আগামীকাল মহান নেতা এম এন লারমার ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী

0
359
ছবি : মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা)

হিল ভয়েস, ৯ নভেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: আগামীকাল (১০ নভেম্বর ২০২২) জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক সংসদ সদস্য ও মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস।

দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষে এবং এম এন লারমার স্মরণে রাজধানী ঢাকা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে জানা গেছে।

এই উপলক্ষে বিগত বছরের ন্যায় “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি”র উদ্যোগে এইদিন বিকাল ৩:০০ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মরণসভা, প্রদীপ প্রজ্বালন ও প্রতিবাদী গানের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। বিকাল ৩:০০ টায় মহান নেতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালার সূচনা করা হবে। এবছর অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামালকে আহ্বায়ক ও হিরন মিত্র চাকমাকে সদস্য সচিব করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়।

একইদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে পালন করা হবে মহান নেতার ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস। এবার এই দিবসের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করুন, সকল প্রকার বিভেদ ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন’। এইদিনের এই কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ৭:৩০ টায় জমায়েত, সকাল ৮:০০ টায় প্রভাতফেরি, সকাল ৯:০০ টায় পুষ্পমাল্য অর্পণ, সকাল ১০:০০ টায় শোক প্রস্তাব পাঠ ও স্মরণ সভা এবং সন্ধ্যা ৫:০০ টায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ফানুস উড়ানো।

এছাড়া জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে এবং খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের উদ্যোগে দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

উল্লেখ্য, আজ থেকে ৩৯ বছর আগে ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর গভীর রাতে জনসংহতি সমিতিরই মধ্যে থাকা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী, বিশ্বাসঘাতক, বিভেদপন্থী ও অপরিণামদর্শী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের অতর্কিত সশস্ত্র হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন জুম্ম জনগণের অত্যন্ত প্রিয়জন, নিপীড়িত মানুষের পরম বন্ধু, পাহাড়ি-বাঙালি সকল সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অবিসংবাদিত এই এম এন লারমা। তাঁর এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে সমগ্র জুম্ম জাতিসহ বিশ্বের অধিকারকামী জনগণের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়।

একই ঘটনায় এম এন লারমার সাথে আরও শহীদ হন তাঁরই বড় ভাই সহযোদ্ধা শুভেন্দু প্রবাস লারমা (তুফান), সহযোদ্ধা অপর্ণাচরণ চাকমা (সৈকত), অমর কান্তি চাকমা (মিশুক), পরিমল বিকাশ চাকমা (রিপন), মনিময় দেওয়ান (স্বাগত), কল্যাণময় খীসা (জুনি), সন্তোষময় চাকমা (সৌমিত্র) ও অর্জুন ত্রিপুরা (অর্জুন)।

এম এন লারমা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি শহরের অনতিদূরে মহাপুরম (মাওরুম) নামক এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে। তাঁর ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তাঁর অনুপস্থিতিতে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব ও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের হাল ধরেন। সন্তু লারমার নেতৃত্বেই ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতি বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তাঁদের একমাত্র ও সবার বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনুও এক পর্যায়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এম এন লারমা ছিলেন একজন মহান চিন্তাবিদ, আদর্শবান রাজনীতিক ও আপোষহীন সংগ্রামী। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পুরনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পথিকৃৎ, শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য দাবি জানান।

এম এন লারমা ১৯৬০ সালে জুম্ম জনগণের মরণ ফাঁদ খ্যাত কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের হীন মুখোশ উন্মোচন করে এক বিবৃতি প্রদান করলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত করে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেফতার করে। তিনি দুই বছর জেল খাটার পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।

তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল হতে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে এই অঞ্চল থেকে পুনরায় জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

তাঁরই সুদক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভিন্ন ভাষাভাষি অধিকার বঞ্চিত আদিবাসী জুম্ম জনগণ জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন পরিচালনা করার সকল পথ রুদ্ধ হলে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ লাভ করে।

জুম্মদের জাতীয় জীবনে তাঁর অবদান অপরিমেয় ও অপরিসীম। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অসীম ধৈর্য, মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও কষ্টসহিষ্ণুতার অধিকারী এ0বং অসাধারণ আদর্শবান, সৃজনশীল রাজনীতিক ও আপোষহীন সংগ্রামী। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, আচার-ব্যবহারের অমায়িক, ভদ্র, নম্র, ক্ষমাশীল, সৎ, নিষ্ঠাবান ও সুশৃঙ্খল এবং সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত।