বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসিত পার্বত্য চট্টগ্রাম

0
519

নিপন ত্রিপুরা

পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা জানতে সম্প্রতি ১২ থেকে ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের কূটনীতিক প্রতিনিধিদল খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলা সফর করেন। সফরের আগে ১০ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ১০টি শর্ত সাপেক্ষে কূটনীতিক প্রতিনিধিদলকে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সফরের অনুমতি দেয়া হয়।

১০টি শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে কূটনীতিক প্রতিনিধিদলের বৈঠকে রাঙ্গামাটি জেলার ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও ডিসি এবং চাকমা সার্কেল প্রধানের সাথে বৈঠকে রাঙ্গামাটি জেলার ডিসিকে রাখতে হবে। সরকারের স্বেচ্ছাচারী, বর্ণবাদী এবং ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিবাদ জানিয়ে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা কূটনীতিকদের সাথে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্যাঞ্চলের বিশেষ শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ সরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান একজন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। এমন একজনের সাথে কূটনীতিকদের বৈঠকে ডিসি, সরকার দলীয় এমপি রাখার নির্দেশনা ইতিহাসে বিরল। হেন নির্দেশনা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও পাহাড়ের জুম্ম জনগণের উপর সরকারের বর্ণবাদী এবং ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির বহি:প্রকাশ। এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর জুম্মরা নেট দুনিয়ায় প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেছিলেন ।

ঔপনিবেশিকতার কথা উঠলে, এখনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভয়াবহ শোষণের ইতিহাসের কথা মনে পড়ে। আমাদের এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ শুরু হয়েছিল রবার্ট ক্লাইভদের হাত ধরেই। তার আগে থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন শুরু হলেও পলাশীর যুদ্ধের পর আসল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোড়াপত্তন ঘটে। পলাশী যুদ্ধের মূল ষড়যন্ত্রের হোতা রবার্ট ক্লাইভ অত্যাচারের প্রতীক। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের উপর সীমাহীন অত্যাচার করেছেন। তার নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লুটপাট, হত্যা, দখল ও অত্যাচারে মেতে উঠেছিল। সে ইতিহাস ব্রিটেনের জনা কয়েক লোক জানলেও সিংহভাগ লোকের কাছে তিনি নায়ক, যে রবার্ট ক্লাইভের একটি ভাস্কর্য পশ্চিম ইংল্যান্ডের শ্রেসবেরিতে রয়েছে। আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডের পর রবার্ট ক্লাইভকে ভারতবর্ষের লোকজনের উপর শোষণ-নিপীড়নের সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস টেনে এনে তার ভাস্কর্য সরানোর দাবি তুলেছেন শত শত মানুষ। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, উপনিবেশের কালো ইতিহাস কি এখনো ব্রিটেনের ‘গর্ব’ বলে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত?

এবার আসি বাংলাদেশের কথা, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহেদ মালেক একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, হাসপাতালে অপারেশন হয় না, অপারেশন হয় চট্টগ্রামের পাহাড়ে। ৯ আগস্ট ২০২০ তারিখে স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহেদ মালেক এ কথাটি মুখ ফসকে বলুক আর স্বজ্ঞানে বলুক পাহাড়ের একজন জুম্ম সেদিন লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কেননা তার এ বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সরকারের আসল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। মাননীয় মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই মুখ ফসকে হলেও আসল কথাটি বলার জন্য। পাহাড় মানে সরকার অথবা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি হল সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীর আস্তানা। সেখানে কিছু পর্যটন কেন্দ্র আর সন্ত্রাসী থাকে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীরা যেন প্রতিনিয়ত অপারেশনে ব্যস্ত থাকে। নিরাপত্তাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমে প্রতিদিন খবরের শিরোনাম, “অমুক জায়গা থেকে পাহাড়ি সন্ত্রাসী বন্দুুক, চাঁদার রসিদ বইসহ নগদ ২ লক্ষ টাকা আটক”।

