অতীতের সংগ্রামের ইতিহাস আগামী প্রজন্মের পথচলার অন্যতম পাথেয়

0
656
ছবিতে সাবেক গেরিলা দল ‘শান্তিবাহিনী’র একদল সদস্য

বাচ্চু চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে বিশেষ করে ’৮০ দশকে অত্যন্ত খারাপ অবস্থা বিরাজ করছিল। জুম্ম জনগণের উপর সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতন, নিপীড়নের নির্মম কাহিনি শুনলে শরীর শিউরে ওঠে। সেই সময় সেনাবাহিনী ও বহিরাগত মুসলমান সেটেলার উভয়ই একসাথে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের উপর শকুনের মতোই হিংস্র থাবা ফেলেছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামে কলমপতি, ভূষনছড়া, লোগাং, পুজগাং, লংগদু, কাচালং ও নানিয়ারচর এলাকাসহ জুম্ম জনগণের গ্রামে গ্রামে অকথ্য নির্যাতন ও গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। সেই সময়ে সেনাবাহিনীর সাথে জুম্ম জনগণের সশস্ত্র সংঘাত বলবৎ থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিলো। এই অমানবিক নির্যাতনের লোমহর্ষক সংবাদ সংগ্রহ করা ছিলো অত্যন্ত কঠিন কাজ। সমতল থেকে সাংবাদিকরা পার্বত্য চট্টগ্রামে কী হচ্ছে প্রত্যক্ষভাবে এসে তা সংগ্রহ করা ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমের উপর ছিল কড়া নজরদারি। যারা সংবাদ সংগ্রহ করার চেষ্টা করে তাদের চুড়ান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তা করতে হত। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর সেনাবাহিনী বহিরাগত মুসলমান সেটেলার বাঙ্গালিদের সাথে নিয়ে অকথ্য নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামে আসলেই কী চলছে তা পুরো বিশ্বই সেই সময় অবগত ছিলো না। কেবলমাত্র বাঙালি মুসলমান না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের উপর শাসকগোষ্ঠী দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিলুপ্তিকরণের নীতি হাতে নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহের উপর বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর অকথ্য নির্মম অত্যাচার ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, লিঙ্গগত ও চেহারাগত পার্থক্যের কারণে শুধু নয়, বিশেষ করে ধর্মীয় পার্থক্যের কারণেও এই অমানবিক নির্যাতনের শিকার পাহাড়ের অসহায় নিপীড়িত মানুষ। অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করতে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর এই হীন উদ্দেশ্য।

পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে দেশের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অসংখ্য মানুষকেও একই কায়দায় নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এই সঠিক হিসাব হয়তো আমাদের মধ্যে না থাকলেও ন্যুনতম হিসাব অবশ্যই থাকবে। বিশেষ করে, ৮০ দশকে সেনাবাহিনীর অমানবিক অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন পাহাড়ের হাজার হাজার জুম্ম জনগণ। বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন অসংখ্য জুম্ম পরিবার। সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার জুম্ম জনগণ শরণার্থী হয়ে বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজতে সীমান্তের ওপারে চলে যেতে বাধ্য হয়। জুম্ম জনগণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংগঠন জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে শাসকগোষ্ঠীর সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্রোত বয়ে যায় পাহাড়ের চারিদিকে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় পার্টির নেতৃত্ব সব সময় সর্তক ও সোচ্চার থেকেছিলো। পাহাড়ের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণ শাসকগোষ্ঠীর এধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও অমানবিক শোষণ-বঞ্চনাকে মেনে নিতে পারেনি, এই অন্যায়কে মেনে নিতে পারেনি বলে প্রতিরোধ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে অসংখ্য বিপ্লবী জুম্ম তরুণ।

