামাজিক প্রচলিত বিধি বিধান (Customary Laws) সুরক্ষার ও যাবতীয় দেওয়ানি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকারী থাকবেন।

৪) বহিরাগত প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে এই জেলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য সরকারের অনুমতিপত্র নিতে হবে এবং তার সময়কাল কোন মতেই ১২ (বার) মাসের অধিক হবে না।

৫) এই জেলার সুপারিন্টেন্ডেন্ট অধিবাসীদের কল্যাণার্থে ও জেলার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে অবাঞ্চিত কাউকে এই জেলা থেকে যেকোন সময়ে বহিষ্কার করতে পারবেন।

উল্লেখ্য, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে এই জেলা সুপারিন্টেন্ডেন্টের নামের পরিবর্তে ডেপুটি কমিশনার নামকরণ করা হয়। এরপর ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার চিটাগাং হিলট্র্যাক্টস ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী এই পার্বত্য জেলার আদিবাসীদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অবশেষে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার “চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন” প্রণয়ন করেন, যা সর্বসাধারণের মধ্যে “সিএইচটি ম্যানুয়েল” নামে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এই বিধি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের আদিবাসীদের আঞ্চলিক স্বশাসনের অধিকারকে যেন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া দেওয়া হল।

এর পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা ১৯১৯ সালে এই পার্বত্য রাজ্যকে “পশ্চাদপদ অঞ্চল” (ব্যাকওয়ার্ড ট্র্যাক্টস) এবং ১৯৩৫ সালে “শাসন বহির্ভুত অঞ্চল” (এক্সক্লুডেড এরিয়া) হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ঘোষণাবলীর কার্যকারিতা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল।

ব্রিটিশ শাসনকালের শুরুতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর লোকদের হীনবল করার উদ্দেশ্যে এবং চাকমা জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও দৃঢ়চেতা মনোভাব বিনষ্ট করার কৌশল হিসাবে চাকমা রাজ্যটিকে তিনভাগে ভাগ করার মধ্য দিয়ে কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করে থাকলেও, এটা সত্য যে, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাসহ অন্যান্য সকল সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর আদিবাসীদের পাশর্^বর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুপজাতি সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক শোষণ তথা আগ্রাসন থেকে সুরক্ষা প্রদান করেছিল। তা আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে ১৭৮৭ সালের কার্পাস চুক্তি থেকে আরম্ভ করে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা বিভিন্ন প্রশাসনিক বিধিমালা প্রণয়ন করার দিকে নজর দিলেই অনুভব করতে পারি। তাই বলা যায়, চাকমা রাজ্যটিকে তারা ব্রিটিশ-সুলভ অপকৌশলের মাধ্যমে অধিকার করে থাকলেও, পরবর্তীকালে তারা অনুভব করেছিল, প্রকৃতপক্ষে চাকমারা ব্রিটিশের প্রজা নয়, তারা ছিল করদ (ঞৎরনঁঃধৎু) মাত্র। সে কারণে, ১৮২৯ সালে চট্টগ্রামের কমিশনার মিঃ হলবেড ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষে নিকট লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন “The hill tribes of Chittagong Hill Tracts are not British subjects, but merely tributaries, and we have no rights on our part to interfere with their internal arrangements”. বাস্তবিকভাবে, ব্রিটিশের শাসনকালে কদাপি তারা চাকমাদের আভ্যন্তরীণ সমাজ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করেনি।

চলবে…….

নিরঞ্জন চাকমা: হিল ভয়েস (নিউজ পোর্টাল)-এর সম্পাদক এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।