সরকারের সে ভূত বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠের উপরও চেপে বসেছে। তাই বেশিরভাগ বাঙালিও মনে করে পাহাড় মানে কেবল আনন্দখানা ও সন্ত্রাসীর আস্তানা। পাহাড়ে নাকি সন্ত্রাসীরা থাকে, তারা নাকি বাঙালিদের কাটে মারে এমন অদ্ভূত ধরনের প্রশ্ন আমি অনেকবার মুখোমুখি হয়েছি যখন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তাম। কী ভয়াবহ দৃষ্টিভঙ্গি! অথচ সরকার কর্তৃক জুম্ম জনগণের অধিকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে না চাওয়ার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সাধারণ বাঙালিদের মনে মনগড়া পাহাড়ি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, সেটি কেউই বুঝতে অপারগ। আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘুরতে গিয়ে কতবার পাহাড়িদের হামলার শিকার হয়েছেন? উল্টো নিরীহ পাহাড়িদের বাড়িতে রাত কাটিয়ে, ঘরে খোরাকি যা আছে তা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে নিরাপদে বাড়িতে ফিরেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা প্রায়ই বলতেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জমানায় এসেও পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসিত শোষিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য পার্বত্য এলাকাকে জুম্ম অধ্যুষিত এলাকা থেকে সামরিক ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বেশি বাড়াবাড়ি করলে খাগড়াছড়িতে পাঠিয়ে দিব, বান্দরবানে পাঠিয়ে দিব ইত্যাদি ইত্যাদি বাংলা সিনেমা নতুবা বিজ্ঞাপনের ডায়লগ হরহামেশায় দেখা যায়। তাজা চায়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, আমার ভাতিজার যদি চাকরি না হয়, আপনাকে ওভারনাইট বান্দরবানে পাঠিয়ে দিব। এরকম হাতের নাগালে অসংখ্য বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপন দেখি আমরা।

পার্বত্য এলাকা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা এখান থেকে কিছুটা বোঝা যায়। কেউ কেউ খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলতে পারে বিজ্ঞাপন বা বাংলা সিনেমার দৃশ্যগুলো কেবল মনোরঞ্জনের জন্য, বাস্তবের সাথে মিল নাই। তাই এসব নিয়ে মাথা ব্যাথার কোন কারণ নাই। খোদ সরকার যখন নিজেই এমন কাজ করে তাহলে তার উত্তর কে দিবে? সরকার নিশ্চয়ই মসকরা কিংবা কারো মনোরঞ্জন করার জন্য এসব বলেন না বা করেন না। বলতে চাই, এ ব্যবস্থা তো অনেক দিনের পুরনো। তবে সরকার আগের চেয়ে এখন পুরোদমে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অসৎ, অর্থ, নারী-শিশু কেলেঙ্ককারীতে যুক্ত সরকারি আমলাদের তিন পার্বত্য জেলায় জোর করে বদলি করছে। যাতে করে সে দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও বিভিন্ন কেলেঙ্ককারীতে জড়িত ব্যক্তিরা সহসাই পার্বত্য এলাকায় এমন সব অপকর্ম সম্পাদন করতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সপ্তম বৈঠকে তাজা চায়ের ‘আমার কাজটি করে না দিলে তোমাকে ওভারনাইট বান্দরবান পাঠিয়ে দেব’ সংলাপের একটি বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবি ওঠে। বৃহস্পতিবার সেই বিজ্ঞাপন বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে তথ্য অধিদপ্তর। কিন্তু বিজ্ঞাপনটির অর্ধেক অংশ এখনো টিভি পর্দায় ঘুরছে।

শাসকগোষ্ঠীর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা পানিশমেন্ট জোন। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১৬ পালনের মূল অনুষ্ঠানে প্রয়াত স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘অনেক ডাক্তার আছেন যাঁরা সিগারেট খান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি ঘোষণা দিচ্ছি, যদি শুনি কোনো ডাক্তার সিগারেট খান, আমি তাঁর পোস্টিং বাতিল করে দেব, তাঁকে বান্দরবানে পাঠিয়ে দেব।’ স্বাস্থ্যসচেতন একজন নাগরিক হিসেবে এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে অন্যকে ধূমপান না করার বিষয়ে উৎসাহ তিনি দিতেই পারেন। এর সাথে বান্দরবানের সম্পর্ক টেনে আনাটা মনে করি সমতলে থাকলে নিয়মমাফিক জীবন পার করতে হবে, পাহাড়ে গেলে ধূমপান থেকে শুরু করে যাবতীয় কিছু করার রাষ্ট্রীয় লাইসেন্স আছে।