৬০-৭০ দশকের অসংখ্য জুম্ম তরুণ মনে করে, বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী যে অত্যাচার জুম্ম জনগণের উপর শুরু করেছে তা নিয়ে পাহাড়ের মানুষ আর চুপ করে বসে থাকবে না। অত্যাচারী শাসনের সামনে পাহাড়ের জুম্ম জনগণ কখনোই পরাজয় মেনে নেবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ৮০ দশকের সময় সবচেয়ে রক্তাক্তপূর্ণ ও উত্তপ্ত ছিলো। বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জুম্ম জনগণের ক্ষোভের আগুন তখন আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হচ্ছিল। আর সেই জুম্ম তারুণ্যের বিপ্লবী হৃদয়ের ক্ষোভের আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়ে সমগ্র জুম পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন পাহাড়ের একজন বীর সেনানী মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের হাওয়া লেগেছে পাহাড়ের অসংখ্য জুম্ম তরুণের মনে।

প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমাদের জনপ্রিয়তা ছিলো জুম্ম জনগণের সামনে আকাশচুম্বি যা সত্যিই অতুলনীয়। অতীতের মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল কিংবা পাকিস্তান আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশ আমলেও ফের বঞ্চিত করা হয়েছে। বিন্দু বিন্দু জল যেমনি সিন্ধুতে পরিণত হয় তেমনি এই অসংখ্যবার বঞ্চনা ও ক্ষোভের আগুন পুঞ্জিভূত হয়ে পাহাড়ের বুকে তুষের আগুনে পরিণত হচ্ছিল। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যার বিস্ফোরণ ঘটেছে বলা যায়।

উল্লেখ্য যে, ৮০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের উপর শুরু হয়েছে নির্মম গণ-হত্যাকান্ড। প্রায় এক ডজনেরও অধিক এই গণহত্যা থেকে নারী-পুরুষ, শিশু কিংবা বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। শত-শত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়েছে। অসহায় দূর্গত জুম্ম জনগণের প্রতি ভারত সরকার মানবিক আশ্রয় দিতে আগ্রহী ছিলেন। বেঁচে থাকার তাগিদে ভারতের টেরিটোরিতে একটুখানি মানবিক আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসা হাজার হাজার জুম্ম জনগণই বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর কাছে হয়ে গেল সেদিন সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী এবং ভারতপন্থী। এটাই বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া নীতির আসল দৃষ্টিভঙ্গি। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছামত করে জুম্ম জনগণের অধিকার হরণ করবে, জুম্ম নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা করবে, জুম্ম জনগণের জায়গা জমি জোরপূর্বক জবরদখল করে নেবে, জুম্ম জনগণের উপর অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালাবে এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করতে সমতল অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ পাড়-ভাঙা, নদী ভাঙা মুসলমান সেটেলার বাঙালি ট্রাকের পর ট্রাকে করে নিয়ে এসে জুম্মদের জায়গাতে বসিয়ে দেবে আর জুম্মদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করবে তা কখনোই মানবতার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। শাসকগোষ্ঠীর এই হীন ষড়যন্ত্র দেখার পর পাহাড়ের জুম্ম তরুণরাই সেদিন চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারেনি, সময়ের দাবিতে এই জবাব ঠিকই দেওয়া হয়েছিলো।

৮০ দশকে পাহাড় ছিলো এক আতঙ্কের জনপদ। সেই ভয় ও আতঙ্ক পাহাড়ের মাথার উপর থেকে এখনও সরে যায়নি। পাহাড়ের জুম্ম তরুণরাও সেই সময়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পাত্র ছিলো না, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে শুরু হয়েছে প্রতিরোধ সংগ্রাম। সশস্ত্র গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা কায়দায় জনসংহতি সমিতির সক্রিয় বিপ্লবী কর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। ব্যাপক জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজ সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে রাত-বিরেতে জনসংহতি সমিতির সক্রিয় কর্মীরা যেদিকে মার্চ করেছেন, সেদিকে পাহাড়ের মানুষ শান্তিতে নিদ্রা লাভ করে মনের মধ্যে প্রশান্তি পেয়েছে। পাহাড়ের বুকে যেখানে চুরি-ডাকাতি, অসামাজিক কার্যকলাপ, অন্যায়, অবিচার সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই জনসংহতি সমিতির সক্রিয় কর্মীরা এসে ধৈর্য্য ও সাহসের সাথে মোকাবেলা করে ন্যায়ের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। এজন্যই এই সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীকে জুম্ম জনগণ তাদের মন থেকে ভালবেসে নাম দিয়েছিলো ‘শান্তিবাহিনী’।

