‘গুণীজন স্মৃতি সংঘ’এর উদ্যোগে রাঙ্গামাটিতে ৩ বিশিষ্ট গুণীজনকে শ্রদ্ধা ও স্মরণ

0
467

হিল ভয়েস, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, রাঙ্গামাটি: ‘গুণীজন স্মৃতি সংঘ’-এর উদ্যোগে বিশিষ্ট গুণীজন ড. মানিক লাল দেওয়ান, ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান এবং বাবু যামিনী রঞ্জন চাকমাকে শ্রদ্ধা ও স্মরণে রাঙ্গামাটি শহরে এক স্মরণ সভা আয়োজন করা হয়।

আজ শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২) সকাল ৯:০০ টায় রাঙ্গামাটি শহরের তবলছড়ি আনন্দ বিহার বহুমুখী হলে এই স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

গুণীজন স্মৃতি সংঘের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমার সভাপতিত্বে ও নিথি ভূবন চাকমার সঞ্চালনায় স্মরণ সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক ইন্টু মনি তালুকদার। এছাড়া স্মরণ সভায় আরো বক্তব্য রাখেন প্রফেসর মধুমঙ্গল চাকমা, সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মনি স্বপন দেওয়ান, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারি জেলা জজ দীপেন দেওয়ান, প্রয়াত শিক্ষাবিদ ড. মানিক লাল দেওয়ানের কন্যা ঝুমা দেওয়ান, প্রয়াত যামিনী রঞ্জন চাকমার সন্তান সমীরণ চাকমা, অধ্যাপক রণ জ্যোতি চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা প্রমুখ।

সভায় বক্তারা তিন গুণী ব্যক্তিবৃন্দদের স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, বর্তমান সমাজের মধ্যে এই ধরণের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যারা সমগ্র দেশ এবং জুম্ম জাতির জন্য কাজ করে গিয়েছেন তাদের ব্যক্তিত্ব, আত্মত্যাগ ও অবদান বর্তমান ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে এখনো অজানা।

বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম সমাজে অনেক জ্ঞানী, গুণীজন জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ইতিমধ্যে অনেকেই পরলোকগত হয়েছেন। অনেকে এখনো বেঁচে আছেন। সে সকল গুণীজনদের আমাদের অবশ্যই স্মরণ ও শ্রদ্ধা করতে হবে। কারণ তারা জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামসহ শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আগামীতে জুম্ম জাতির অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কার কথা জানান।এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা, ভূমি সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। বক্তারা বিশিষ্ট তিন গুণীজন প্রয়াত যামিনী রঞ্জন চাকমা, প্রয়াত ড. মানিক লাল দেওয়ান ও প্রয়াত ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের নীতি-আদর্শকে অনুসরণ-অনুকরণ করার জন্য তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান।

সভায় সকলের মতামত ব্যতিরেকে এই দিনটিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল গুণীজনদের স্মরণ করার দিন হিসেবে আগামীতে পালন করার ঘোষণা করা হয়।

ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সংক্ষিপ্ত জীবনী:

ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান (আর এস দেওয়ান) ১৯৩২ সালের ১৭ই জানুয়ারি বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার খবংপয্যা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমেস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং উচ্চতর পড়াশুনার জন্য ১৯৬৭ সালে যুক্তরাজ্যে গমন করেন। এরপর তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কুইন্স এলিজাবেথ কলেজ থেকে এমফিল এবং সালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি ১৯৭০ দশক থেকে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের স্বপক্ষে প্রচার কার্যে আত্মনিয়োগ করেন যা ক্লান্তিহীনভাবে আমরণ পর্যন্ত চালিয়ে যান। তিনি ২৯ মার্চ ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার সিটির একটি অ্যাপার্টমেন্টে হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

যামিনী রঞ্জন চাকমার সংক্ষিপ্ত জীবনী:

কর্ণফুলী হ্রদে তলিয়ে যাওয়া লংগদু থানার তুলাবান গ্রামে চাকমা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান লেখক যামিনী রঞ্জন চাকমা ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তুলাবান গ্রামের প্রথম মেট্রিকুলেশন (১৯৩৬), প্রথম সরকারি চাকরি (১৯৪২), প্রথম গেজেটেড অফিসার (১৯৬৮) ও প্রথম সরকারি পেনশনধারী (১৯৬৯) ছিলেন। চট্টগ্রাম বেতার থেকে তার লেখা বহু কথিক প্রচারিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে শিবচরণ, কালিন্দী রাণী, রাজর্ষি, সাধেংগিরি, লক্ষীপালা, চাকমা সমাজে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রধান সাহিত্য কর্ম “চাকমা দর্পন” চার খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর প্রভূত অবদান। এই মহান ব্যক্তিত্ব ২৫শে অক্টোবর ১৯৯৭ তারিখে তাঁর নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

প্রফেসর ড. মানিক লাল দেওয়ানের সংক্ষিপ্ত জীবনী:

ড. মানিক লাল দেওয়ান ৫ই জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে রাঙামাটি সদর উপজেলার ১০৯ নং সাপছড়ি মৌজার মানিকছড়ির মধ্য আদামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান অব ভেটেনারী সায়েন্স এন্ড এ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রী থেকে ১৯৫৮ সালে বিএসসি (এএইচ) ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ওয়াসিংটন ডিসি’র আর্মস ফোর্সেস ইনষ্টিটিউট অব প্যাথলজি থেকে ৬ মাসের জন্য বিশেষ ট্রেনিং সাফল্যজনকভাবে শেষ করে তিনি ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ-এর প্যাথলজি বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের জন্য তদানিন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর সরকারি স্কলারশিপ অর্জন করেন।

তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডীন এবং রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। ২৯ জুলাই ২০১১ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।