আমি যখন খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে পড়তাম তখন খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে সমাজবিজ্ঞানের কোন শিক্ষক ছিলো না, কোনোমতে জেলা সমবায় অফিসারকে দিয়ে সমাজবিজ্ঞানের ক্লাসগুলো সম্পন্ন করা হত। কয়েকদিন পর জানতে পারি আমাদের কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের এক নতুন শিক্ষক এসেছে। তার শিক্ষার পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষণ পদ্ধতি সবকিছু দেখে বুঝা যায়নি তিনি শাস্তি পেয়েই কলেজে বদলি হয়ে এসেছেন। কয়েক মাস পর সবাই জানতে পারে আমাদের ভদ্র শিক্ষক চট্টগ্রাম কলেজে থাকাকালীন সময়ে কলেজের এক শিক্ষার্থীকে কু প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে ওই ছাত্রী কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের করলে, কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্ত কমিটি ওই শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীকে কু প্রস্তাবের প্রমাণ পায়। সেজন্য শাস্তি স্বরূপ তাকে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে বদলির ব্যবস্থা করেন। এ বিষয়টি জানার পর কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিলে কলেজ অধ্যক্ষের কাছে তাকে ফেরত পাঠানর দাবি তুললে পরে অধ্যক্ষ মহোদয় তাকে ফেরত পাঠায়।

কয়েক বছর আগে নোয়াখালীতে এক স্কুল ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষককে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়েছিল। তাকে অন্য কোন জায়গায় বদলি করার জন্য খাগড়াছড়িতে প্রতিবাদ উঠেছিল। প্রতিবাদ শুরু হয়েছে খোদ পার্বত্যাঞ্চল থেকেই। ২০১৬ চুয়াডাঙ্গার দর্শনার উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করার জন্য খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়েছিল। তবে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর প্রবল আপত্তির মুখে বহুল আলোচিত ‘বাঁশ পিডি’ সাদেক ইবনে শামছ সেখানে যোগ দিতে পারেননি। সেটিও ছিল সেই পরিচিত ‘পানিশমেন্ট ট্রান্সফার’।

নানা অপরাধের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসা বিভিন্ন দপ্তরের সামরিক-বেসামরিক আমলা, কর্মকর্তারা পাহাড়ে এসে পাহাড় দখল, ভূমি বেদখল, নারী ধর্ষণ ও সাম্প্রদায়িক হামলার মতন জঘন্য ঘটনায় নিজেদের জড়াচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের অনিয়মিত প্রকাশনা জুম্মবার্তার (নভেম্বর-জানুয়ারি ২০১৮) মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলমের নির্দেশে তার তিন ভাই (১) ফরিদুল আলম, (২) ছুরত আলম ও (৩) জহুর আলম নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৬৮ নং রেজু মৌজার ১০০ জন পাহাড়ি ও বাঙালির প্রায় ১০০ একর ভূমি দখল করে নিয়েছিল। জাসদ আ স ম আব্দুর রব, চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের এরিয়া কমান্ডার মো: আব্দুল মতিন ও তার আত্মীয়-স্বজনের নামে ২২৫ একর, অভিনেতা সোহেল রানার নামে ৫০ এর জমি লীজ নেয়া আছে (তথ্যসূত্র: পার্বত্য ভূমি সহায়িকা পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার, ইজারা এবং আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সমস্যা)।

বেদখলের ঘটনার কোনোটিই বিধি সম্মত নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও পার্বত্য জেলা পরিষদের আইন লঙ্ঘন করে পার্বত্য জেলার বাসিন্দা নয় এমন ব্যক্তি ভূমি লীজ নিয়ে বছরের পর বছর পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করে রেখেছে। দখলদার ও ইজারাদার অনেকেই সামরিক, বেসামরিক আমলা। সাম্প্রতিক সময়ে ৩০৩ নং ডলুছড়ি মৌজার ম্রো এবং ত্রিপুরাদের বংশ পরম্পরায় ভোগদখলীয় ৪০০ একর ভূমি বেদখলের চেষ্টাকারী লামা রাবার কোম্পানিতে সামরিক-বেসামরিক আমলার সাথে মন্ত্রী-এমপিদের সমন্বয়ে সর্বমোট ৬৪ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তার মধ্যে তিনজন বান্দরবান পার্বত্য জেলার দায়িত্ব পালন করে যাওয়া জেলা প্রশাসক রয়েছে।