একদিকে বিশাল শক্তিধর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অসম শক্তির বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য লড়াই জারী রেখেছে, অপরদিকে জুম্ম সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবীদের বুঝিয়ে বলার পদ্ধতি অনুসরণ করে সত্য ও ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে এনে সুন্দর সমাজ গড়ার বহুমুখী প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছে। এভাবে শান্তিবাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, অসংখ্য জুম্ম তরুণদের সাহস, শক্তি, মনোবল, বীরত্ব, যুদ্ধের কায়দা-কৌশল ও আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ন্যায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিলো বিশ্বের দুয়ারে-দুয়ারে। যার ফলে তখনকার সময়ে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়ে উঠেছিলো। সেনাবাহিনীর প্রধান বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আমরা রণ-ক্লান্ত, আমরা আর যুদ্ধ চায় না’। ধীরে ধীরে এক পর্যায়ে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর সাথে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের মধ্যেকার রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়।

এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সক্রিয় সদস্যসহ জুম্ম জনগণকে সরকার দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছিলো। রাষ্ট্রযন্ত্র বা বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী আজও সেই হীন নীতি থেকে বিন্দুমাত্র সরে যায়নি। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সময়, জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রতি অবিচল আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা, রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আনুগত্য পোষণ করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত ভাবে চালিয়ে গেছেন। যুদ্ধের বাস্তবতা অনুসারে যুদ্ধরত যেকোনো পক্ষের সৈনিক কিংবা অফিসারের আত্মবলিদান ঘটবে তা অনিবার্য সত্য। সেই সময়কার যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর অফিসারকে বন্দী করে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখার সদস্য শান্তিবাহিনীরা বুঝিয়ে বলার পর সেনা অফিসারকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছিলো এমন নজির ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ বলে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়েছে।

আমরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনদিনই অস্ত্র কাঁধে তুলে নিইনি। আমরা অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়েছি একারণে যে, যুগ যুগ ধরে মোঘল আমল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল পেরিয়ে অধুনা বাংলাদেশ আমলেও পশ্চাৎপদ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণকে নিজস্ব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং আত্মপরিচয়ের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং বেঁচে থাকার মৌলিক মানবাধিকার হরণ করা হচ্ছে। আমরা বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করিনি, আমরা আন্দোলন করেছি উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। আমরা আন্দোলন করেছি ইসলামি সম্প্রসারণবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। আমরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিইনি, আমরা অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়েছি নির্দয় সেনাশাসনের বিরুদ্ধে। যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবিতে পাহাড়ের মানুষ অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়েছিলো। এরপরেও কি বলবেন আমরা রাষ্ট্রদ্রোহী, আমরা সন্ত্রাসী? নিজের অধিকারের জন্য লড়াই সংগ্রাম করতে গিয়ে মানুষ যদি দেশদ্রোহী হয়, সন্ত্রাসী হয় তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমরা তাই করে যেতে প্রস্তুত রয়েছি।