এ গ্রুপটি ভূমি বেদখলের জন্য কী করেননি। ৪০০ একর ভূমি বেদখলের জন্য লামা রাবার কোম্পানি জুম বাগানে অগ্নিসংযোগ করে। পানি পানের উৎস ঝিরিতে বিষ প্রয়োগে জুম্ম গ্রামবাসীদেরকে হত্যা চেষ্টার পর মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বান্দরবান জেলা পরিষদের উদ্যোগে সদস্য মোজাম্মেল হক বাহাদুরকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ভুক্তভোগী পাড়াবাসী এবং রাবার কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত লোকজনের সাথে কথা বলে ভূমি বেদখলের অপচেষ্টার ঘটনা এবং লামা রাবার কোম্পানির ইজারা শর্ত ভঙ্গের প্রমাণ পান। ইজারা গ্রহণের ৫ বছরের মধ্যে রাবার প্রকল্প গ্রহণ না করলে, ইজারার মালিকানা বাতিলের শর্ত থাকলেও ২৫ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও রাবার চারা এখনো সৃজন করা হয়নি।

পার্বত্য জেলা পরিষদের তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত থেকে ফিরে এসে তারা বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর ইজারা শর্ত মোতাবেক প্রকল্প গ্রহণ না করায় সকল ইজারা বাতিল, ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো ও ত্রিপুরাদের জুম ভূমি ফিরিয়ে দেয়া, বাগান উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদান, হয়রানি না করা, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ অগ্নিসংযোগকারীদের গ্রেফতারের ৬ দফা সুপারিশ পেশ করেন। পার্বত্য জেলা পরিষদের তদন্ত কমিটি রাবার কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলতে চাইলেও রাবার কোম্পানির মালিকরা হাজির হননি। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কোম্পানিতে চাকরিজীবী লোকদের পাঠিয়ে দেন। অথচ এই রাবার কোম্পানির ইজারার অধিকার এখনো টিকে আছে। প্রশাসন ও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ২৬ অক্টোবর থেকে কয়েকদিন ধরে ভাড়াটে রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে জঙ্গল কেটে আবার নতুন জায়গা দখল করে। কার ক্ষমতা ও মদদের ফলে লামা রাবার কোম্পানি টিকে আছে তা নতুন করে ভাবার অবকাশ নেই। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটময় পরস্থিতির সৃষ্টির জন্য দখলদারের পক্ষাবলম্বনকারী ও মদদদাতাদের ভূমিকা সামনে চলে আসে।

২০১৭ সালে লংগদুতে সাম্প্রদায়িক হামলার সময় সেটেলারদের কর্মসূচিতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সংহতি বক্তব্য ও তার কিছুক্ষণ পর পাহাড়িদের গ্রামে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চালিয়ে প্রায় ২০০ টির বেশি ঘরবাড়ি পুড়ে দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী হামলা না ঠেকিয়ে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখাটা আরও বেশি প্রমাণ করে তথাকথিত নিরাপত্তার লেবাস লাগিয়ে কারা সন্ত্রাসের আসল মদদদাতা ও সাম্প্রদায়িক হামলার কুশীলব।

আমার মনে পড়ে, বিজিবির একটি মনগড়া রিপোর্টের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৭ জানুয়ারি ২০১৫ সালে পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অনুষ্ঠিত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ১১টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর ৫ নাম্বার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, “কোন দেশি-বিদেশি ব্যক্তি/ সংস্থা কর্তৃক পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতীয়দের সাথে সাক্ষাৎ কিংবা বৈঠক করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী/ বিজিবির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে”। এর অর্থ দাঁড়ায় যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন আদিবাসী তার বিদেশী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কিংবা কথা বলতে চাইলে অথবা আদিবাসীদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন বা বিজিবির প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে কথা বলতে হবে। আদিবাসীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে এটা করতে হবে, কিন্তু যদি ওখানে বাঙালির সঙ্গে কথা বলতে যান কিংবা মৌলবাদী সংগঠন সম-অধিকার আন্দোলন বা উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান, তাহলে কারও উপস্থিতি বা মনিটরিং লাগবে না। এটা তো অ্যাডলফ হিটলারের সিদ্ধান্তের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে কোনো ইহুদি কোনো জার্মানের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না। সরকার কতটা সাম্প্রদায়িক হলে এ রকম নির্লজ্জ বিদ্বেষর্পূণ ও বৈষম্যমূলক একটা নির্দেশনা আসতে পারে।

বৈষম্য পাহাড়ে কতটা প্রকট, তা এই সিদ্ধান্তে সহজে অনুমেয়। দেশপ্রেম কি শুধু প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিংবা সেনাসদস্য বা বিজিবি সদস্যদের আছে? আদিবাসীদের কি দেশপ্রেম নেই? এ নির্দেশনা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা আলোচনা হলেও বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী এ নির্দেশনাটি এখনো পাহাড়ে চালু আছে। আরেক দিকে আদিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য রক্ষাকবচ আইনগুলো লঙ্ঘন করেই চলছে। তার দিকে সরকার কোনো নজর দিচ্ছে না। এরকম আরও ভূড়ি ভূড়ি বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী বক্তব্য এবং বদলির নজির আছে। তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তিন পার্বত্য জেলা এখনো ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদীর কায়দায় শাসিত হচ্ছে। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরনের শাসন, বাংলাদেশের বাকি জেলাগুলোতে আরেক ধরনের শাসন প্রচলিত।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করে বলেছেন, বদলিকে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধরা যায় না। ছোটখাটো অপরাধের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দুর্গম কোনো স্থানে বদলির বিষয়টি প্রথা হিসেবে চালু আছে (প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। বহু আগে আন্দামান দ্বীপে রাজবন্দীদের পাঠানো হতো। আন্দামানে বসবাসই ছিল তাঁদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি। বাংলাদেশেও সরকারি চোখে একটি আন্দামান দ্বীপ আছে, সেটি সাধারণ জনগণ কিছুটা জানলেও সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কাছে একদম জানা বিষয়। আর বাংলাদেশে সরকারের প্রমাণিত দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা ‘সরকারের কথা না শোনা’ কর্মকর্তাদের শাস্তিস্বরূপ পাঠানো হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। সন্দেহ নেই, এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি নেতিবাচক ধারণারই ফল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন শোষণের ধারাটা বুঝতে আর কিছু আলাপ করা যাক। পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা জুম্ম নারী ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ভূমি বেদখল, জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, উচ্ছেদ করেই চলেছে। সেটেলারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১/১১/২০১৮ খ্রিঃ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়। উক্ত পরিপত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ৪টি নির্দেশনা দেয়া হয়। নিরাপত্তাবাহিনী তাদের উপর মানবিক আচরণ ও সহানুভূতিশীলতার সাথে হেয় প্রতিপন্ন না করা, বাঙালি সংগঠনসমূহের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন ও আইনগত অধিকার নিশ্চিত করা, সোনামিয়া টিলাসহ বাঙ্গালিদের বেদখল হওয়া ভূমি ফেরত পাওয়ার জন্য পূর্ণ প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করা এবং সর্বশেষটা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেটেলারদের সমতলে ফেরত আনা রোধকল্পে কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

চারটি নির্দেশনা পুরোপুরি পাহাড়ি বিদ্বেষী এবং বর্ণবাদী। এর থেকে প্রতীয়মান হয় সরকার প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যুগ যুগ ধরে বসবাস করা পাহাড়িরা দখলদার। যে পাহাড়িরা একরের পর একর জুড়ে জায়গা হারাচ্ছে তারাই দখলদার। বস্তুত বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নয় বরং জিইয়ে রাখতে চায়। সমস্যা যতবেশি জিইয়ে রাখা যাবে, ততবেশি তারা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য মোক্ষম সুযোগ পাবে। এর থেকে বুঝা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর শাসকগোষ্ঠী, রাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বাহিনী কী ভয়াবহ আকারে বর্ণবাদী আচরণ করছে যা খালি চোখে দেখলে বা বস্তুর সংস্পর্শে না গেলে বুঝা যায় না।

২০২১ সালের ২৯ আগস্ট সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভাবে জুম, আদা, হলুদ চাষের উপর কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি ও নিরুৎসাহিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের বরাবর একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের পক্ষে মেজর এইচ এম মোহাইমিন বিল্লাহ চৌধুরীর স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় “বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জুম (হলুদ/আদা) চাষের নিমিত্তে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টকরণ প্রসঙ্গে” পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়।