স্বাধীনতার পর মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা গণতান্ত্রিক উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে জুম্ম জনগণকে তাড়ানোর চক্রান্ত পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে পুরোদমে শুরু হয়েছিলো। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রেখে যাওয়া একই বশংবদ নীতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তিকরণের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে পিছিয়ে পড়া জুম্ম জনগণের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি টিমের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সাথে দুরভিসন্ধিমূলক আচরণই ধীরে ধীরে জুম্ম জনগণের মনে শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সন্দেহ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার ৪ বছরের মাথায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর এমন দূরে ঠেলে দেওয়ার নীতি পাহাড়ের মানুষকে হতবাক করেছে। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর সারা দেশে সামরিক শাসন জারী হয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়। এহেন পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য গণতান্ত্রিক উপায়ে পদক্ষেপ নেওয়া কখনোই সম্ভব ছিলো না। বাধ্য হয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। জুম্ম জনগণের একমাত্র কান্ডারী সংগঠন জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে সামিল হয়ে শত-শত জুম্ম তরুণ শাসকগোষ্ঠীর অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়ভাবে শপথ নেয়। জনবল, অর্থবল ও অস্ত্রবল যদিও আমাদের জুম্ম জনগণের মধ্যে সীমিত ছিলো, তারপরও পার্টির সক্রিয় কর্মীদের মধ্যে অগাধ দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেমআন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করতে সক্ষমহয়েছিলো। মাতৃভূমিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জুম্ম জাতির মুক্তির ব্যাপারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে অসংখ্য জুম্ম তরুণ সর্বদাই উদগ্রীব ছিলো। শাসন-শোষণ ও পরাধীনতার প্রতি তীব্র ঘৃণা ছিলো বিধায় এমনতর পরিস্থিতিতে অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে ধৈর্য্য, মনোবল, সাহস, শক্তি ও কৌশল সকল প্রকার শর্ত জাগ্রত ছিলো। শাসকগোষ্ঠী যতই শক্তিশালী হোক, এই শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সামনে তৎকালীন পাহাড়ের বিপ্লবী জুম্ম তরুণরা বুক ফুলিয়ে লড়াই চালিয়ে ছিলো এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে প্রতিটি যুদ্ধে নাকানিচুবানি খাইয়ে কাবু করতে সক্ষম হয়েছিলো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির আলোকে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে ছিলো জনসংহতি সমিতি। যাদের মধ্যে রাজনৈতিক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতি, আদর্শ ছিলো। সেই সময়ের অসংখ্য জুম্ম ছাত্র তরুণ মাতৃভূমিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জুম্ম জাতির প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গের জন্য উৎসুক ছিলেন। বিপ্লবী রাজনৈতিক তত্ত্বে বলা হয়েছে, গাছ যেমন জমিনের রস খেয়ে দেহ বৃদ্ধি করে ঠিক তেমনি পাহাড়ের ৭০-৮০ দশকের সশস্ত্র গেরিলা যোদ্ধারাও জুম্ম জনগণের কাছ থেকে রস খেয়ে লড়াই চালিয়েছিলেন। জুম্ম জনগণের গর্ভেই জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র গেরিলাদের জন্ম হয়েছিলো, কাজেই জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার্থে তারা সব সময় সোচ্চার ও সচেতন ছিলেন। জুম্ম জনগণের গর্ভেই জন্মলাভ করা ৬০-৭০ দশকের জুম্ম ছাত্র সমাজের বীর সেনানীরা স্বপ্ন দেখেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের অধিকার ছিনিয়ে এনে দেবে, তাদের মুখে হাসি ফুটাবে এবং পাহাড়ের গণমানুষের দুঃখ-কষ্ট, গ্লানিভরা যন্ত্রণাকে মুছে দিয়ে পাহাড়ের নিজস্বতা ও স্বতন্ত্রতা ফিরিয়ে আনবে। উপযুক্ত রাজনৈতিক গাইডলাইনকে সামনে রেখে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছিলো সেদিনের প্রিয় অগ্রজ বীর সেনানীরা। মাঝিবিহীন নৌকা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না, কাজেই প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার রাজনৈতিক ও সামরিক উভয়ের সুদক্ষ পরিচালনায় আন্দোলন সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলো। যুগ যুগ ধরে বিপর্যয়ে দীর্ণবিদীর্ণ জুম্ম জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং শত-শত বীরযোদ্ধা নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। একজনের মৃত্যুবরণের সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন এসে খালি স্থান পূরণ করেছেন। জীবন উৎসর্গের এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া পাহাড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

নিজ ভূমি ও জুম্ম জনগণের মুক্তির যথার্থ সন্ধান ৬০-৭০ দশকের জুম্ম তরুণরাই দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের রাজনীতির প্রতি অসংখ্য ছাত্র ও যুবক এখনো সত্যিই অপরিচ্ছন্ন ও উদাসীন। নিজের অধিকারের প্রতি উদাসীনতার কারণে আজ পাহাড়ের সমস্যা দিন দিন জটিল হতে জটিলতর হচ্ছে। পাহাড়ের সমস্যাকে তারা এখনো পুরোপুরি বুঝার চেষ্টা করেন না, এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ অজ্ঞই রেখেছেন। অথচ আন্দোলন পরিচালনার মহান দায়িত্বভার ব্যাপক জুম্ম ছাত্র সমাজের উপরই অর্পিত রয়েছে। সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্যাপক জুম্ম ছাত্রসমাজের মধ্যে এখনো রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা আমাদের জুম্ম জাতির জন্য চূড়ান্ত অর্থে বিপদজনক একটা পরিস্থিতি ও অশনিসংকেত বলা যায়। তারপরও ত্যাগের প্রেরণা আসে সত্যিকার অর্থে প্রকৃত ভালবাসার গভীরতা থেকে। গভীরভাবে ভাল না বাসলে রাজনৈতিক কর্মীদের দেশের এবং জনগণের প্রতি সেবা ও ত্যাগের মনোভাব জন্মায় না। শোষিত, বঞ্চিত জাতি ও মানুষের প্রতি যার মধ্যে ভালবাসা নেই, তার সেবা ও ত্যাগের প্রেরণা থাকে না। মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মোৎসর্গের মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। সামাজিক ও পারিপার্শ্বিকতার সুশিক্ষার মাধ্যমে এসব গুণাবলি অর্জিত হয়ে থাকে। জুম পাহাড়ের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, হাজারো বেদনা, বঞ্চনা ও যন্ত্রণাকে ভালবাসার গভীরতা থেকে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা করার ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মনোভাব জন্মাতে পারে বলে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি!

সবশেষে, এরশাদ আমলেরসামরিক সরকার পেরিয়ে খালেদা জিয়া সরকার আমল এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনা সরকার আমলেই দীর্ঘ ২৬ বার বৈঠকের পর ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। কিন্তু, বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশন দাবানল এর পরিবর্তে অপারেশন উত্তরণ নাম দিয়ে চুক্তির আগের ন্যায় আজও এক ধরনের সেনাশাসন জিইয়ে রেখেছে। ফলশ্রুতিতে পাহাড়ের বুকে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে তা আজও বাস্তবায়নের আশানুরূপ সাফল্যের মুখ দেখেনি। চুক্তির আগের মতোই পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও জুম্ম জনগণের উপর সেনাবাহিনীর নির্দয় সেনাশাসন, সেনা নির্যাতন ও অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে চুক্তিকে পুরোপুরিভাবে লঙ্ঘন করে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো হচ্ছে। এমনতর পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় জুম্ম জনগণ আজও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজ ভূমিতে পরবাসীর মতন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

জুম্ম জনগণ নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে শিখেছে, নিজের অধিকারের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে শিখেছে, নিজের অধিকারের জন্য রক্ত ঢেলে দিতে শিখেছে। কাজেই, পৃথিবীর বুকে অধিকারকামী জাতিকে দমিয়ে রাখা যেকোনো শাসকের পক্ষে সম্ভব নয়। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতি নিজের অধিকারের জন্যলড়াই করতে শিখেছে ও জেনে-বুঝে নিয়েছে, সেহেতু এই জাতিকে দমন-পীড়ন চালিয়েও থামিয়ে রাখার হীন প্রয়াস শাসকগোষ্ঠী কোনদিনই সফল হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহকে নিজস্ব অধিকারের সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন পূর্বক অধিকার ফিরিয়ে দিলে বাংলাদেশ সরকারের ন্যায়সঙ্গত হবে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মুখ আরও উজ্জ্বল হবে, দেশের ভাবমূর্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।