উক্ত নির্দেশনায় বলা হয় যে, “পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকজন ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত জীবনধারণের জন্য প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে ‘জুম’ চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে প্রস্তুত করে থাকে, যা একটি নৈমিত্তিক বিষয়। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে জুম চাষ প্রবর্তিত হওয়ায় পার্বত্য এলাকায় জীববৈচিত্র এবং প্রকৃতির উপর চরম ও সুদূর প্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।” এই নির্দেশনাও একটি বর্ণবাদী, বৈষম্যমূলক এবং জুম্ম বিদ্বেষী। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের অথনৈতিক যাত্রা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর একটি অপকৌশল ছাড়া কিছু না। কেননা জুম চাষ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শুরু হয়নি। আদিবাসীদের জীবনধারণের সাথে জুম চাষের যাত্রা শুরু। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভিন্ন নামে জুম চাষ করা হয়। জুম চাষ, আদা-হলুদ চাষ কখনোই জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।

২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় ইফতেখার মাহমুদ-এর “বন্য প্রাণীর শত্রু-মিত্র বনাম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দায়” শীর্ষক কলামেও বলা হয়েছে, “বিশ্বের ৪০ শতাংশ বনভূমি ও বন্য প্রাণী রক্ষা করে আদিবাসী মানুষেরা। পশ্চিমা দেশগুলোতে যাদের আদিবাসী বা ইন্ডিজেনাস কমিউনিটি বলা হয়। এই আদিবাসী মানুষেরা পরিবেশ ও বন্য প্রাণী রক্ষাকে নিজেদের সংস্কৃতি, ধর্ম আর আচারের অংশ হিসেবে পালন করেন।” জুম চাষ আদিবাসীদের একটি প্রথাগত অধিকার হিসেবে অ্যাখা দিয়ে আইএলও কনভেনশন নং ১৬৯-এর অনুচ্ছেদ ১৪(১)-তে তাদের প্রতি বিশেষ নজর প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। মূলত পার্বত্য এলাকায় জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতির উপর চরম ও সুদূর প্রসারী বিরূপ প্রভাব পড়ার ক্ষেত্রে উন্নয়নের নামে বন উজার, বনাঞ্চল উজার করে রাস্তাঘাট ও সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, জুমভূমি দখল করে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বনজ সম্পদ আহরণ, কাপ্তাই লেক দখল, পাহাড় কাটা, পাথর উত্তোলন, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার মূল কারণকে পাশ কাটিয়ে জুম চাষ, আদা ও হলুদ চাষকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের দায় একতরফাভাবে পাহাড়ি জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কটু ইতিহাসের কথা সবাই জানে। তাদের সে শাসনের ইতিহাস এতটাই বর্বর ও শোষণমূলক ছিল যে, সুদূর ব্রিটেনে বসে শোষণের মাত্রাটা বুঝার উপায় ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার আজো সে বর্বর ইতিহাস মানতে নারাজ। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ নিয়াল ফাগুনসন তো বলেই দিয়েছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বৈশ্বিক কল্যাণের জন্য ভালো ছিল। এমনকি ব্রিটেনের স্কুল-কলেজের ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে ব্রিটিশ উপনিবেশকে দেখানো হয় দাসপ্রথার বিলুপ্তির কারণ হিসেবে, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মূলে রেলপথ, ব্রিজ নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে এবং সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণসহ আরও অনেক মহৎ কাজের কারণ হিসেবে। যদিও তাদের এই মনোহরি দাবি ভারতবর্ষের লোকজনের কাছে ঢোপে টিকবে না।

ভারতের সাবেক মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, জাতিসংঘের সাবেক কূটনৈতিক এবং লেখক শশী থারুর ‘এন এরা অব ডার্কনেস (২০১৬)’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইখানা পরবর্তীতে ব্রিটেন থেকে ‘ইনগ্লোরিয়াস এম্পায়ারঃ হোয়াট দ্য ব্রিটিশ ডিড টু ইন্ডিয়া (২০১৭)’ নামে প্রকাশিত হয়। তাঁর মতে, ভারতবর্ষ শাসনকালে ব্রিটিশরা যা করেছিল তা রীতিমতো দানবীয় অপরাধ। তিনি বইটিতে পরিষ্কার করে বলেছেন, ব্রিটিশ উপনিবেশের কারণে ভারতবর্ষের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের কাছে তাদের (ব্রিটেনের) কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও ব্রিটিশদের মতন বর্ণবাদী ও উপনিবেশিক কায়দায় শোষণ ও নিপীড়ন করে চলেছে। ব্রিটিশদের ন্যায় ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি তো আছেই। যার ফলে পার্বত্য সমস্যা বেড়েই চলেছে। দীর্ঘ হচ্ছে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের উপর শোষণ-নিপীড়ন, যা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

নিপন ত্রিপুরা: সাধারণ সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।